রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৪৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
নেত্রকোনায় বোরো ফসলের বাম্পার ফলনে কৃষকদের মুখে হাঁসি উন্নয়ন করাই আমার একমাত্র মিশন ও ভিশন-মহিউদ্দিন মহারাজ, এমপি ফটিকছড়িতে এক বৈদ্যকে দা, দিয়ে কুপিয়ে হত্যা, অভিযুক্ত গ্রেফতার বোয়ালমারীতে ফসলের ক্ষতি করে চলছে ব্যাটারি প্রসেসিং ইন্ডাস্টি বরিশালে আল্লাহর রহমত কামনায় ইসতেসকার নামাজ আদায় জলঢাকায় পৌর উপ নির্বাচনকে ঘিরে স্থানীয় এমপির বিরুদ্ধে অপপ্রচারের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন বরিশালে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় চাপকলে উঠছে না পানি সাংবাদিক নাদিম হত্যাকারীরা জামিনে এসে পরিবারকে হুমকি দিচ্ছে, ১০ মাসেও আটক হয়নি মূল খুনি মাধবদীতে চাহিদা বেড়েছে তরমুজের, ক্রেতা কম ডাবের হাসপাতালে ডাক্তার উপস্থিত না থাকলেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে-স্বাস্থ্যমন্ত্রী

জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী

কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অব:)
  • আপডেট সময় শনিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

