রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০১:৫০ অপরাহ্ন

প্রথাগত বয়ান ও বাংলা পীর-সাহিত্য

শহিদুল হাসান
  • আপডেট সময় শনিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

হজরত মোহাম্মদ (স.) মানবতাবাদের ব্যাখ্যা দিয়েছেন আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগে। সুফি বা পীর-দরবেশরা এ মানবতার আদর্শকে বাস্তবায়নের জন্য ভৌগোলিক সীমা পেরিয়ে যেখানে মানবতার পতন ঘটেছে, সেখানে হাজির হয়ে জীবনপণ সংগ্রামে রত হয়েছেন। সমগ্র মানবজাতির অগ্রগতিতেসুফি বা পীর-দরবেশদের প্রয়োজনীয়তা এখনো নিঃশেষ হয়নি। সুতরাং সুফি বা পীর-দরবেশদের জীবনসংবলিত সাহিত্যের ইতিহাস কোনো সাম্প্রদায়িক ব্যাপার নয় বরং তা হচ্ছে গোটা মানবজাতির ইতিহাস ও আদর্শ। প্রায় ছয় দশক আগে প্রকাশিত গিরীন্দ্রনাথ দাসের বাংলা পীর-সাহিত্যের কথা গ্রন্থের প্রকাশকের নিবেদন শিরোনামে কাজি আবদুল ওদুদ উপর্যুক্ত কথাগুলো লিখেছিলেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে নানা বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক স্রোতের সংমিশ্রণ ও সংযোজন প্রক্রিয়ায় এ উপমহাদেশে সুফিবাদের আগমন ও বিস্তার ঘটে। আব্বাসীয় আমলে বাগদাদ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় আরব-আফ্রিকীয়-ইউরোপীয় এবং ভারতীয় জ্ঞান-ভাবনার সংমিশ্রণে সুফিবাদের আদিরূপের সহযোগী হয় বহু ধারণা-ভাবনা-অনুশীলন। কালক্রমে এটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে। সৃষ্টি হয় নানা তরিকা এবং তরিকার মাঝে নানা ভাবনার বৈচিত্র্য। সিলসিলায় যুক্ত হতে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক জ্ঞান কাঠামোয় পশ্চিম এশিয়া ও ভারতীয় সুফিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির প-িতরা। কালক্রমে ভারতীয় এবং বিশ শতকের মাঝামাঝি কালপর্ব থেকে মার্কিন মুলুকের ইতিহাসবিদ-সমাজবিজ্ঞানী-নৃবিজ্ঞানী ও ধর্মতাত্ত্বিকদের গবেষণায় উঠে আসে সুফিবাদের অজানা-রহস্যময়-নিগূঢ় তথ্যাদি।
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে ভারতবর্ষে সুফিরা আগমন করেন এবং ধর্মপ্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। ভারতের ধর্মচর্চা বা সামাজিক ইতিহাসের বহুল চর্চিত বিষয়ের মধ্যে সুফিবাদ থাকলেও এসব আলোচনার কেন্দ্রে এবং বহুলাংশে রয়েছে সুফি-পুরুষরা। সমাজ ইতিহাসের অন্যান্য ধারার মতোই সুফি ইতিহাস চর্চায় নারীর উপস্থিতি অত্যন্ত নীরব; প্রায় নেই বললেই চলে। যতটুকু রয়েছে তাতেও নারী সুফি সাধককে দেখানো হয়েছে পুরুষ সুফির অনুসারী বা আত্মীয় হিসেবে। এক্ষেত্রে মোগল সুবাহ বাঙ্গালার রাজধানী জাহাঙ্গীরনগরের (বর্তমান ঢাকা শহরের নীলক্ষেত এলাকার) সুফি মরিয়ম সালেহার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। নাজির হোসেন কিংবদন্তির ঢাকা গ্রন্থে এ মহীয়সীর পরিচয় দিতে গিয়ে লেখেন:
