মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৯ পূর্বাহ্ন

দুনিয়া বিমুখতা

আবু বকর আরাফাত
  • আপডেট সময় শনিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

পৃথিবীতে একটি চিরন্তন সত্য হচ্ছে আমাদের জীবন অস্থায়ী। নিশ্চয়তাহীন বেঁচে থাকার ক্ষুদ্রতম সংগ্রাম। একটি নির্দিষ্ট সফরনামা পরিসমাপ্তির পর, পুনরায় গন্তব্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করাই মূলত আমাদের জীবন। অথচ মানুষ পার্থিব জীবনের সুখের উদ্দেশ্যে নানাবিধ অপরাধ ও ধর্মীয় বিধিবিধান লঙ্ঘন করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। ভোগ-বিলাসিতা আর অহঙ্কারের পাপিষ্ঠতায় জীবনের নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন করতে করতে আমরা আমাদের অস্থায়ী জীবন সমাপ্ত করছি। হাদিসের ভাবার্থ হলো- দুনিয়ার জীবনকে সংক্ষিপ্ত সফর হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আর এ সফরে মানুষের সর্বশেষ বাসস্থান হচ্ছে কবর। হজরত ইবনে উমর রা: বলেন, একবার রাসূল সা: আমার শরীরের একটি অংশ ধরে বললেন, ‘পৃথিবীতে মুসাফির বা পথিকের মতো জীবনযাপন করো। আর প্রতিনিয়ত নিজেকে কবরবাসী মনে করো’ (বুখারি-৬৪৯২)।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে’ (সূরা তাকাসুর)। যারা শুধু দুনিয়ার ভোগবিলাসিতাকেই জীবনের লক্ষ্য স্থির করেছে। এই সূরায় তাদের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। পুনরুত্থান দিবসে তাদেরকে জিজ্ঞাসার আওতায় আনা হবে। মূলত একটি সচ্ছল-শান্তিপূর্ণ জীবনের আকাক্সক্ষা করা শ্রেয়। কিন্তু এর মধ্যে অধিক পাওয়ার আশায় লোভের চাদরকে গুটিয়ে রাখা বাঞ্ছনীয়।
ইমাম গাজ্জালি রহ: দুনিয়ার দৃষ্টান্ত অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, এক লোক পথ চলছিল। একটি বাঘ তার পিছু নিলো, আশপাশে কোনো গাছ ছিল না যে, সে তাতে উঠে যাবে। ইত্যবসরে একটি কূপ তার নজরে পড়ল। লোকটি চিন্তা করল, আমি কূপে লাফিয়ে পড়ব। যখন বাঘ চলে যাবে, তখন আমি কূপ থেকে বেরিয়ে আসব। এই ভেবে লোকটি যখন কূপে লাফ দিতে গেল, তখন সে দেখল, কূপের পানির ওপর একটি সাপ সাঁতরাচ্ছে। এবার লোকটি উভয় সঙ্কটে পড়ল। পেছনে বাঘ আর নিচে কূপের মধ্যে সাপ। লোকটি আরো বিমর্ষ হয়ে চিন্তা করতে থাকল, এই মুহূর্তে আমার করণীয় কী? এ সময়ে কূপের দেয়ালের কিছু ঘাসের ওপর তার দৃষ্টি পড়ল। লোকটি চিন্তা করল, এই ঘাস আঁকড়ে ধরে যদি ঝুলে থাকি, তাহলে যখন বাঘ চলে যাবে। তখন আমি বেরিয়ে আসব। সত্যিই সে ঘাস ধরে ঝুলে পড়ল। পরে তার নজরে পড়ল, একটি কালো ইঁদুর আর একটি সাদা ইঁদুর, উভয় মিলে এই ঘাস কাটছে। যে ঘাস ধরে সে কূপের মধ্যে ঝুলে রয়েছে। এটি তার পেরেশানিকে আরো দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে দিলো। পেরেশান অবস্থায় যখন সে এদিক-ওদিক তাকাল তখন কাছেই মৌমাছির একটি চাক সে দেখতে পেল। মৌচাকে মৌমাছি না থাকলেও তা মধুতে ভরপুর ছিল।
এই মৌচাক দেখে তার মন চাইল, একটু দেখি তো তার মধু কেমন? লোকটি এক হাতে ঘাস আঁকড়ে ধরল আর অপর হাতের আঙুলে মধু নিয়ে যখন তার স্বাদ আস্বাদন করল, তখন স্বাদ বড়ই মজাদার বলে মনে হলো। যখন লোকটি মজা করে মধু চাটতে থাকল, তখন তার না বাঘের কথা মনে থাকল, না কাল নাগিনীর কথা মনে থাকল, না ইঁদুরের কথা মনে থাকল। এখন চিন্তা করুন, এই লোকের পরিণতি কেমন হবে?
এই দৃষ্টান্ত দেয়ার পর ইমাম রহ: বলেন, হে বন্ধু! তোমার দৃষ্টান্ত হলো ওই মানুষের মতো। মৃত্যুর ফেরেশতা বাঘের মতো তোমার পেছনে লেগে আছে। কবরের আজাব ওই সাপের আকৃতিতে তোমার আগমনের অপেক্ষায় আছে। কালো ও সাদা ইঁদুর হলো তোমার জীবনের দিন-রাত। ঘাস হলো তোমার জীবন, যা ইঁদুর কেটে ফিরছে। আর মৌচাক হলো, দুনিয়ার স্বাদ, যা হতে মজা লুটতে এবং উপভোগ করতে তুমি মগ্ন রয়েছ। আর এ চিন্তা ও স্মরণ নেই যে, তোমার পরিণাম কী হবে!
