শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৫:৪৪ পূর্বাহ্ন

অসুস্থতার প্রকারভেদ

মুন্সি আব্দুল কাদির:
  • আপডেট সময় বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

আর আমি যখন অসুস্থ হই, তিনি (মহান রব) আমাকে সুস্থতা দান করেন (সূরা শুয়ারা-৮০)। আমরা মানুষ। আমরা সুস্থ থাকি, অসুস্থ হই, চিকিৎসা নেই। সুস্থ থাকার চেষ্টা করি, অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে যাই, সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করতে থাকি। এমন কি কোনো ব্যক্তি অসুস্থ হলে চিকিৎসা ছেড়ে দেয় না। তার সাধ্য, সামর্থ্য অনুযায়ী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অসুস্থতা থেকে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। নিজের সামর্থ্যরে বাইরে হলে, মানুষের সাহায্যে, মানুষের কাছে হাত পেতে হলেও আপনজনরা চিকিৎসা চালানোর চেষ্টা করে। অন্য লোকেরাও মানুষ হিসেবে মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসে।
আমরা সাধারণত মনে করি, স্বাভাবিকভাবে কোনো রোগের আক্রমণে/কোনো রোগজীবাণুর আক্রমণে/শরীরের কোনো উপাদানের ঘাটতি অথবা বাড়তির কারণে/কোনো দুর্ঘটনার কারণে মানুষ অসুস্থ হয়। অবশ্যই এসব কারণে মানুষ অসুস্থ হয়। এ ছাড়াও আরো তিনটি কারণে মানুষ অসুস্থ হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়-
১. জিনের আছরের কারণে; ২. জাদুর কারণে ৩. বদনজরজনিত কারণে
তথাকথিক আধুনিক মানুষ, যাদের কাছে দ্বীনের সাধারণ জ্ঞান অনুপস্থিত তারা এই তিনটি কারণকে কোনো পাত্তা দিতে চায় না। আবার যাদের কাছে দ্বীনের ভাসাভাসা জ্ঞান রয়েছে তারাও এই তিনটি বিষয় নিয়ে তির্যক মন্তব্য করতে দ্বিধা করেন না। আমরা এই তিনটি বিষয় নিয়ে খানিক আলোকপাত করব : ১. জিনের আছরের কারণে : মহান রব মানুষ এবং জিনকে একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে মানুষ আসার আগে জিনেরা পৃথিবী আবাদ করেছিল। কুরআনুল কারিমে সরাসরি জিন শব্দ ব্যবহার করে জিনদের সম্পর্কে ৩৪টি আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে। মহান রব কুরআনুল কারিমে সূরা জিন নামে একটি সূরা নাজিল করেছেন। জিন আল্লাহর সৃষ্টি। মানুষের মতো তাদেরও আল্লাহর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এর প্রতি বিশ্বাস ঈমানের অংশ। এখন যদি আমরা জিনদের সৃষ্টিকে খামখেয়ালি মনে করি বা জিন আছে কি নেই ইত্যাদি প্রশ্ন ছুড়ে দেই বা এটিকে অবান্তর বিশ্বাস মনে করি তবে আমাদের ঈমানেও খামখেয়ালি এসে বাসা বাঁধবে। কুরআনুল কারিমে সুলাইমান আলাইহিস সালাম ও জিনদের আলোচনা, প্রিয় নবী সা: ও জিনদের আলোচনা এসেছে। জিনদের বিষয় নিয়ে হাদিসের কিতাবগুলোতে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি রাহ: জিন জাতির ইতিহাস নিয়ে একটি অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেছেন।
জিনদের দ্বারা মানুষের রোগ সৃষ্টির ব্যাপারে আমরা কয়েকটি হাদিস দেখতে পারি : রাসূল সা: বলেন, ‘শয়তান মানুষের দেহে তার রক্তের মতো প্রবাহিত হয়’ (ফতহুল বারি)। জিন বা শয়তানের আছরে মানুষের নানাবিধ রোগ হতে পারে। মতর ইবনে আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, উম্মে আবান বিনতে আল ওয়াজি বিন যারি বিন আমির আল আবদি তার পিতা থেকে আমাদের বর্ণনা করেছেন- তার দাদা আল যারি তার নিজের অথবা তার বোনের এক ছেলেকে নিয়ে আল্লাহর রাসূল সা:-এর কাছে নিয়ে এলেন। তার দাদা বলেন, আমরা মদিনায় আল্লাহর রাসূল সা:-এর কাছে এসে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল সা: আমার সাথে আমার অথবা আমার বোনের ছেলে রয়েছে, তার মস্তিষ্ক বিকৃত। আমি তাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। যাতে আপনি তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারেন। আল্লাহর রাসূল সা: বলেন, ‘তাকে আমার কাছে নিয়ে আসো। তার মুখ খোলো।’ সে তার মুখ খোলল এবং আল্লাহর রাসূল সা: তার মুখে থুথু নিক্ষেপ করলেন আর বললেন, ‘দূর হও হে আল্লাহর শত্রু, কারণ আমি আল্লাহর রাসূল বলছি।’ এই কথা তিনি তিনবার বললেন। অতঃপর রাসূল সা: বললেন, ‘এবার তোমরা ছেলেকে নিয়ে যাও। তার মধ্যে খারাপ কিছু নেই এবং সে যেই সমস্যায় ভুগছিল তা আর কখনো ফিরে আসবে না।’ জাবির রা: থেকে বর্ণিত- আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা পাত্রগুলো ঢেকে রেখো, পান করার পাত্রগুলো বন্ধ করে রেখো, ঘরের দরজাগুলো বন্ধ করে রেখো আর সাঁঝের বেলায় তোমাদের শিশুদেরকে ঘরে আটকে রেখো। কারণ এ সময় জিনেরা ছড়িয়ে পড়ে’ (বুখারি-৩০৭৯)।
আবু মুসা আশয়ারি রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘আমার উম্মত আন্ত্রিক ও প্লেগের দ্বারা ধ্বংস হবে।’ সাহাবিরা বলেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:, আমরা তো আন্ত্রিক রোগকে জানি, কিন্তু প্লেগ রোগ কী জিনিস? তিনি বলেন, ‘তোমাদের শত্রু জিনদের হামলাবিশেষ’ (মুসনাদে আহমাদ)।
আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘প্লেগ রোগে প্রচ- কষ্ট আছে, যা আমার উম্মতকে চাপিয়ে দেয়া হবে তাদের শত্রু জিনদের তরফ থেকে। সেই জিনদের কুঁজ হবে উটের কুঁজের মতো। যে ব্যক্তি প্লেগ-পীড়িত এলাকায় থাকবে, সে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষী (মুজাহিদের মতো) হবে। প্লেগে ভুগে যে মারা পড়বে, সে শহীদের মর্যাদা পাবে এবং যে মানুষ প্লেগ প্রভাবিত এলাকা ছেড়ে পালাবে, সে ইসলামবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় ময়দান ছেড়ে পলায়নকারীর মতো অপরাধী বলে গণ্য হবে’ (তাবারানি)। ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- একবার এক মহিলা তার ছেলেকে হজরত রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে নিয়ে এসে বলে, হে আল্লাহর রাসূল! আমার এই ছেলেটি পাগল এবং এর পাগলামি জাগে সকালে ও সন্ধ্যায়। এ আমার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে হজরত। তখন নবীজী ছেলেটির বুকে হাত বুলিয়ে দেন এবং তার জন্য দোয়া করেন। ফলে সে বমি করে ফেলে। বমির সাথে তার পেট থেকে একটি কালো কুকুরছানা বের হয়ে পালিয়ে যায় (যেটি আসলে ছিল কুকুরছানারূপী জিন), (মুসনাদে আহমাদ, বায়হাকি)।
হজরত উম্মে আব্বান বিনতে আল-ওয়াযাহ রহ:-এর পিতামহ রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে নিজের একটি পাগল শিশুকে নিয়ে যেতে নবীজী বলেন, ওকে আমার কাছাকাছি নিয়ে এসো এবং ওর পিঠটি আমার সামনে করো। তারপর নবীজী তার উপর নিচের কাপড় ধরে পিঠে মারতে মারতে বলেন, ‘ওরে আল্লাহর দুশমন! বেরিয়ে যাও। ফলে শিশুটি সুস্থ হয়ে চোখ খোলে (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ)।
হজরত উসামা বিন জাইদ রা: বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে হজের জন্য (মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশে) রওনা হয়েছি। বাতুনে রওহা নামক স্থানে এক মহিলা নিজের শিশুকে সামনে এনে বলে, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এ আমার ছেলে। যখন থেকে আমি ওকে প্রসব করেছি তখন থেকে এখন পর্যন্ত এর রোগ সারেনি। তখন রাসূলুল্লাহ সা: মহিলাটির কাছ থেকে শিশুকে নিয়ে নিলেন এবং তাকে নিজের বুক ও পায়ের মাঝখানে রেখে, তার মুখে থুথু দিয়ে বলেন, ‘ওহে আল্লাহর দুশমন! বেরিয়ে যা। আমি আল্লাহর রাসূল।’ এরপর নবীজী শিশুটিকে তার মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘একে নিয়ে যাও। এখন ওর কোনো কষ্ট নেই’ (বায়হাকি)। জিনের আক্রমণে মানুষের মনে এবং শরীরে দুই জায়গায়ই ক্ষতি হতে পারে। মানসিক আক্রমণে মানসিক রোগ দেখা দেয়। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে আক্রমণের বা আছরের ফলে বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। অনেক সময় স্বাভাবিক চিকিৎসায় রোগ ভালো হয়ে যায়। বিষয়টি হলো- যে জিনের মাধ্যমে রোগের আক্রমণ দেখা গেছে সে যদি চলে যায় এমনিতেই রোগটি ভালো হয়ে যায়। আর সে যদি না যায় তবে চিকিৎসার পর চিকিৎসা তারপরও রোগ ভালো হয় না বা একটি রোগ সেরে অন্যটি দেখা দেয়। আবার দীর্ঘমেয়াদি আছরের ফলে শরীরে যে রোগের সৃষ্টি হয় তখন সে এখান থেকে সরে গেলেও সাধারণত ঔষধি চিকিৎসা ছাড়া রোগ ভালো হয় না। তা ছাড়া জিনেরা কারো ঘরের জিনিসপত্র নষ্ট করে। জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলে। সম্পদের ক্ষতি সাধন করে।
