শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০৮ অপরাহ্ন

হিজরত: ঐশী নিরাপত্তায় মহানবী সা:-এর ভ্রমণ

ড. এ কে এম মাকসুদুল হক
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৩

মহানবী সা:-এর হিজরতের বছর থেকে হিজরি সন গণনা করা হচ্ছে। পৃথিবী বর্তমানে ১৪৪৫ হিজরি সনে পদার্পণ করেছে। ‘হিজরত’ বলতে সাধারণভাবে নবীজীর সা. মক্কা থেকে মদিনা চলে যাওয়ার ঘটনা বুঝে থাকি। কিন্তু সত্যিকারার্থে এই হিজরত ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের বর্তমান সভ্যতার সূচনা। হিজরত শুধু মক্কার কোরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ রাসূলুল্লাহ সা:-এর মদিনায় চলে যাওয়া নয়; বরং পৃথিবীতে কল্যাণরাষ্ট্রের সৃষ্টি, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ধারণা, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন জাতি মিলে রাষ্ট্র গঠনের একটি উপমা এবং সর্বোপরি মহান স্রষ্টার প্রতিনিধিত্বকারী একটি উম্মাহর সূচনা হয়েছিল এই হিজরতের মাধ্যমে। হিজরতের ঘটনা গভীরভাবে খেয়াল করলে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় যে, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই রাসূল সা:-কে ঐশী নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে মক্কা থেকে মদিনায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।
রাসূল সা:-কে ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে নবী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানানোর নির্দেশনা দেন। প্রথম তিন বছর রাসূলুল্লাহ সা: এক এক করে ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াত দিয়ে বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে একটি নিউক্লিয়াস বা কোর গ্রুপ তৈরি করে ফেলেন। তাদের মধ্যে মা খাদিজা রা:, আবু বকর রা:, আলী রা: প্রমুখ ছিলেন। এরপর নবীজীর সা: প্রতি সমাজে সাধারণ দাওয়াত দেয়ার নির্দেশনা আসে। তখনই শুরু হয় বিপত্তি। মক্কার কায়েমি স্বার্থবাদী কোরাইশ নেতারা রাসূলের সা. এই নতুন ধর্মের কারণে তাদের প্রতিষ্ঠিত সামাজিক নেতৃত্ব, অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব, বিচারিক স্বেচ্ছাচারিতা, আত্মসম্মানের অহমিকা আর জবাবদিহিহীন ভোগ-বিলাসী জীবনের অবসান দেখতে পায়। শুরু হয় প্রতিরোধ। নওমুসলিমদের তারা নির্যাতন করতে থাকে। কিন্তু ইতোমধ্যে মক্কার বাইরে মদিনাতেও ইসলামের আলো বিচ্ছুরিত হয়। সেখানে মুসলমানদের জন্য একটি সহানুভূতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তাই আল্লাহর নির্দেশে মক্কার কাফেরদের অত্যাচারে নিষ্পেষিত মুসলমানদের মদিনায় হিজরত করার পরামর্শ দেন রাসূলুল্লাহ সা:। ফলে এক এক করে প্রায় সব মুসলমান মদিনা পাড়ি জমান। মক্কায় শুধু রাসূল সা: এবং হজরত আবু বকর ও আলী রা: থেকে যান। আবু বকর রা: হিজরতের অনুমতি চাইলে রাসূল সা: তাকে নিজের সহযাত্রী হওয়ার ইঙ্গিত দেন। বুঝতে পেরেই আবু বকর রা: হিজরতের প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেন। এমন সন্ধিক্ষণে কাফেররা