মূলত আমাদের জীবনকে আমরা এভাবেই সাজিয়ে তুলছি। ধন-সম্পদের পাহাড়কে আরো উঁচু করার চেষ্টা করছি। অথচ এই পাহাড়ধসের প্রবণতার ইতিহাস আমাদের অজানা। নিজেকে পরবর্তীর জন্য কতটুকু গড়ে তুলতে পারলাম। এটিই হচ্ছে ভাবার বিষয়। এ কারণে রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্য থেকে গরিব লোকেরা ধনীদের থেকে ৫০০ বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’
আর আখিরাতের একটি দিন ৭০ হাজার বছরের সমান। কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, ৫০ হাজার বছরের সমান। সাহাবায়ে কেরাম রা:-এর জীবনী উদঘাটন করলে জানা যায়। তাদের কী পরিমাণ দুনিয়ার প্রতি অনাশক্তি ছিল। হজরত ওমর রা:-এর অন্তরে আখিরাতের ফিকির, ওসমান রা:-এর দানশীলতা, হজরত আবু বকর রা:-এর বদান্যতাই প্রমাণ করে দুনিয়ার প্রতি তাদের কেমন আসক্তি ছিল। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘তাদের বলুন, দুনিয়ার জীবন এমন, যেমন আমি আসমান হতে পানি অবতীর্ণ করেছি’ (সূরা কাহফ-৪৫)।
অগ্নিপূজকের সন্তান ছিলেন হজরত সালমান ফারসি রা:। তিনি কয়েকজন ধর্মগুরুর হাত ঘুরে পরিশেষে মহানবী সা:-এর দরবারে উপস্থিত হলেন। নবীজী তাকে আসহাবে সুফফার দায়িত্বশীল বানান। নবীজী তাকে এত মহব্বত করতেন যে, একবার তার ব্যাপারে নবীজী বলেন, ‘সালমান আমার পরিবারের লোক। হিজরত পরবর্তী সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করার সময় হজরত সালমান ফারসিকে আবুদারদা রা: ভাই বানালেন। এই দুই ভাই একে অপরকে নিজেদের ইতিহাস শোনাতেন। হজরত আবুদারদা পরে বাইতুল মাকদিস চলে যান এবং সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। সেখান থেকে তিনি হজরত সালমান ফারসি রা:-এর উদ্দেশে একটি পত্র লিখে পাঠান- সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার, যিনি আমাকে পবিত্র ভূমিতে অবস্থানের তৌফিক দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা আমাকে ধন-সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততিও অনেক দিয়েছেন।
হজরত সালমান ফারসি পত্রটি পড়ে জবাবিপত্র লেখেন এভাবে- হে আবুদারদা! আপনি জেনে রাখুন,পবিত্র ভূমির কারণে মানুষ কখনো পবিত্র হয় না; বরং মানুষ পবিত্র হয় নেক আমল ও উত্তম চরিত্রের দ্বারা। আল্লাহ যদি আপনাকে এর পরিবর্তে উপকারী ইলম দান করতেন, সন্তান না দিয়ে নেক আমল করার তৌফিক দিতেন!
এ ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়, যে সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টি কিসের ওপর থাকত। তারা দুনিয়াবি ধন-সম্পদ ও বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করতেন না; বরং সর্বদা তাদের দৃষ্টি সর্বদা নিবদ্ধ থাকত একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সত্তার ওপর। যদি তাদের প্রচুর ধন-সম্পদও থাকত। তাহলে তারা এই ধন-সম্পদকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে মনে করতেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি এদের বিভিন্ন লোককে পরীক্ষা করার জন্য পার্থিব জগতের ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি। আপনি সে সব বস্তুর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন না, আপনার পালনকর্তার দেয়া রিজিক উৎকৃষ্ট ও অধিক স্থায়ী’ (সূরা ত্বহা-১৩১)।
দুনিয়াবিমুখতা মানে এই নয় যে, বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান সব কিছু পরিত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হওয়া; বরং আমাদের উচিত, শরিয়ত নির্ধারিত সীমানার প্রতি দৃষ্টি রেখে দুনিয়ার প্রতি বিমুখতা প্রদর্শন করা। লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া বসিলা, মোহাম্মদপুর, ঢাকা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com