শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২১ পূর্বাহ্ন

মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য কীর্তি যে মসজিদে নামাজ পড়ার অনুমতি নেই

মুজাহিদ বিল্লাহ :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০২৩

মুসলমানরা আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্য নামাজ আদায় করেন। এ জন্য মসজিদ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রার্থনার স্থান। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় স্পেনে এমন এক মসজিদ রয়েছে যেখানে নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
বিজয় এবং আত্মগৌরব লুকিয়ে আছে স্পেনের ইতিহাসে। দেশটিতে ইসলামি স্থাপনার নিদর্শন রয়েছে। এর অন্যতম কুরতুবা মসজিদ যা কর্ডোবা মসজিদ বা কর্ডোবা ক্যাথিড্রাল মসজিদ নামেও পরিচিত। স্থানীয়দের কাছে মসজিদটি ‘দ্যা গ্রেট মেজিকিতা অব কর্ডোভা’ নামে অধিক পরিচিত। মসজিদকে স্প্যানিশ ভাষায় বলা হয় মেজিকিতা। ১৯৮৪ সাল থেকে মসজিদটি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক প্রতœতত্ত্ব সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারের মতে, বিস্ময়কর নির্মাণশৈলী এবং ব্যতিক্রমী কারুকার্যের কারণে মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য কীর্তি। অথচ এই মসজিদে এখন নামাজ পড়া নিষেধ। কারণ মসজিদটি ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, উমাইয়া খেলাফতের অন্যতম যুবরাজ প্রথম আব্দুর রহমান আল আন্দুলাসে প্রথম কর্ডোবা আমিরাত প্রতিষ্ঠা করেন। ৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুর রহমান তার খিলাফতের কেন্দ্র হিসেবে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। ৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুর রহমান মারা যান। তখন মসজিদের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের দিকে ছিল। আব্দুর রহমানের মৃত্যুর পর তার ছেলে হিশাম দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আব্দুর রহমান আদ দাখিলের প্রতিষ্ঠিত এই সাম্রাজ্য তার জীবনাবসানের পর পরবর্তী কয়েক শতাব্দীর মধ্যে বহুমুখী সংস্কৃতির মিলনমেলায় পরিণত হয়। ৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে হিশাম এই মসজিদ নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শেষ করেন এবং এর দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৬০০ ফুট এবং প্রস্থ ৩৫০ ফুট। সকল উমাইয়া শাসক এই মসজিদ নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় দশম শতাব্দীতে খলিফা ৩য় আব্দুর রহমান মসজিদের সম্পূর্ণ নির্মাণ কাজ শেষ করেন। মসজিদের সম্পূর্ণ আয়তন দাঁড়ায় এক লাখ দশ হাজার চারশো পনেরো ফুট। ১২৯৩ টি স্তম্ভের উপর দাঁড়ানো এই মসজিদে রয়েছে ৫০টি দরজা। এর পিলারের সংখ্যা ৮৫৬টি। এ ছাড়াও মসজিদ নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে দামী মার্বেল পাথর, জেসপার এবং অনিক্স পাথর। মসজিদের নকশা করেছিলেন একজন সিরিয়ান স্থপতি। এটিকে বলা হতো দশম শতাব্দীর ২য় বৃহত্তম মসজিদ। সবচেয়ে বড় ছিল মক্কার মসজিদুল হারাম। এই মসজিদের মডেল দেখে সে সময় বিশ্বে নানা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল। বিশেষ করে মসজিদের অন্যতম সৌন্দর্য ছিল এর মিহরাব। ৩৬ হাজার কাঠের খ- এবং হাতির দাঁত দিয়ে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। অমূল্য পাথরে নির্মিত মসজিদের মিম্বার তৈরিতে সময় লেগেছিল ৭ বছর। এর পাশেই রয়েছে ১০৮ ফুট মিনার যেখানে যাওয়ার জন্য ছিল ১০৭টি সিঁড়ি। মসজিদের মধ্যে ছোট বড় ১০ হাজার ঝারবাতি ছিল। এর মধ্যে তিনটি ছিল রুপার। প্রতিটি