১১১৮ হিজরিতে মোসাম্মৎ মরিয়ম বাবুপুরায় [বর্তমানে নীলক্ষেত এলাকায় বইয়ের মার্কেটের পেছনে] তিন. গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদের পেছনে তার কবর রয়েছে। তিনি মগবাজারের শাহ সাহেব নূরীর বোন ছিলেন। বাদশা আলমগীরের আমলে বাবুপুরা অঞ্চলটি খুব জনবহুল ছিল। বাবুপুরার মসজিদের দক্ষিণে শেখ আবদুল্লাহ ও হজরত শেখ গোলাম মুহম্মদের মাজার রয়েছে। শেখ গোলাম মুহাম্মদ শাহ নূরীর দাদা ছিলেন। (পৃষ্ঠা: ২৭২) সুফিবাদের আদি ইতিহাস কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। সুফি তাপসী রাবেয়া বসরি ছিলেন হিজরি দ্বিতীয় শতকের অত্যন্ত প্রভাবশালী সুফি সাধক।
রাবেয়া বসরির অনুসরণে পরবর্তী সময়ে অসংখ্য মহীয়সী সুফির নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। এ তালিকায় রয়েছেন স্পেনের মেরচানার সামস, কর্ডোভার ফাতিমা, দামেস্কের হালিমা, রাবেয়া বিনতে ইসমাইল, লুবাবা প্রমুখ। এভাবে নারীরা সুফি তরিকায় নিজেদের স্থান করে নিয়েছিলেন। ভারতীয় সুফিবাদের ইতিহাসেও তাদের স্থান ছিল। যদিও অনেকটা আড়ালে রয়ে গেছে তাদের উপস্থিতি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে হজরত বিবি জোলায়খা (শেখ নিজামউদ্দিনের মাতা), হজরত বিবি ফাতিমা শাম (হজরত বাবা ফরিদের দত্তক বোন), বিবি রওশন আরা (পীর সৈয়দ আব্বাস আলির বোন) প্রমুখের নাম। সুফিবাদের ইতিহাসে সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং বিশাল ইতিহাস সত্ত্বেও উপর্যুক্ত সংক্ষিপ্ত পাটাতনে ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে, বিশেষত বাংলায় সুফিবাদে নারীর উপস্থিতির সুলুক খোঁজার চেষ্টা করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত স্বীকার্য, পূববর্তী গবেষকদের ভাবনার রোশনাই বর্তমান লেখকের অন্ধকারের আলো।
বাংলায় সুফিবাদের আকরসূত্রাদির মধ্যে সুফিসাহিত্যের (সিরাত, মালফুজাত ও মাকতুবাত) পাশাপাশি সুফি খানকাহ ও তৎসংশ্লিষ্ট শিলালেখগুলোকেই আকরসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মান্যবর এনামুল হকHistory Of Sufi-ism in Bengal (১৯৭৫ সালে প্রকশিত) গ্রন্থে এ ধরনের সূত্রাদির সঙ্গে স্থানীয় কিংবদন্তি, লোকগাথা এবং কখনো কখনো বাংলা সাহিত্যকে ব্যবহার করে বাংলা অঞ্চলের সুফিবাদের আদ্যোপান্ত নথিভুক্ত করেছেন। এ গ্রন্থে উল্লিখিত খ্রিস্টীয় সহস্রাব্দ থেকে আঠারো শতক কালপর্বের ইতিহাসে পাবনা জেলার একটি বিশেষ ধরনের আস্তানার উল্লেখ করা হয়েছে। পাবনা জেলার গ্রামীণ অশিক্ষিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনৈক মহিলা পীরের আস্তানাকেন্দ্রিক মহররমসংক্রান্ত কিছু রীতি প্রচলিত রয়েছে। এনামুল হকের ভাষায়: One and half mile west of the town of Pabna, there is a famous dargah Known as the Maynamati or Nayanamatir Pirenir Astana. The gurdian of this Astanah is always a pious female who is called Pireni or Pirani. This ÔAstanahÕ is the most active center of Muharram celebration in the district, and the Pireni is the undisputed authority over all Gahwarah Parties organised in the town. (Page 342).