পয়লা সেপ্টেম্বর ছিল মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক (Commander in Chief), মহানায়ক বঙ্গবীর জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর ১০৫তম জন্মবার্ষিকী। কিন্তু আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি প্রায় ভুলতে বসেছি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এ মহানায়ককে। এ কারণেই হয়তো-Rudzard Kipling  লিখেছিলেন, God and soldier all men adore,
In times of danger and not before.
When danger is over and things are righted,
God is forgotten and poor soldier is slighted.
জেনারেল ওসমানীর ৬৬ বছরের (১ সেপ্টেম্বর ১৯১৮-১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪) জীবন ছিল এক মহাসাগরের মতো। সামরিক বাহিনীতে অনেকেই জেনারেল হন বা করা হয় বটে, কিন্তু মিলিটারি লিডার হতে পারেন না। জেনারেলরা যদি সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ বাহিনীর জেনারেলের তুলনায় বাস্তববাদী জাতীয়তাবোধসম্পন্ন দেশপ্রেমিক, প্রাজ্ঞ, দূরদর্শী, কৌশলী, তেজস্বী, যুদ্ধ ও সৈন্য পরিচালনায় সুদক্ষ সমরবিদ, শত্রুর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন এবং সর্বোপরি মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল না হন, তাহলে সে সব জেনারেল শুধু সামরিক বাহিনীর শোভাবর্ধনের কাজেই আসবেন।
আপৎকালীন সময়ে তাদের দিয়ে দেশের কোনো উপকার হবে না এবং দেশের স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের ওপর নির্ভরও করা যাবে না। কেননা, জেনারেলরাই নীতি প্রণয়ন, প্রয়োগ ও যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এমন সফল জেনারেল যুগে যুগে, দেশে দেশে ও বিভিন্ন জাতিতে অনেক ছিলেন বলেই সে সব দেশ ও জাতি বিশ্বের মধ্যে মাথা উঁচু করে টিকে আছে। যেমন- খালিদ-বিন-ওয়ালিদ, মুহাম্মদ বিন কাশেম, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি, নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, মির্জা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর, বৈরাম খাঁ, মানসিংহ, জেনারেল আইসেন হাওয়ার, ফিল্ড মার্শাল আরভিন রোমেল, জেনারেল হ্যান্স গুদেরিয়ান, জেনারেল দ্য গল, ফিল্ড মার্শাল উইলিয়াম যোসেফ স্লিম, ইরানি জেনারেল কাশেম সুলেইমানি প্রমুখ। আমরাও গর্ব করে বলতে পারি, আমাদেরও এমন একজন জেনারেল আছেন যিনি বাংলাদেশ ও বিশ্বের যুদ্ধাতিহাসকে আলোকিত করেছেন এবং নিজ দেশকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছিলেন, তিনি হলেন জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। দেশ স্বাধীন করতে হলে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও জাগরিত করার জন্য উঁচুমানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমন প্রয়োজন, তেমনই দখলদার আগ্রাসী বাহিনীকে পরাজিত করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় সামরিক বাহিনী ও এর নেতৃত্ব প্রদানের জন্য অভিজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান ও দুর্র্ধষ সামরিক নেতার। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও জাগরিত করার জন্য আমাদের ছিলেন কিংবদন্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; আর সামরিক নেতৃত্বের জন্য ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী, যিনি তার অসাধারণ মেধা, যোগ্যতা, নিখাঁদ দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, বাস্তবসম্মত কার্যকরী সমরকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে তুলনামূলকভাবে বহুগুণে শক্তিশালী শত্রু বাহিনীকে পরাস্ত করে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলাফল অনুকূলে নিয়ে আসেন, যা কল্পনাকেও হার মানায়।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বা কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে নিয়োগ: ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহকারী বাঙালি সামরিক অফিসাররা একত্রিত হয়ে সর্বজ্যেষ্ঠ সেনা অফিসার কর্নেল এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করার দীপ্ত শপথ গ্রহণ করেন। এ অনুষ্ঠানে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে বাংলাদেশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বা কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে নিয়োগ করার প্রস্তাব গৃহীত হয় ও অস্থায়ী সরকার গঠনপূর্বক তা বাস্তবায়ন করার জন্য সুপারিশ করা হয়। ১০ এপ্রিল সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হলে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুক্ত এলাকায় মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করে।
ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী, মুক্তিবাহিনীর সব কার্যক্রমকে সুসংগঠিত ও সমন্বিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য সার্বিক দায়িত্ব অর্পণ করা হয় কর্নেল (অব:) এম এ জি ওসমানীর ওপর এবং ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে তাকে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদাসহ বাংলাদেশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক (সিইনসি) নিযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এ সামরিক নেতা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ এবং অঙ্গীকারবদ্ধ। ওসমানী অবিলম্বে মুক্তিবাহিনীর সব উপাদানকে এক কমান্ডে আনার সিদ্ধান্ত নেন এবং অনুপ্রেরণাদায়ক নেতৃত্ব, চেতনা, দক্ষতা এবং সঙ্কল্পের সাথে তাদের অপারেশন পরিচালনা করেন। ওসমানী কার্যত বাংলাদেশের দ্য গল হয়েছিলেন এবং অত্যন্ত বিশ্বাসের সাথে তার কাজটি শুরু ও সফলতার সাথে সম্পন্ন করেছিলেন। আধ্যাত্মিক বিষয়: তিনি ছিলেন Born Military Leader. দেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেযার জন্যই যেন তার জন্ম হয়। ১৩০৩ সালে শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যের অত্যাচারী রাজা গৌড় গোবিন্দ বুরহান উদ্দীন নামক জনৈক প্রজার ছেলের জন্মোৎসব উপলক্ষে গরু জবাই করার কারণে তার শিশু ছেলেকে হত্যা করে। যার ফলে হজরত শাহজালাল যেমন সিলেটের মানুষকে অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন, একইভাবে তারই ৩৬০ সঙ্গীর অন্যতম একজন আউলিয়া সিলেটের দয়ামিরের হজরত শাহ নিজাম উদ্দিন ওসমানী রহ:-এর বংশধর জেনারেল ওসমানী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়নের হাত থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
৬. বিশ্বের ইতিহাসে বিরল সম্মান, গৌরব ও ঐতিহ্যের অধিকারী ব্যক্তিত্ব : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, প্রথম সেনাপ্রধান, প্রথম জেনারেল, বিশ্বের চার-চারটি বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও তিনটি দেশের সেনাবাহিনীতে চাকরি করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, অবসরকালীন সময়ে দেশের ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতা যুদ্ধে সশস্ত্রবাহিনীর নেতৃত্ব প্রদানকারী। তিনিই একমাত্র সামরিক অফিসার যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ১৯৬৭ সালে অবসর গ্রহণ করার চার বছর এক মাস ২৪ দিন পর পুনরায় সামরিক পোশাক পরিধান করে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দেন, যা বিশ্বে এক বিরল উদাহরণ। তার দুঃসাহসী ও অনবদ্য নেতৃত্বে বিশাল শক্তিশালী হানাদার বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে তাকে জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সম্মানীত করেন। একটি অসম যুদ্ধে দেশ ও পৃথিবীর ইতিহাসে সমৃদ্ধশালী ও অত্যধিক সম্মানজনক বিরল এ অবস্থানের অধিকারী হলেন জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী।
সে সময়ে যদি ওসমানীর মতো কালজয়ী তীক্ষ্ণ মেধাবী, প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ, দক্ষ, বিচক্ষণ, তিনটি যুদ্ধের বিরল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, চতুর্মুখী গুণাবলির অধিকারী সর্বজনগ্রাহ্য সিনিয়র সামরিক নেতা দৃশ্যপটে না আসতেন তাহলে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে এ যুদ্ধের কী শোচনীয় অবস্থা হতে পারতো ভাবা যায় না। জেনারেল ওসমানী তার বলিষ্ঠ, সুদক্ষ নেতৃত্ব ও যুদ্ধ কৌশল প্রয়োগ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছেন, বহু প্রত্যাশিত নতুন একটি দেশ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রেখেছেন। ইতিহাস সৃষ্টিকারী দূরদর্শী চিন্তা-চেতনার অধিকারী অসাধারণ প্রতিভাবান কালজয়ী পুরুষ ওসমানীদের বারবার জন্ম হয় না। দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে ধূমকেতুর মতো এদের আবির্ভাব হয়। জাতির মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধ থাকলে তারা এ বীর পুরুষকে সম্মান করে। আর তা না হলে কালচক্রে এরা হারিয়ে যায়।
চিরকুমার জেনারেল ওসমানী তার সারাটা জীবন কাটিয়েছেন এ দেশের মাটি ও মানুষের মুক্তির জন্য, উন্নতির জন্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। উৎসর্গ করেছেন তার জীবন-যৌবন, সহায়-সম্পত্তি ও সব কিছু। অবহেলিত বাঙালি মুসলমানদের ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রবেশের জন্য তিনি সব প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন এবং এর সফলতাও অর্জন করেছেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করার পথকে উন্মুক্ত করে এবং ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার পর একে একে এ রেজিমেন্ট সমৃদ্ধ হতে থাকে, যা স্বাধীনতা যুদ্ধে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তিনি কখনো পিছু হটেননি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ, অস্ত্রমুক্ত শিক্ষাঙ্গন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে যত দিন টিকে থাকবে বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী বেঁচে থাকবেন, স্মরণীয়, বরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে এ দেশের মাটি ও মানুষের মনের মণিকোঠায় মুক্তির সুউজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে।
লেখক : সামরিক ইতিহাসবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
e-mail: hoque2515@gmail.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com