সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে একটি মুচি বাড়িতে বাংলা মদের ক্রেতা বেশে প্রবেশ করে ৪ যুবক। ওই বাড়িতে একজন বৃদ্ধা, তিন গৃহবধূ ও কয়েকজন শিশু ছাড়া সেদিন কোন পুরুষ মানুষ ছিল না। বাড়িতে প্রবেশ করা ৪ যুবকের মধ্যে এক যুবক একটি ঘর থেকে চেয়ার এনে ঘরের সামনে পেতে বসেন। বাকী ৩ যুবক বাড়ির মহিলাদের কাছে গিয়ে বলেন তারা পিকনিকে যাবেন তাদের বাংলা মদ লাগবে। পরে বাড়ির মহিলারা জানান তাদের কাছে বাংলা মদ নেই। পরে ওই যুবকরা তাদের অনুরোধ করে বলেন একটু থাকলেও হবে, আমরা খেয়ে দেখি। পরে যুবকদের অনুরোধে বাড়ীর এক গৃহবধূ তাদের খাওয়ার জন্য রাখা একটি ছোট বোতল থেকে ছোট একটি গ্লাস দিয়ে একটু দেন। এর পরে ওই ৪ যুবক বাড়ির বৃদ্ধা, গৃহবধূ ও শিশুদের জিম্মি করে ফেলেন। তাদের সাথে কালো একটি ব্যাগে করে বড় বড় দুটি তালা এনে তারা বাড়ির কলাপসিপল গেইটে তালা ঝুলিয়ে দেন। বুধবার (২ আগস্ট) এভাবেই স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের কথাগুলো জানান গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার মোক্তারপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের হরিদেবপুর (গুচ্ছ) গ্রামের ভূক্তভোগী গৃহবধূদীপিকা রানী দাস। তিনি আরো বলেন, বাহিরে চেয়ারে বসা যুবক ডিবি পুলিশের বড় কর্মকর্তা এবং তার দায়িত্বে বাকী ৩ যুবক কাজ করে বলে পরিচয় দেন। আমরা বাংলা মদ বিক্রি করি, আমাদের বিরুদ্ধে বড় মামলা হবে বাড়ির কেউ ছাড় পাবোনা, এমনকিবৃদ্ধা ও শিশুরাও এই মামলায় চালান হবে। র্যাব আসবে ধরে নিয়ে যাবে। বাড়িতে কোন পুরুষ না থাকায় আমরা তাদের পায়ে ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করি। তখন চেয়ার বসা যুবকটি বলে ৫০ হাজার টাকা দিলে ক্ষমা করা হবে। টাকা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করায় ডিবি পরিচয়দানকারী যুবকরা ক্ষেপে যায়। আমার স্বামীকে ফোন দিয়ে তাদের সাথে কথা বলানোর চেষ্টা করলে তারা ফোনে কথা বলেনি। এক পর্যায়ে কয়েক দফা দেন-দরবার করে আমার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। গৃহবধূদীপিকা রানী বলেন, সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকাল, তারা আমাদের জিম্মি করে রাখে। এ সময় আমার ছোট্ট শিশু খাওয়ার জন্য কান্না করলে তাকে বুকের দুধ পর্যন্ত খাওয়াতে দেয়নি তারা। এক পর্যায়ে তাদের কথা বার্তায় অসঙ্গতি দেখা দিলে এলাকার মানুষ ডাকাডাকি শুরু করলে তারা এসে তাদের অবরুদ্ধ করে ফেলে। এসময় স্থানীয়দের কাছ থেকে বাঁচতে তারা নিজেরাই সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে থানায় ফোন দেয়। পুলিশকে জানায়, এখানে বাংলা মদ আছে আপনারা দ্রুত আসুন। তাদের ধরতে হবে। কিছুক্ষন পর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বিস্তারিত জেনে ডিবি ও সাংবাদিক পরিচয়দানকারী যুবকদের পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যায়। এরপর আমি আর কিছু জানিনা। তবে তারা যাওয়ার সময় আমাদেরকে প্রাণনাশ ও মিথ্যা মামলার হুমকি দিয়ে যায়। ওই গৃহবধূর স্বামী নরেশ রবী দাসবলেন, ২৯ জুলাই শনিবার ঘটনার সময় আমি বাড়িতে ছিলাম না। মোবাইল ফোনে বিষয়টি শুনে স্থানীয় মেম্বারসহ গ্রামের মানুষদেরকে অবগত করি। পরে স্থানীয় জনতা এসে ডিবি ও সাংবাদিক পরিচয় দানকারী ওই চক্রটিকে