ইউরোপীয়ানদের আবিষ্কৃত নতুন বিশ্ব আমেরিকায় পৃথিবীর সব প্রাণের, বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, ও গোত্রের জনগোষ্ঠীর এক সমন্বিত মেল্টিং পট বা শত শত চকচকে সোনালি মোজাইকের সমাহার। যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার ভাগ্যবিড়ম্বিত ছন্নছাড়া বালক সৎ বাবার অবহেলা অবজ্ঞাকে ছুড়ে ফেলে ভাইকে নিয়ে ভাগ্যের অন্বেষণে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন আজকের বিশ্বের সেরা ধনী ইলন মাস্ক। স্বল্প ভাড়ায় বেসমেন্টে বাস করে, প্রতিবেশীর ইন্টারনেট চুরি করে ব্যবসা শুরু করে তিনিই বিশ্বের এক নম্বর ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন। বিশ্বের মানুষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন নিজের আবিষ্কৃত রকেটে চড়ে সুলভ মূল্যে মঙ্গল গ্রহ ভ্রমণ করার। দূষণমুক্ত পরিবেশ ও আবহাওয়াকে সমৃদ্ধ করতে তৈরি করেছেন বিশ্বের সর্বাধুনিক ইলেকট্রিক কার টেসলা।
আফ্রিকার গরিব কেনিয়ার ইমিগ্র্যান্ট বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া আমেরিকান কালো বারাক ওবামা দুই-দুইবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে বিশ্বে আমেরিকার সর্বজনপ্রিয় প্রেসিডেন্টদের একজন হয়ে ইতিহাস তৈরি করেছেন। যার পূর্বপুরুষরা একদিন এ দেশে ক্রীতদাস হিসেবে এসেছিলেন, সেই মানুষটি তার মেধা, শ্রম আর ত্যাগ দিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এর চেয়ে বড় স্বপ্ন পূরণ আরো কিছু আছে বলে মনে হয় না।
ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, ভারত বা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গরিব অঞ্চলের অজ পাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত গৃহবধূ, মাতা জরিনা বেগম আর তার অল্পশিক্ষিত স্বামী ইমান আলীর মতো অনেকেই, যারা তাদের ছোট ছোট তিন, চার বা পাঁচ সন্তান নিয়ে লটারি বা ইমিগ্র্যান্ট ভিসায় আমেরিকায় এসেছিলেন। দিনে বেবিসিটিং ও রাতে নিজেরা হোটেলের রেস্টুরেন্টে ডিশ ধোয়ার কাজ করে সন্তানদের পড়াশোনা করিয়ে বানিয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার বা সরকারি চাকরিজীবী। তাদের সন্তানেরাই গাড়ি-বাড়ি করে সন্তানদেরও শিক্ষিত করে প্রতিষ্ঠিত করে বছর বছর স্বদেশসহ দেশ বিদেশ ভ্রমণ করছেন। নিজের স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা পেয়েছেন। অবসর ভাতা ও জমানো সঞ্চয় থেকে তারাই নিজ গ্রামের গরিব অসহায়, আত্মীয়স্বজন এলাকাবাসীর সাধ্যমতো সাহায্য করেন। এলাকায় জনহিতকর কাজ করছেন।
ময়না বেগম, লক্ষ্মীবালা, অসিত বাবু, শফিক বা জয়নাল সাহেবদের মতো ভাগ্যবিড়ম্বিত কিউবাসহ দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়ার লাখ লাখ ইমিগ্র্যান্টদের গল্পও একই। আমেরিকান জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে আমেরিকান লাইফ মেইনটেইন করছেন, আবার একই সঙ্গে দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, কালচার, ধর্ম নিজেদের মতো করে চর্চা করছেন। পিতা-মাতার ব্যাংক ব্যালেন্স, বাড়ি গাড়ি, টাকা পয়সার প্রত্যাশা করেন না। পিতা-মাতারা দিতে চাইলেও তারা তা না নিয়ে, দেশে বা আমেরিকায় তাদের বাবা-মা-দাদাদের নামে দাতব্য প্রতিষ্ঠান করতে বা গরিব আত্মীয়স্বজনকে সাহায্য-সহযোগিতা করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন এবং নিজেরাও তাতে অবদান রাখছেন।
