শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৫০ অপরাহ্ন

শক্তিশালী গণতন্ত্র ছাড়া অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব নয়

খবরপত্র ডেস্ক :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৪ জুলাই, ২০২৩

অর্থনীতিকে এখন আর ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর সুযোগ নেই। এটা এখন একজন সাধারণ মানুষও বোঝে। সরকারকে এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে অর্থনৈতিক ক্রমাবনতি ঠেকাতে বাস্তবোচিত পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু খরচ কমানোর নীতি নয়, আয় বাড়ানোর নীতি অবলম্বন করতে হবে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্য কিভাবে বৃদ্ধি করা যায় এবং যেসব দেশ আমাদের রফতানির মূল গন্তব্যস্থল, সেসব দেশের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি ও সুসম্পর্ক স্থাপন করে বাণিজ্যিক সুবিধা বাড়াতে হবে। যেখানে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সিংহভাগ জড়িত, সেখানে যেতে হবে। সম্পর্কের উন্নয়ন করে সুবিধা আদায় এবং বৃদ্ধি করতে হবে। যেসব বিষয় নিয়ে টানাপড়েন সৃষ্টি হয় কিংবা সৃষ্টি হতে পারে, সেসব বিষয় সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। সরকারকে বাস্তববাদী হতে হবে এবং এ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমরা বিশ্বাস করি, একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তার অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত্তি নির্দেশ করে। রিজার্ভ শক্তিশালী থাকলে দেশের অর্থনীতি চাঙা থাকে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্য থেকে শুরু করে উৎপাদন কার্যক্রম গতিশীল থাকে। কথায় আছে, ‘উৎপাদনই উন্নতি’। যত বেশি উৎপাদন, অর্থনীতিরও তত বেশি অগ্রগতি। বছর দুয়েক আগেও বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী, রিজার্ভ ছিল ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। ২০২১ সালের আগস্টে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৪৮.০২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ বাংলাদেশ ব্যাংকে ছিল। এরপর থেকেই তা কমতে থাকে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, রফতানি আয়ের পতন এবং আমদানির খরচ বৃদ্ধি। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এ দুটিই বেড়েছে। যুদ্ধের কারণে দেশে দেশে ডলার সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ডলার সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বারবার টাকার অবমূল্যায়ন করেও রিজার্ভ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। গত সোমবার ডলারের বিপরীতে টাকার মান দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি কমেছে। অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন এক বৈঠকে টাকার মান এক লাফে কমিয়েছে ২.৮৫ টাকা। ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৮.৮৫ টাকা। রেমিট্যান্স, রফতানি ও আমদানির ক্ষেত্রেও বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আমদানি ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে ১০৯ টাকা করে কেনাবেচা করা হবে। ডলারের এই দামবৃদ্ধি যে রিজার্ভকে আরও নাজুক অবস্থার দিকে ঠেলে দেবে, তা বলা বাহুল্য।
বর্তমানে রিজার্ভ রয়েছে, ২৯.৯৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বর্তমানে সরকার রিজার্ভের যে চিত্র তুলে ধরছে, প্রকৃত রিজার্ভ তার চেয়ে কম। এর কারণ, এ রিজার্ভের সাথে ধারাবাহিকভাবে কিংবা আগামী এক বছরে ঋণ পরিশোধের অর্থ রয়েছে। এছাড়া অন্যখাতে বিনিয়োগও আছে। দায় এবং বিনিয়োগ রিজার্ভে ধরা যাবে না। আইমেএফ-এ পদ্ধতিতেই রিজার্ভের হিসাব করা হয়। বলা বাহুল্য, এ অর্থ বাদ দিলে প্রকৃত রিজার্ভ অনেক কমে যাবে। সাধারণত, দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তিন মাসের সমপরিমান রিজার্ভ থাকতে হয়। এ হিসেবে, এখন এ পরিমাণ অর্থ রিজার্ভে রয়েছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। অর্থনীতিবিদরা বারবার বলেছেন, সরকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী দেখাতে ডলারের দাম কমিয়ে দেখিয়েছিল। এখন সংকটে তা প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। রিজার্ভ ও ডলার সংকট সামাল দিতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েও তার নি¤œগামিতা ঠেকানো যাচ্ছে না। ডলার সংকট কাটাতে গত এপ্রিল