এনামুল হক ঘটনাটিকে সুফিবাদের আদিরূপের অংশ হিসেবে মানতে নারাজ ছিলেন। বাংলার বিভিন্ন আনাচে-কানাচে পীর-দরবেশদের দরগা ও আস্তানাসংক্রান্ত স্থানীয় অনেক রীতিই তিনি সুফিবাদের ইতিহাসের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেননি। বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারাবাহিকতায় সতেরো-আঠারো শতকে ইসলামের সাধক বা ধর্ম প্রচারক হিসেবে পীরদের কেন্দ্র করে বিশেষ একটি ধারার বিকাশ দেখা যায়। গিরীন্দ্রনাথ দাস প্রকাশিত বাংলা পীর সাহিত্য কথা (১৯৭৫) গ্রন্থে বাংলা ভাষায় রচিত পীর-দরবেশ-সুফিকেন্দ্রিক সাহিত্যের প্রামাণ্য প্রতিবেদন সংকলিত হয়েছে। এ গ্রন্থে উপস্থাপিত ঐতিহাসিক পীরদের তালিকায় সাতজন মহীয়সীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তারা হলেন ১. চম্পাবতী, ২. ফাতেমা বিবি, ৩. রওশন বিবি, ৪. ওলা বিবি, ৫. খুঁড়ি বিবি, ৬. বনবিবি ও ৭. বিবি বরকত। তালিকায় থাকা ওলা বিবি, বনবিবি, খুঁড়ি বিবি ও চম্পাবতীকে হয়তো অনেকেই তরিকার সুফি হিসেবে মানতে রাজি হবেন না। বর্তমান লেখক সে রকম কোনো প্রস্তাবও করছেন না। প্রায় পাঁচ দশক আগের এ গবেষণাকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা যেতেই পারে। তবে হালফিলের গবেষক টনি কে স্টুয়ার্ট তার Witness To Marvels Sufism and Literary Imagination গ্রন্থে বাংলা পীর-সাহিত্যকে বিশ্লেষণ করেছেন। সুফি সাহিত্যের কাঠামোর বিপরীত প্রান্তে থাকা পীর-সাহিত্যের কল্পনাজগৎ ও বাস্তবতার নানারূপ এ গবেষণায় উঠে এসেছে। উল্লেখ্য, মানিক পীরের জহুরানামা, মুহাম্মদ খাতেরের বনবিবি জহুরানামা এবং আবদুর রহিমের গাজী কালু ও চম্পাবতী কন্যার পুঁথি-র কাহিনি উপস্থাপন ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে টনি কে স্টুয়ার্টের মুনসিয়ানা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। গ্রন্থটিতে এতৎসংক্রান্ত অংশগুলোয় ‘?পীরানি’ তথা মরমি সাধক ও ক্যারিশমার অধিকারী নারীর উপস্থিতি অত্যন্ত সরব।
গিরীন্দ্রনাথ দাস নিজের উপস্থাপিত তালিকায় থাকা বিবি বরকতের পরিচয়ে কোনো বিশেষ তথ্য পাননি। তিনি এটিকে একটি কাল্পনিক চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করেন। তবে এ পীরানির দরগায় স্থানীয় মানুষের নিবেদনের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে গিরীন্দ্রনাথ লেখেন: পীরানি বরকত বিবির নামে বসিরহাট মহকুমায় হিঙ্গলগঞ্জ থানার অন্তর্গত কাটাখালী নামক গ্রামে একটি কাল্পনিক দরগাহ আছে। দরগাহ স্থানটির পরিমাণ আনুমানিক এক কাঠা। সেখানে আছে শুধু ঝোপ, অর্থাৎ পতিত জমি। দরগাহের সেবায়েত ছিলেন মরহুম আব্বাস আলি গাজী। তারা ওই দরগাহে সকাল সন্ধ্যায় ধুপ-বাতি দান করতেন। বর্তমানে স্থানীয় বহু ভক্ত সেখানে দুধ, বাতাসা, ফল প্রভৃতি মানত দিয়ে থাকেন। (পৃষ্ঠা ৪১৯) বিবি বরকত লোকমুখে ‘?মা বরকত’ হিসেবে বহুল প্রচলিত ছিলেন। মুহাম্মদ আলিমুদ্দিন রচিত মা বরকতের মেজমানি পুঁথিটিতে কাব্যাকারে লেখা এবং নানা রকম অলৌকিক ক্ষমতার বর্ণনা পাওয়া যায়। কবির ছন্দ ও সাহিত্যরসের পাশাপাশি মা বরকতের কারামাত এ কাব্যের পাঠক ও শ্রোতা সমাজের কল্পনা জগতে সৃষ্টি করে তোলে একজন পীরানির লৌকিক অবয়ব।