সন্দ্বীপের জয়নাল সাহেব, সিলেটের কায়কোবাদ আর হাতিয়ার মাতলুব সাহেবরা বাংলাদেশ হওয়ারও অনেক আগে জাহাজের খালাসি হয়ে এসে নিউ ইয়র্কের হাডসন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে কোনো কাগজপত্র বা পাসপোর্ট ছাড়াই স্থায়ী হয়েছিলেন নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন শহরের চার্চ ম্যাকডোনাল্ড, কুইন্সের জামাইকাসহ স্বল্পখরচের আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে। জীবন-জীবিকার কারণে কেউ-বা রাস্তা, অফিস, পার্কিং লট, স্টেশন বা দোকান পরিষ্কার করেছেন, কেউ-বা কোনো হোটেল-রেস্তোরাঁর থালাবাসন পরিষ্কার বা স্টেশনারি দোকানে পত্রিকা সাপ্লাই করেছেন। তারাই সময়ে কাগজপত্র তৈরি করে বৈধ হয়ে কেউ নতুন সংসার করেছেন এখানেই, কেউ-বা দেশের সংসার নিয়ে এসে নতুনভাবে সাজিয়েছেন। পেশা কাজ পরিবর্তন করে কেউ-বা হয়েছেন কোনো এক গ্রোসারি, রেস্টুরেন্ট, সেভেন ইলেভেন, ডলার বা নাইনটিনাইন সেন্ট দোকান বা কফিশপের মালিক, কেউ-বা হয়েছেন ছোটখাটো কনট্রাক্টর, আবার কেউ-বা বিকেলে চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে চা-সিগারেট খেয়ে দিনে-রাতে ট্যাক্সি চালিয়ে টাকাপয়সা জমিয়ে জীবনের কাঙ্ক্ষিত সুখ ফিরে পেয়েছেন। দেশেও করেছেন বিরাট সুন্দর দৃষ্টিনন্দন ঘরবাড়ি। পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনকেও সাধ্যমতো সাহায্য করে দেশের বাড়িতে সুনাম কুড়িয়েছেন, প্রভাব-প্রতিপত্তিও বাড়িয়েছেন। নিজেরা প্রত্যেকেই সচ্ছল, স্বাধীন, সন্তানদের মুখাপেক্ষী না হয়ে দেশে সাহায্য সহযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তাদের সন্তানেরাই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, আইটি প্রফেশনাল, কেউ করপোরেট অফিসার, বিজ্ঞানী বা সরকারি ও বেসরকারি চাকরি করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। একাধিক গাড়ি-বাড়ি সংসার নিয়ে তাদের আমেরিকান ড্রিম সফল, বলা বাহুল্য হবে না। অনেকেই দেশী বা বিদেশিনী বিয়ে করে স্থায়ী স্থিত সফল ও প্রতিষ্ঠিত আমেরিকান। বাংলাদেশ বা তাদের পূর্বপুরুষের দেশের সংস্কৃতি তাদের ভেতরে কতটুকু আছে, তা পরিবারের নিজের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও পারিবারিক বন্ধনের ওপর নির্ভরশীল। একই সময়ে দেশ থেকে অল্প কিছু শিক্ষিত মেধাবী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও এসেছেন আমেরিকায়। কেউ এসেছিলেন পড়তে, কেউ-বা বেড়াতে বা অন্য কোনো মিশনে। তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন সে সময়ের ভালো ছাত্র।
কেউ-বা বুয়েটে, কেউ-বা মেডিক্যালের ছাত্র, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, কেমিস্ট বা দেশেরই বড় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব বিভাগের প্রতিভাবান ছাত্র। তাদের অনেকেই পেশাগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গর্বিত আমেরিকান বাঙালি হয়ে একেক জন অপেক্ষাকৃত কুলীন আমেরিকান হতে পেরেছিলেন। থেকেছেন অভিজাত তথা সাদা অধ্যুষিত এলাকায়। হোয়াইট কালার জব করতেন তারা। দেশীয় সংস্কৃতি মনে মনে ধারণ-পোষণ করেও আচার, আচরণ, কাজকর্মে পুরো আমেরিকান হয়েছিলেন। তাদের সন্তানরাও ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়শোনা করে সার্বিক দিক দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমেরিকান ড্রিমকে আয়ত্ত করেছেন। তাদের অনেকের পরবর্তী আমেরিকান প্রজন্ম পুরোপুরিই মিশে গেছে আমেরিকান জীবনধারায়। পিতা-মাতা বা দাদা-দাদির সংস্কৃতি নিজেরা ধারণ বা বহন করে পরবর্তী প্রজন্মকে দিতে পেরেছিল কি না, নাকি তা আমেরিকান ড্রিমের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে, সেটি একটি প্রশ্ন হিসেবেই রয়ে গেছে।
লেখক: বাংলাদেশি আমেরিকান আইনজীবীরকমারি