থেকে সরকার বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। অতি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ ঘোষণা করেছে। কম গুরুত্বপূর্ণ আমদানিনির্ভর প্রকল্পের বাস্তবায়ন আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। এতসব পদক্ষেপ নেয়ার পরও রিজার্ভের পরিমান বাড়ছে না। রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব দিতে সরকার চাপে পড়ে মূলত আইএমএফ’র লোন নেয়ার শর্ত দেয়া থেকে। প্রতিষ্ঠানটি রিজার্ভের প্রকৃত তথ্য ছাড়া ঋণ ছাড় করবে না বলে জানিয়ে দেয় এবং বলে দিয়েছে, তার চাহিদা মতো রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করতে হবে। এতে সরকার বিপাকে পড়ে। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনক পর্যায়ে রয়েছে। যতই উন্নয়নের গালগল্প করা হোক না কেন, রিজার্ভের অপ্রতুলতা, ডলার সংকট, রেকর্ড মূল্যস্ফীতি দেশের অর্থনীতির দৈন্য প্রকাশ করে দিচ্ছে। এর মধ্যে খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে সরকারের দেশ পরিচালনার প্রশ্নবিদ্ধ নীতি নিয়ে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সুশাসন, অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন এবং এগুলোর ক্রমাবনতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের আপত্তি অর্থনীতির ওপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি করেছে। পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, দেশের এক নম্বর রফতানি পণ্য পোশাকের গন্তব্য এবং সর্বাধিক রেমিট্যান্স আসার দেশ যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে পোশাক আমদানি কমিয়ে দিয়েছে এবং দেশটি থেকে রেমিট্যান্স আসার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে, মানবাধিকার প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়নও পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা বন্ধের হুমকি দিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যুক্তরাষ্ট্র ও উরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো যখন এ ধরনের পদক্ষেপ নেয় বা নেবে বলে প্রচ্ছন্ন ও পরোক্ষভাবে হুমকি দেয়, তখন তা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে অর্থনৈতিকভাবে সবল হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সরকার যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য প্রভাবশালী দেশের যতই সমালোচনা এবং কটাক্ষ করুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে, অর্থনৈতিক দিক থেকে এসব দেশকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আমাদের দেশের সিংহভাগ রফতানি এসব দেশের ওপরই নির্ভরশীল। তারা যদি বাণিজ্যিক কার্যক্রম সীমিত বা বন্ধ করে দেয়, তাহলে আমাদের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। এসব দেশে আমরা যেমন বিভিন্ন পণ্য রফতানি করি, তেমনি আমদানিও করি। উৎপাদন খাতের ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, কাঁচামাল থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে হয়। রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং ডলার সংকটের কারণে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি অবলম্বন করেও আমাদের আমদানি কমাতে হয়েছে এবং কমেছে। এতে দেশের উৎপাদন খাতে যথেষ্ট ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দামও আকাশচুম্বী হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ অত্যন্ত কষ্টে জীবনযাপন করছে। আয় দিয়ে ব্যয় সংকুলান করতে পারছে না। বেকারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। হতাশ হয়ে পড়া তরুণ শ্রেণী অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা গভীর সংকটের মধ্যে নিপতিত হয়েছে। বিষয়টি অবশ্যই সরকারকে ভাবতে হবে, সরকারের চেয়ে জনগণ বড়। জনগণের সুখ-সুবিধা নিশ্চিত করা এবং দেখা সরকারের ঐকান্তিক ও ঈমানী দায়িত্ব। এজন্য সরকারকে আরো আন্তরিক হতে হবে।
আমরা মনে করি, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকলেই বাইরের শক্তির সহযোগিতা নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের প্রয়োজন হবে না। তাই সবার আগে ভোটাধিকার রক্ষার জন্য সরকার, বিরোধী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ শক্তিশালী গণতন্ত্র ছাড়া অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব নয়।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com