ঘিরে ফেলে। কিছুক্ষনপর তাদেরকে থানা পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যায়। আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ আমাদের নানা হুমকি দামকি দিয়ে গেছে। তাই এই ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ করিনি। এলাকাবাসী, ওয়ার্ড আ’লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ওই চক্রটি প্রায়ই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে এলাকার সাধারণ মানুষদের সাথে নানা প্রতারনা ও মিথ্যা পরিচয়ে এভাবে অপরাধ করে যাচ্ছে। স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ারুল হক নাদের বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আমি ছুটে যাই। তারা প্রথমে নিজেকে ডিবি পুলিশ ও পরে স্থানীয় জনতার তোপের মুখে সাংবাদিক পরিচয় দেয়। কিন্তু পরে ৪ যুবকের ঠিকানা জানতে পারি। এদের মধ্যে জাকারিয়া আল মামুন নামের একজনের বাড়ি উপজেলার নারগানা গ্রামে, শামীম শেখ নামে একজনের বাড়ি বড়গাঁও গ্রামে, সারোয়ার নামে একজনের শ্বশুর বাড়ি বাহাদুরসাদী এলাকায় ও আলমগীর হোসেন মোল্লা নামে একজনের শ্বশুর বাড়ি চুপাইর গ্রামে। স্থানীয়দের তোপের মুখে পড়লে থানা থেকে পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে। তবে এ নিয়ে আমি আর কিছু বলিনি। কারণ থানা পুলিশ যেহেতু নিয়ে গেছে তাহলে সঠিক বিচার হবে বলে আমার ধারণা ছিল। কিন্তু পরে শুনতে পারলাম তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অপরাধ করেও পুলিশের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার বিষয়টি সত্যি দুঃখজনক। মোক্তারপুর ইউপি চেয়ারম্যান এস.এম. আলমগীর হোসেন বলেন, অভিযুক্ত চক্রটি প্রায়ই এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে মানুষকে জিম্মি করে বিভিন্ন পন্থায় হয়রানি করে এবং অর্থ হাতিয়ে নেয়। আমি নিজেও তাদেরকে কয়েকবার ইউনিয়ন পরিষদে ডেকে এনে সতর্ক করেছি। এ ব্যাপারে জাকারিয়া আল মামুন বলেন, ওই বাড়িতে মদ বিক্রি করে খবর পেয়ে আমরাপিকনিকে যাবো বলে মদ কিনতে যাই। পরে মদ পেয়ে পুলিশকে খবর দেই। এ সময় স্থানীয় মেম্বার এসে আমাকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে। তবে নিজেকে ডিবি পরিচয় দেইনি, সাংবাদিক পরিচয় দিয়েছি। টাকা নেওয়ার বিষয়টি সত্য না। কালীগঞ্জ থানায় উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইমরান তালুকদার বলেন, আমাকে ঘটনাস্থলে ওসি স্যার পাঠায়। পরে গিয়ে শুনি তারা মাদক উদ্ধার করতে গেছে। পুলিশের সহায়তা ছাড়া তারা কেন অভিযানে এসেছে, কেন নিজেকে ডিবি পরিচয় দিয়েছেন এ প্রশ্ন করলে তারা অস্বীকার করে। কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. ফায়েজুর রহমান বলেন, ঘটনাস্থল থেকে জাকারিয়া আল মামুন নামে একজন দুপুর ২টার দিকে মদ তৈরি হচ্ছে বলে আমাকে ফোন দেয়। পরে আমি সেখানে পুলিশ ফোর্স পাঠাই। কিন্তু ওই বাড়িতে পুলিশ গিয়ে কোন মদ পায়নি। স্থানীয়ভাবে জানতে পারছি তারা ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়েছে। তবে ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) কাজী শফিকুল আলম বিপিএম’র সাথে। তিনি সাংবাদিকদের মুঠোফোনে জানান, এ বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনাদের মাধ্যমে জানলাম। এখন খোঁজ নিয়ে দেখবো।