বুঝতে পারল, যেকোনো মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ সা: মদিনায় চলে যেতে পারেন। তারা মক্কায় তৎকালীন সংসদ ভবন ‘দারুন নদওয়া’তে অধিবেশন বা সমাবেশ ডাকে। এতে আলোচনায় তিনটি প্রস্তাব উঠে আসে- ১. মুহাম্মদ সা:-কে নির্বাসনে প্রেরণ করা; ২. কারারুদ্ধ করে রাখা এবং ৩. হত্যা করা। পরামর্শকের বেশধারী শয়তান হত্যা করাকেই কার্যকর করার পরামর্শ দেয়। চূড়ান্তভাবে আবু জেহেল সিদ্ধান্ত দেয়, সব গোত্র থেকে একজন করে যুবক একত্রিত হয়ে একযোগে আঘাত করে মুহাম্মদকে হত্যা করতে হবে, যেন মুহাম্মদের গোত্র এককভাবে এই হত্যাকা-ের প্রতিশোধ নিতে সাহস না পায়। পরিকল্পনা মোতাবেক সন্ত্রাসী জোট ধারালো অস্ত্র-শস্ত্রসহ রাসূল সা:-এর ঘর ঘেরাও করে রাখে যেন রাসূল সা: সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে আক্রমণ করে তাঁকে হত্যা করা যায়। এমন সময় সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূল সা:-কে হিজরতের জন্য বেরিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। রাসূলুল্লাহ সা: হজরত আলী রা:-কে ডেকে তাঁর কাছে গচ্ছিত থাকা মক্কার লোকদের অর্থকড়ি বুঝিয়ে দেন। তিনি আলী রা:-কে বিছানায় তাঁর কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে বলেন এবং তিন দিন পর সমস্ত গচ্ছিত অর্থকড়ি যার যার মালিককে বুঝিয়ে দিয়ে হিজরত করার নির্দেশ দেন। রাসূলুল্লাহ সা: ঘর থেকে বের হয়ে সূরা ইয়াসিনের প্রথম ৯টি আয়াত পাঠ করেন- ‘ইয়াসিন … আর আমি তাদের সামনে ও পেছনে দেয়াল সৃষ্টি করেছি যেন তারা দেখতে না পায়।’ (৩৬ : ১-৯) রাসূল সা: সেই আয়াতগুলো তিলাওয়াত করতে করতে এক মুষ্ঠি ধূলি নিয়ে দুষ্কৃতিকারীদের দিকে নিক্ষেপ করে তাদের মাঝখান দিয়ে নিরাপদে বেরিয়ে যান। একটু পরই ইবলিস এসে সন্ত্রাসীদের ধমক দিয়ে বলে, তোমরা দাঁড়িয়ে আছো, আর মুহাম্মদ তোমাদের মাথায় ধুলা নিক্ষেপ করে চলে গেছে। কিন্তু তারা ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল মুহাম্মদ সা: ঘুমিয়ে আছে; কাজেই তারা সকাল হওয়ার অপেক্ষায় রইল। সকালে আলী রা: বিছানা থেকে উঠে এলে তারা বুঝতে পারে সত্যিই শিকার হাতছাড়া হয়ে পড়েছে।
এদিকে রাসূলুল্লাহ সা: ঘর থেকে বের হয়ে প্রথমেই আবু বকর রা:-এর ঘরের দরজায় টোকা দেন। সাথে সাথে আবু বকর রা: দরজা খুলে দেন। দু’জনে কিছু খাবার নিয়ে এক সাথে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যান। তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরব সমাজে কেউ যাত্রার সময় কখনো পেছনের দরজা দিয়ে বের হতো না। কাজেই সবার অলক্ষ্যে তাঁরা রওনা করেন। এভাবে সাধারণের স্বাভাবিক নজরদারি এড়িয়ে রাসূল সা: মক্কার চার কিলোমিটার উত্তর-পূর্বদিকে সউর গিরি গুহায় পৌঁছেন। পথিমধ্যে আবু জেহেলের সামনে পড়লেও সে নবীজী সা:-কে দেখতে সক্ষম হয়নি। এদিকে সকাল হওয়ার সাথে সাথে পুরো মক্কায় হইচই পড়ে গেল! মুহাম্মদ সা: মক্কা ছেড়ে চলে গেছেন। চারদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেল। এ সময় আল্লাহ তায়ালা তাঁর মহান ঐশী নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে রাসূল সা:-এর পূর্ণ নিরাপত্তার বিধান করলেন। নবীজী সা: আবু বকর রা:সহ গুহায় প্রবেশ করার পর গুহার মুখে একটি আগাছা জন্মাল। সেখানে একটি বুনো কবুতর বাসা বেঁধে দু’টি ডিম পেড়ে রাখল এবং একটি মাকড়সা জাল বুনে রাখল পুরো গুহার মুখ বরাবর। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৩৮) কাজেই কোরাইশদের অনুসন্ধানী দল গুহা পর্যন্ত এসে এসব প্রাকৃতিক আগাছা, মাকড়সার জাল ও কবুতরের বাসা ও ডিম দেখে বুঝতে পারে এখানে কোনো মানুষ থাকতে পারে না। তিন দিন রাসূল সা: এই সউর গিরি গুহায় অবস্থান করেছিলেন। এই তিন দিন তিনজনের একটি ছোট্ট দল গোয়েন্দা তথ্য ও লজিস্টিক সাপোর্ট সরবরাহ করেছে। হজরত আবু বকর রা:-এর ছেলে হজরত আব্দুল্লাহ রা: সারাদিন মক্কায় ঘোরাফেরা করে তথ্য সংগ্রহ করে রাতে খাবার নিয়ে গুহামুখে যেতেন এবং সব খবর জানাতেন। আবু বকর রা:-এর কন্যা হজরত আসমা রা: দু’জনের জন্য খাবার প্রস্তুত করে দিতেন। আর কাজের লোক ফোকায়রা সকালে ছাগলের পাল নিয়ে বের হতো। এগুলো মাঠে চরিয়ে রাতে গুহায় পৌঁছে রাসূল সা: এবং আবু বকর রা:-কে তাজা দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করত এবং ফেরার সময় হজরত আব্দুল্লাহ রা:-এর গুহায় যাওয়া-আসার পথে ছাগল পাল চরিয়ে বালুতে আব্দুল্লাহর পায়ের ছাপগুলো মুছে ফেলতেন। ফলে কোরাইশ সরদাররা রাসূলুল্লাহ সা:-এর মক্কা থেকে বের হওয়ার পথ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তিন দিন যাবৎ খুঁজে ব্যর্থ হয়ে কোরাইশরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের আগ্রহে ভাটা পড়ে। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সা: এবং আবু বকর রা: গুহা থেকে বের হয়ে গাইডসহ মদিনার উদ্দেশে রওনা দেন। গাইড স্বাভাবিক রাস্তা বাদ দিয়ে সাধারণের অনাকাক্সিক্ষত একটি কঠিন রাস্তা দিয়ে মদিনার পথ ধরেন। পথিমধ্যে তাঁরা মেহমানদারির জন্য সুপরিচিতা উম্মু মাবাদ না¤œী এক বৃদ্ধার বাড়িতে যাত্রাবিরতি করেন। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৪২)
এদিকে মক্কার কোরাইশ সরদাররা হতাশ হয়ে মুহাম্মদ সা: এবং আবু বকর রা:-কে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরে আনার জন্য প্রতিজনের বিপরীতে ১০০ করে উট পুরস্কারের ঘোষণা দিলো। পুরস্কারের লোভে দুর্র্ধষ এক ঘোরসওয়ার সুরাকা ইবনে মালেক মুহাম্মদ সা:-এর সন্ধানে বের হয়ে পড়ে। দূর থেকে কাফেলা দেখে সে দ্রুত রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে আসার জন্য ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো। কিন্তু হঠাৎ ঘোড়ার সামনের দুই পা বালিতে দেবে যায়। সে একটু বিচলিত হলো বটে কিন্তু পুরস্কারের নেশায় পুনরায় ঘোড়া ছুটাল। কিছু দূর অগ্রসর হয়ে সুরাকা আবার ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ল। এবার সুরাকা সত্যিই ভীত হয়ে পড়ল। সে রাসূল সা:-এর নিকটবর্তী হয়ে রাসূলের কাছ থেকে একটি নিরাপত্তা ছাড়পত্র চাইল। সে বুঝতে পারল যে, ইনি সত্যিই আল্লাহর নবী এবং এই ছাড়পত্র একদিন তার কাজে