সন্দেহবশত কাউকে আটকের আইনগত ক্ষমতা পুলিশের রয়েছে। কিন্তু এর আগে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। কারো বিরুদ্ধে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে। শুধু ভিন্নমত দমনে সরকারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করা রাষ্ট্রীয় বাহিনী হিসেবে পুলিশের কাজ নয়। এখানে মনে রাখা আবশ্যক, সরকারের যৌক্তিক বিরোধিতা করা ও রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা এক নয়। সঙ্গত কারণে বলা যায়, পুলিশের এই গ্রেফতার সংবিধান ও দেশের আইন অনুসারে কতটুকু হয়েছে এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দেশে আইনের শাসন থাকলে এ ঘটনায় এসব পুলিশ সদস্যকে জবাবদিহি করতে হতো। এমনিতে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গতিবিধি জাতিসঙ্ঘ, মার্কিন প্রশাসন ও পশ্চিমা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নজরদারিতে রেখেছে। শুধু একশ্রেণীর অতি উৎসাহী পুলিশের কারণে বিশে^ আমাদের পুরো পুলিশ বাহিনীর সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে।
সুনাগরিক হিসেবে আমরা সবাই যেকোনো অপরাধীর শাস্তি চাই। কিন্তু নিরপরাধ ব্যক্তির এক দিনের জেলবাসও কাম্য নয়। রাজনৈতিক স্বার্থে অপরাধী হিসেবে ট্যাগ দেয়া দুঃখজনক। আইন বিশেষজ্ঞদের মতো আমরাও মনে করি, জামিন মঞ্জুর করে আদালত তার দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন ঘটনাটির একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া জরুরি। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা অতি উৎসাহী হয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন, নাকি ছাত্রদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কোনো বাস্তবতা রয়েছে?
দেশে ২০১৮ সালে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নামে ‘গায়েবি মামলা’ দেয়ার হিড়িক পড়ে। বিগত ১৫ বছর ধরে ভিন্নমত দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী; বিশেষ করে পুলিশকে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে সরকার। বিগত দেড় দশকে যখন তখন যে কাউকে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, রাষ্ট্রদ্রোহী ও সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগে গণহারে গ্রেফতার করা হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের কোনো জবাবদিহি করতে হয়নি। এখনো যে খুব একটা করতে হয় তা-ও নয়। সাম্প্রতিক সময়ে ফের গায়েবি মামলা ও জবাবদিহিহীন গ্রেফতারের প্রবণতা লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। এর সর্বশেষ নজির টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে যাওয়া একদল শিক্ষার্থীকে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের তকমা দিয়ে গ্রেফতারের ঘটনা। পরে হেফাজতে নিতে চাইলে আদালত পুলিশের আবেদন নাকচ করে তাদের জামিন মঞ্জুর করেন।
ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে যাওয়া বুয়েটেরসহ ৩৪ শিক্ষার্থীকে সরকারের বিরুদ্ধে ‘গোপন ষড়যন্ত্র ও জননিরাপত্তা বিঘিœত’ করার অভিযোগে আটক করা হয়। সোমবার সন্ত্রাসবিরোধী আইনে পুলিশ বাদি হয়ে তাহিরপুর থানায় একটি মামলা করে। ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে একই দিন বিকেলে তাদের আদালতে হাজির করা হয়। বিচারক ৩২ জনকে কারাগারে ও দু’জন কিশোর হওয়ায় তাদের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এক দিন পর ৩২ জনকে এবং গতকাল বাকি দুই কিশোরকে জামিন মঞ্জুর করেন আদালত।
গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, তাহিরপুর উপজেলা বাজারের নৌকাঘাট থেকে রোববার সকাল ৭টায় একটি নৌকায় বুয়েটসহ ৩৪ শিক্ষার্থী টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে যান। হাওরে ঘোরাঘুরির পর দুপুরে পাটলাই নদী দিয়ে টেকেরঘাট পর্যটন এলাকায় যাওয়ার পথে তাহিরপুরের নতুন বাজারের সামনে নৌকাটি পৌঁছায়। এ সময় পুলিশের দু’টি স্পিডবোট পর্যটকবাহী নৌকাটি থামিয়ে ৩৪ শিক্ষার্থীকে আটক করে। প্রশ্ন হলো- দেশের কোনো জায়গায় বেড়াতে যাওয়া কি অপরাধ? আমাদের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা আছে, আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত : আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। আশা করি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ দায়িত্ব পালনের সময় বিষয়টি সব সময় মনে রাখবে। তবেই নাগরিকরা নিরাপদ থাকবে। সরকার ও রাষ্ট্র যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে এমন মর্যাদাপূর্ণ বার্তা পাবে গণতান্ত্রিক বিশ্ব।