ত্রিশোর্ধ রোজিনা বেগম। বউ হয়ে এসেছেন ১৮ বছর হয়। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। শ^শুর-শ^াশুরী গত হয়েছেন প্রায় একযুগ। শুরুর দিকে সংসারের কাজকর্ম খুব বেশি একটা করতে না পারলেও শ^াশুরীই ছিলেন ভরসা। নিজের মেয়ের মত হাতে ধরে ধরে সকল কাজ শিখিয়েছেন। এখন তাকে একজন সুগৃহিনীই বলা চলে। একাই সব কিছু সামাল দেন। তবে এত কিছুর পরও যে কোন আয়োজনে তৈরি করতে ভুলেন না ঐতিহ্যবাহী নকশি পিঠা। মা এবং শ^াশুরীর কাছ থেকে নকশি পিঠার তালিম নেওয়া গৃহবধু রোজিনা এখন তার মেয়ে রাফিয়াকেও দিচ্ছেন পিঠা তৈরির তালিম। নকশী পিঠা তৈরি নিয়ে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ পৌর এলাকার ভাদার্ত্তী গ্রামের গৃহবধু রোজিনার সাথে। তিনি বলেন, আমি যখন বাবার বাড়ি ছিলাম, তখন অনেক ছোট। মাকে দেখেছি নকশী পিঠা বানাতে। মায়ের কাছেই আমি এবং আমার বোনেরা নকশী পিঠা বানানো শিখেছি। বিয়ের পর যখন শ^শুর বাড়ীতে আসলাম, তখন শ^াশুরী ও ননদকে দেখেছি নকশী পিঠা বানাতে। এখন আমিও বানাচ্ছি। আমার কাছ থেকে আমার মেয়েও শিখছে। এভাবেই নকশী পিঠা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে যাবে। আর টিকে থাকবে বাংলা ও বাঙ্গালীর ঐতিহ্য। মায়ের কাছ থেকে নকশী পিঠা মাত্র বানানো শিখছে ৯ বছরের রাফিয়া ফাউজি রজত। এই নকশী পিঠার আগ্রহ নিয়ে কথা হয় তার সাথে। রাফিয়া বলে, নকশী পিঠা আমার দাদু ও নানু বানাতো। তাদের কাছ থেকে আমার মা, ফুফপি ও খালামনিরা শিখেছে। আর মায়ের কাছ থেকে আমি শিখেছি। নকশী পিঠা বানাতে আমার খুব ভালোলাগে। এই পিঠা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি খেতেও খুব সুস্বাদু। অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত রূপণ(১৩) জানায়, বাড়ীতে নকশী পিঠা তৈরিতে তার কোন কাজ না থাকলেও বাজার থেকে চাউল কিনে তা গুঁড়া করে ও তেল আনতে হয়। আর এ কাজ সে স্বাচ্ছন্দেই করে। একই বাড়ীর মেয়ে সেলিনা বেগম(৪৫) সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, বাড়ির পাশেই দক্ষিণ চুয়ারিয়াখোলা গ্রামে আমার বিয়ে হয়েছে। তাই নকশী পিঠা বানানোর প্রয়োজন হলে আমাকে খবর দিলেই চলে আসি। ছোটরা নকশী পিঠা বানায়, আমি আর এখন পিঠা বানাই না। আমি নকশী পিঠার খামির তৈরি ও ভাজাভাজির কাজ করি। নকশী পিঠা এক ধরনের নকশা করা পিঠা যা বাংলাদেশে প্রচলিত। এটি এক প্রকার লোকশিল্প যা মেয়েলিশিল্প নামেও পরিচিত। এই পিঠার গায়ে বিভিন্ন ধরনের নকশা আঁকা হয় বা ছাঁচে ফেলে পিঠাকে চিত্রিত করা হয় বলে একে নকশী পিঠা বলা হয়। ভাদার্ত্তী গ্রামের শেফালী বেগম (৩৫) বলেন, গ্রামে যে কারো বাড়িতে নকশী পিঠা বানানো হলে যদি আমাকে খবর দেয়, কোন কাজ না থাকলে আমি চলে যাই। শুধু আমি না, আমার মত এমন অনেক মেয়েরা ছুটে আসে। আবার আমার প্রয়োজনে অন্যদের ডাকলেও তারা ছুটে যায়। এভাবেই একে অন্যের সহযোগীতায় তৈরি হয় এই ঐতিহ্যবাহী নকশী পিঠা। এ ব্যাপারে জাতীয় মহিলা সংস্থারকালীগঞ্জ উপজেলা শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জেসমিন বেগম বলেন, নকশী পিঠা আসলে গ্রাম বাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী পিঠা। এক সময় মায়েরা করলেও এখন সেটা ঘরের মেয়েরা করে, বাড়ির বৌরা করে। আমরা মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় মহিলা সংস্থার অধীনে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন ট্রেডে বেশ কিছু প্রশিক্ষন দিয়ে থাকি। এর মধ্যে ক্যাটারিং একটি ট্রেড একটি। এই ট্রেডে বিভিন্ন ফুড আইটেমের উপর প্রশিক্ষন দেওয়া হয়। আমরা চেষ্টা করবো নকশী পিঠার উপর প্রশিক্ষন দিতে। তারা যেন এখান থেকে প্রশিক্ষিত হয়ে জাতীয় মহিলা সংস্থার ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে কিছু করতে পারে।