বারাসাতের খড়িগাছি মৌজার সহরা গ্রামে আরেকজন পীরানি হজরত ফাতেমা যোহরার অনুরূপ একটি কাল্পনিক দরগা রয়েছে। তিনি ওই অঞ্চলে বিবি ফাতেমা নামেই সুপরিচিত। মাঠগ্রাম, বেরুনান পুখুরিয়া, মালিকাপুর, পশ্চিম ইছাপুর, ঘোলা, সোনাখড়কি, খড়িগাচি-সহরা ইত্যাদি মৌজায় এ সুফির দরগার লাখেরাজ (করমুক্ত দেবোত্তর জমির অনুরূপ) সম্পত্তি রয়েছে। দরগার বর্ণনা গিরীন্দ্রনাথের ভাষায়: হজরত ফাতেমা যোহরার … প্রতি ভক্তিতে স্থানীয় ভক্তরা সহরা গ্রামে যে দরগাহ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। তার ওপর অশ্বত্থ গাছ হয়েছে। সেখানে আজও প্রতি সন্ধ্যায় নিয়মিত ধূপবাতি জ্বালিয়ে জিয়ারত করা হয়। … মহররমের সময় স্থানীয় ভক্তদের এক বিরাট শোভাযাত্রা এ দরগাহে এসে হজরত ফাতেমার উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। … তখন এখানে লাঠি খেলা বা অনুরূপ ক্রীড়ানুষ্ঠান হয়। … অনেক ভক্ত এ দরগাহে মাঝে মাঝে হাজত, শিরনি ও মানত দিয়ে থাকেন। অনেকে রোগ নিরাময়ের আশায় এ দরগাহের মাটি ব্যবহার করেন। অনেকে তেল রেখে বিবি ফাতেমা কর্তৃক মন্ত্রপূত হয়েছে এ বিশ্বাসে নিয়ে গিয়ে ব্যবহার করে রোগমুক্ত হন। এ দরগাহের পীরোত্তর জমির পরিমাণ এখনো প্রায় পাঁচ কাঠা। (পৃষ্ঠা ২০৫-০৬) বারাসাতের সহরা গ্রামের এ দরগার সেবিকা ছিলেন ‘?মোসাম্মেৎ শুকজান বিবি’। রাসুল মুহাম্মদ (স.)-এর দুহিতা হজরত ফাতেমাকেই (র.) যেন বারাসাতে সুফি-পীর হিসেবে স্থানীয় জনগণ মান্য করছে। তার খানকাহ বা দরগা (কল্পিত) রক্ষণাবেক্ষণ করেন যিনি, তিনিও নারী।
গিরীন্দ্রনাথ দাস বাংলা ভাষায় পিরানি হজরত ফাতেমা যোহরার নামে লিখিত সাতটি পুঁথির নাম উল্লেখ করেছেন: (১) মোহাম্মদ রিয়াজুদ্দীন আহম্মদ রচিত হজরত ফাতেমা যোহরার জীবন চরিত, (২) মনীরউদ্দীন ইউসুফ রচিত হজরত ফাতেমা, ৩. শেখতনু বিরচিত ফাতেমার সুরত নামা, ৪. শেখ সেরবাজ চৌধুরীর ফাতেমার সুরত নামা, ৫. আজমতুল্লাহ খন্দকারের ফাতেমার জহুরা নামা, ৬. কাজী বদিউদ্দীন রচিত ফাতেমার সুরত নামা ও ৭. বিবি ফাতেমার বিবাহ (লেখক অজ্ঞাত)। তালিকার প্রথম দুটি পুঁথির প্রকাশক যথাক্রমে মদীনা বুক ডিপো ও ওসমানিয়া লাইব্রেরি। দোভাষী পুঁথির রসমে প্রকাশিত এ দুটি পুঁথিতেই রাসুল মুহাম্মদ (স.)-এর কন্যা হজরত ফাতেমার সিরাত বাংলা গদ্যে পাঠকের দরবারে উপস্থান করা হয়েছে। আরবি-ফারসি শব্দের বহুল ব্যবহার এবং পীর-পয়গম্বরের নামের শেষে বারংবার সম্মানসূচক শব্দের সংযুক্তিই নির্দেশ করে যে এগুলো ছিল ধর্মীয় সাহিত্যের অংশ।
বর্তমান লেখক সাম্প্রতিক সময়ে কবি শেরবাজ খানের ফাতেমার সুরতনামা-এর পাঠ সম্পাদনা করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পা-ুলিপি শাখায় কাব্যগ্রন্থটির পাঁচটি অনুলিপি পুঁথি রয়েছে। বাংলা একাডেমির সংগ্রহশালায় রয়েছে অনুরূপ কয়েকটি বকলমি (হাতে অনুলিপিকৃত) পুঁথি)।