ঝারবাতিতে ব্যবহার করা হয়েছে ১৪৮০টি বাতি। রুপার ঝারবাতি ব্যবহার করতে তেল লাগতো ৩৬ লিটার। মসজিদ তদারকি করতেন ৩০০ জন খাদেম। কুরতুবা মসজিদ ছিল সে সময়ের মুসলমানদের শরীয়া আইন ও বিচারের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এই মসজিদে অনেকেই আধ্যাত্মিক জ্ঞান চর্চা করতেন। বিশ্বের বড় বড় মনীষী ও ইসলামী প-িতরা এখানে হাদিস ও কোরআন শিখতেন। আল্লামা কুরতুবী (রহ.) এখানে বসেই তফসিরে কুরতুবির পাঠ দিতেন। শাইখুল আকবর সুফী ইমাম ইবনে আরাবী (রহ.) ইলমে তাসাউফের পাঠ দিতেন। হযরত ইবনে হাজাম জাহেরী ইলমে ফিকাহ এর মাসলা নিয়ে আলোচনা করতেন।
এভাবে প্রায় ৫০০ বছর মুসলমানরা ক্ষমতায় থাকায় পর মুসলমানদের রাজত্ব নড়বড়ে হয়ে পড়ে। ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলা মুসলমানদের হত্যা করতে থাকেন। সে সময় ক্ষমতা চলে যায় খ্রিষ্টানদের কাছে। এ সময় স্পেনের দক্ষিণে গ্রানাডা ছিল মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল। ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা এই অঞ্চলে সামরিক অভিযান চালান। তারা কুরতুবা মসজিদ দেখে বিস্মিত হন। অনেকে মসজিদটি ভেঙে ফেলার পরামর্শ দিলেও সেটি গ্রহণ করা হয়নি। কারণ এমন স্থাপনা বিশ্বে খুব বেশি ছিল না। তখন দখলদার খ্রিষ্টানরা মসজিদে গির্জা স্থাপন করেন। ১৫২৩ খ্রিষ্টাব্দে এই মসজিদের কেন্দ্র ভেঙে একটি গীর্জা বানানো শুরু করে তারা। এরপর মসজিদে যেন কেউ নামাজ আদায় করতে না পারে এ জন্য বিশেষ বাহিনী নিয়োজিত রাখা হয়। তবে নামাজ আদায় করা নিষেধ হলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি দখলদারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এই মসজিদে নামাজ আদায় করেছেন। উপমহাদেশের অন্যতম ব্যক্তি আল্লামা ইকবাল তাদের অন্যতম। ১৯৩৩ সালে স্পেন সফরে এসে এই মসজিদ পরিদর্শন করেন আল্লামা ইকবাল। তিনি মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেন এবং উচ্চস্বরে আজান দেন এবং দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। বলা হয়ে থাকে প্রায় ৭০০ বছর পর এই মসজিদে আজান দেন তিনি। নামাজ পড়া অবস্থায় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং জ্ঞান ফেরার পর কবিতার মতো করে মোনাজাত করতে থাকেন। এরপর ১৯৭৪ সালে সাদ্দাম হুসাইন ইরাকের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্পেন সফর করেন এবং কর্ডোবা মসজিদ পরিদর্শন করেন। এক পর্যায়ে তিনি মসজিদের মিম্বারে নামাজ আদায় করেন। এ ছাড়াও বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও আরবের ধনী ব্যক্তিরা এখানে নামাজ আদায় করেছেন।
দুই হাজার সালের পর মুসলমানরা বারবার আন্দোলন করলেও এই মসজিদে নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এটির মালিকানা নির্ধারণ করার জন্য ২০১৫ সালে একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়। যদিও তারা কোনো রায় দেয়নি। ২০১৯ সালে কর্ডোবার মেয়র এই মসজিদের মালিকানা নির্ধারণ কমিটির কাজ বন্ধ করে দেন এবং ভবিষ্যতে এটি হওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই বলেও জানান তিনি। পশ্চিমারা বলকান (বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, আলবেনিয়া, গ্রিস, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, মেসিডোনিয়া, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া হার্জেগোভিনা, মন্টেনিগ্রো ও কসোভা) অঞ্চলের অনেক রাষ্ট্রে মুসলমানদের হাত থেকে ক্ষমতা নেওয়ার পর মসজিদ ধ্বংস করেছে এবং এভাবেই অনেক মসজিদ গীর্জায় পরিণত করেছে। -রাইজিংবিডি.কম




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com