লাগবে। ছাড়পত্র নিয়ে সুরাকা ফিরে এলো এবং পথিমধ্যে অন্যসব পুরস্কারলোভী অনুসন্ধানকারীদের বলল, খামাখা খুঁজে লাভ নেই এই রাস্তায় মুহাম্মদ যায়নি। এরপর পথিমধ্যে আবু আবদুল্লাহ বুরায়দার সাথে সাক্ষাৎ হয়। বুরায়দা ৭০ জন সহচরসহ কোরাইশদের পুরস্কারের নেশায় মোহাম্মদ সা:-কে ধরার জন্য খুঁজছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহর সা: সামনাসামনি হয়ে তাঁর সাথে কথা বলতেই বুরায়দার মনে বিস্ময়কর পরিবর্তন আসে। বুরায়দা তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করে এবং তার সাথে তার ৭০ জন সঙ্গীও ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর আবু বুরায়দা রা: নিজের পাগড়ি খুলে বর্শার মাথায় বেঁধে পতাকা বানিয়ে নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে রাসূল সা:-এর সাথে মদিনার দিকে চলতে থাকেন। (AR-RAHEEQ AL- MAKHTUM, 1996, P-174) এদিকে মদিনায় রাসূল সা:-এর আগমন উদযাপনের জন্য বিশাল হইচই পড়ে গেল। সবাই তাঁর অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুতি নিলো। দীর্ঘ ১৫ দিন পথ চলে রাসূল সা: মদিনার উপকণ্ঠ কুবায় পৌঁছেন। তিন দিন কুবায় অবস্থান করে পুনরায় যাত্রা শুরু করেন এবং বর্তমান যেখানে মসজিদে নববী অর্থাৎ বনু মালেক ইবনে বনু নাজ্জারের আবাস সেখানে পৌঁছে উট বসে পড়ে। নবীজী সা: সেখানেই নেমে গেলেন। এভাবে নবীজী সা: হিজরত সম্পন্ন করেন।
পরবর্তীতে ইসলামের দ্বিতীয় খালিফা হজরত ওমর রা:-এর কাছে একদিন একটি নথি এলো যাতে শুধু সাবান মাস উল্লেøখ ছিল। কিন্তু কোন বছর উল্লেখ না থাকায় ওমর রা: অসুবিধা অনুভব করলেন। আবার বসরার গভর্নর হজরত আবু মুসা আশআরি রা: খালিফাকে লিখে জানালেন, তারিখ ও বছর উল্লেখ না থাকায় দাফতরিক কাজকর্মে অসুবিধা হচ্ছে। খালিফা ওমর রা: তখন এ বিষয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করলে হজরত আলী রা: হিজরতের ঘটনার সময় থেকে নতুন বছর হিসেবের পরামর্শ দেন। চূড়ান্তভাবে হজরত ওমর রা: ১৬ হিজরির ১০ জমাদিউল উলা তারিখে সিদ্ধান্ত নেন, মহররম মাসকে প্রথম মাস ধরে হিজরতের ঘটনার সময় থেকে হিজরি সন গণনা করা হবে। সেই থেকেই হিজরি সন শুরু। পৃথিবীর ইতিহাসে হিজরত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ রহমতেই একজন মাত্র ব্যক্তি রাসূলকে মক্কাবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে হত্যা করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনো ক্ষতি করতে সমর্থ হয়নি। অন্যদিকে এই হিজরত পৃথিবীর ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করে দিয়েছে। এর ফলেই নির্যাতিত একজন মাত্র নিরীহ ব্যক্তির পক্ষে ইসলামের সুমহান বিজয় যুগের সূচনা করা সম্ভব হয়েছে। যার ফলে হিজরত পরবর্তী বিশ্ব আজ সভ্যতার আলোতে উদ্ভাসিত হতে পেরেছে। হিজরতের মাধ্যমেই রাসূলুল্লাহ সা: মদিনায় পৌঁছে পৃথিবীর জন্য একটি কল্যাণরাষ্ট্রের কাঠামোর ধারণা রেখে গেছেন। লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক Email: maksud2648@yahoo.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com