কবি শেরবাজের ফাতেমার সুরতনামা কাব্যটি পূর্বোক্ত জীবনী গ্রন্থের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রমী। কাহিনীর মূল উপজীব্য সাহাবা আলি (রা.) নিজ স্ত্রী ফাতেমার (রা.) সুরত রূপ দেখেননি। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এ সুরত বাতেনী (গোপন) বা ইলমে মারেফত এবং রোজ হাশরেই কেবল তা যাহের (প্রকাশ) হবে। আবুবকর (রা.)-এর কাছ থেকে এ সংবাদ পেয়ে আলী (রা.) কিছুটা অবাক ও কিছুটা অভিমানে বাড়িতে ফিরে ফাতেমার (রা.) কাছে তার সুরত দেখার জোর আবদার করতে থাকেন। রাগে-অভিমানে হজরত আলি তিনদিন খাদ্য-পানি গ্রহণে বিরত থাকেন। অবশেষে ফাতেমা (রা.) রাজি হন নিজের সুরত দেখাতে; স্বামী আলিকে (রা.) অনুরোধ করেন অরণ্যে মৃগয়ায় যেতে। সেখানেই হবে রূপ দর্শন। কাব্যটির কাহিনীর পথচলা আর আলির (রা.) শিকারযাত্রা সামন্তরালে চলতে থাকে। ফাতেমার (রা.) কথা মতো হজরত আলি (রা.) শিকারের উদ্দেশ্যে বনে গেলেন। সেখানে গিয়ে আলি (রা.) নানা রকম দৃশ্য-ঘটনা-অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। বৈচিত্র্যময় রহস্যাবৃত ঘটনাগুলো আলির (রা.) কাছে বোধগম্য ছিল না। দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকটি ঘটনা নিচে দেয়া হলো:
১. প্রখর সূর্যের তাপে আলি (রা.) বনের রাস্তায় এগিয়ে চলেছেন। চলার পথে প্রথমেই তিনি একটি মাঠের মধ্যে একটি বৃক্ষের তলে সেজদারত একজন ফকিরকে দেখলেন। এ ফকিরের হাত দুটি বাঁধা এবং চোখ বেয়ে অশ্রু নিঃসরণ হচ্ছে। এটি দেখে আলি (রা.) হায় হায় করতে লাগলেন। ফকিরের পাশে দাঁড়ানো ছিল দুজন বালকসহ এক নারী। নারী উচ্চৈঃস্বরে বাবা বাবা বলে ডাকতেছেন।
২. আলি (রা.) আরেকটু সামনে যেয়ে দেখেন আগুনের মাঝখানে একজন ফকির উম্মত উম্মত বলে উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করছেন। আগুনে ফকিরের মগজ এমনভাবে ফুটছে, যেমনভাবে হাড়ির মধ্যে সেদ্ধ হয় চাল। ফকিরের মাথার খুলি ফেটে মগজ বের হচ্ছে। তা সত্ত্বেও তিনি উম্মত উম্মত বলে কাঁদছেন।
৩. জঙ্গলের কিনারায় আলি (রা.) দেখেন একজন কাঙালিনী রুটি তৈরি করছেন। আলি (রা.) তাকে প্রশ্ন করেন তুমি কে? কার স্ত্রী তুমি? জঙ্গলে বসে কার জন্য রুটি বানাচ্ছ? উত্তরে কাঙলিনি বলেন: আমার একজন নিরঞ্জন আছেন। এ রুটিগুলো তার জন্যই বানাচ্ছি। আলি কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করেই বলেনÍকি পাগলের মতো কথা বলছো? সংসারে নিরঞ্জন একজনই। তোমার নিরঞ্জন কে? উত্তর ছিল তিনি আমার নিজের নিরঞ্জন।
৪. বনের মাঝে আলি (রা.) একটি ময়না পাখির পেছনে তাড়া করে একটি মসজিদের দরজায় উপস্থিত হন। সেখানে খাটুলির ওপর জনৈক বৃদ্ধা নারী শয়নরত ছিলেন। আলি (রা.) বৃদ্ধাকে দরজা থেকে সরে যেতে অনুরোধ করেন। উত্তরে বৃদ্ধা বলেনÍতার নড়ার শক্তি নেই। আলি যেন তাকে একপাশে রেখে মসজিদের ভেতরে গিয়ে ময়না পাখিটিকে খোঁজেন। আলি (রা.) প্রথম চেষ্টায় খাটটি সরাতে ব্যর্থ হন। রাগে-ক্রোধে সর্বশক্তি দিয়ে খাটুলি টান দিলেও তা নড়ে না। বৃদ্ধা কিছুটা কৌতুকের ছলে আলিকে (রা.) বলেন:
সংসারে লোকে বলে মহাবলী তুমি
তুমার মরদামী যত বুঝে পাইলাম আমি।
(ফোলিও ১৩, শেরবাজ খান বিরচিত ফাতেমার সুরত নামা।)
এভাবে নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে হজরত আলি নিজ গৃহে ফিরে আসেন। অরণ্যের ঘটনাবলি হজরত ফাতেমাকে (রা.) বর্ণনা করেন। সুফি খানকার প্রথার মতোই আলিকে (রা.) এ অভিজ্ঞতাগুলোর ব্যাখ্যা দেন বিবি ফাতেমা (রা.)। এখানে রাসুল দুহিতা পালন করছেন পীর-সুফি-উস্তাদের ভূমিকা। শিষ্য বা মুরিদ আলি (রা.)। ইলমে মারেফতের নানা ব্যাখ্যায় দীক্ষিত হচ্ছেন তিনি। কবি শেরবাজ খানের চরিত্র রূপায়ণে ইতিহাসে উপেক্ষিত পিরানি সবল ও কর্তৃত্বপরায়ণ; সেখানে শিষ্য স্বয়ং সাহাবি আলি (রা.)। ‘বাতিনী’ ইলমের যাহেরি ব্যাখ্যার পর্বটুকু তোলা রেখেই সমাপ্তি টানছি। আগ্রহি পাঠকের জন্য আমন্ত্রণ রইল অনলাইনে থাকা পিডিএফ বা পুস্তকাকারে প্রকাশিত ফাতেমার সুরতনামা: শেরবাজ খান: পাঠোদ্ধার ও সম্পাদনা পুস্তিকা অধ্যয়নের।
সহায়ক গ্রন্থাবলি: ১. অমিত দে, উপমহাদেশে সুফিবাদ চর্চার গতি প্রকতি, আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ স্মারক বক্তৃতা ২০২৩, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, ঢাকা, ২৪ আগস্ট ২০২৩। ২. অমিত দে, ‘?সুফি সিলসিলাহ’ আবদুল মমিন চৌধুরী (সম্পাদিত), বাংলাদেশের ইতিহাস সুলতানি ও মোগল আমল (আনু. ১২০০-১৮০০ সা. অব্দ), এশিয়াটিক সোসাইটি, ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, পৃষ্ঠা ২৯১-৩০৪। ৩. তাহমিদাল জামি, স্থানীয় সুফিবাদ, আবদুল মমিন চৌধুরী (সম্পাদিত), বাংলাদেশের ইতিহাস সুলতানি ও মোগল আলম (দ্বিতীয় খ-), ঢাকা ২০২০, পৃষ্ঠা ৩০৫-৩৩৪। ৪. নাজির হোসেন, কিংবদন্তির ঢাকা, ঢাকা, এপ্রিল ১৯৯৫ (তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ)। ৫. ড. মুহম্মদ এনামুল হক, বঙ্গে সুফি প্রভাব, ঢাকা: র?্যামেন পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০০৬ (চতুর্থ পুনর্মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। ৬. অধ্যাপক আবদুল মালেক নূরী, সুফিবাদ, ঢাকা: অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ফেব্রুয়ারি ২০০৪ (চতুর্থ মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১৩) ৭. Prof. Muhammad Enamul Haq, A History of Sufi-ism in Bengal, Dhaka: Asiatic Socity of Bangladesh, 1975. 8. ডক্টর গিরীন্দ্রনাথ দাস, বাংলা পীর-সাহিত্যের কথা, শেহিদ লাইব্রেরি, কাজীপাড়া, বারাসাত, চব্বিশ পরগনা, ১৯৭৬। 9. Tony K. Stewart, Witness to Marvels Sufism and Literary Imagination, California: University of California Press, 2019. ১০. শহিদুল হাসান, ফাতেমার সুরতনামা শেরবাজখান পাঠোদ্ধার ও সম্পাদনা, ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, ২০২০। লেখক: শহিদুল হাসান: সহযোগী অধ্যাপক,ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com