আবার অন্য দিকে জিনদের মধ্যে জাদুকর জিন রয়েছে এরা মানুষের ওপর জাদু করে থাকে। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইদ বিন উমাইর রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা:-কে গইলান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘গইলান হলো জাদুকর জিন’। এ ছাড়া জিনদের বদ নজরেও মানুষ অসুস্থ হয়। উম্মে সালমাহ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: একবার তাঁর ঘরে একটি বাচ্চা মেয়েকে দেখেন, যার জিনের বদনজর লেগেছিল। তিনি বলেন, ‘একে অমুকের কাছ থেকে ঝাড়ফুঁক করিয়ে নাও, এর বদনজর লেগেছে’ (বুখারি)।
২. জাদু : জাদুর আরবি হলো সিহর। কুরআনুল কারিমের প্রায় ৫৭ আয়াতে জাদু বা সিহর শব্দটি বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষত মূসা আ: ও ফেরাউনের আলোচনায় ফেরেশতা হারুত-মারুতের আলোচনায় এই জাদুর আলোচনা এসেছে। সিহর নিয়ে বেশ ক’টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: সাতটি কবিরা গুনাহ সম্পর্কে বলেন, (আবদুল আযিজ ইবনু আবদুল্লাহ রহ: আবু হুরায়রা রা: সূত্রে নবী সা: থেকে বর্ণিত) তিনি বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী বস্তু থেকে বেঁচে থাকো’। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেগুলো কী? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সাথে শরিক করা, জাদু, যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে কাউকে হত্যা করা যা আল্লাহ হারাম করেছেন, সুদ খাওয়া, ইয়াতিমের মাল ভক্ষণ করা, জিহাদের ময়দান থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করা, সতীসাধ্বী বিশ্বাসী সরলমনা রমণীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করা।’ (বুখারি-৬৩৯৩)
আজহারি রাহ: বলেন, জাদু ওই কাজ, যা দিয়ে প্রথমে শয়তানের নৈকট্য অর্জন করা হয় এবং তার দিয়ে সাহায্য নেয়া হয়। তিনি আরো বলেন, জাদু মানে কোনো বস্তুকে তার বাস্তবতা থেকে সরিয়ে দেয়ার নাম। ইবনে আয়েশা রাহ: বলেন, আরবরা জাদুকে এই জন্য জাদু বলে যে, জাদু সুস্থতাকে অসুস্থতায় বদলে দেয়। জাদু আর জিন শয়তানের মধ্যে গভীরতম সম্পর্ক বিদ্যমান।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর শরীরে জাদুর প্রভাব : হোদায়বিয়ার সন্ধির পর নবী সা: মদিনায় ফিরে এলেন। এ সময় সপ্তম হিজরির মহররম মাসে খায়বার থেকে ইহুদিদের একটি প্রতিনিধিদল মদিনায় এলো। তারা আনসারদের বনি জুরাইক গোত্রের বিখ্যাত জাদুকর লাবিদ ইবনে আসআমের সাথে সাক্ষাৎ করল। তারা তাকে বলল, মুহাম্মাদ সা: আমাদের সাথে যা কিছু করেছেন তা তো তুমি জানো। আমরা তাঁর ওপর অনেকবার জাদু করার চেষ্টা করেছি; কিন্তু সফল হতে পারিনি। এখন তোমার কাছে এসেছি। কারণ তুমি আমাদের চেয়ে বড় জাদুকর। তোমার জন্য এ তিনটি আশরাফি (স্বর্ণমুদ্রা) এনেছি। এগুলো গ্রহণ করো এবং মুহাম্মাদের ওপর একটি শক্ত জাদুর আঘাত হানো। এ সময় একটি ইহুদি ছেলে রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে কাজ করার জন্য আসা-যাওয়া করত। তার সাথে যোগসাজশ করে তারা রাসূলুল্লাহ সা:-এর চিরুনির একটি টুকরা সংগ্রহ করতে সক্ষম হলো। তাতে তাঁর কিছু পবিত্র চুল আটকানো ছিল সেই চুলগুলো ও চিরুনির দাঁতের ওপর জাদু করা হলো। কোনো কোনো বর্ণনায় বলা হয়েছে- লাবিদ ইবনে আসআম নিজেই জাদু করেছিল। আবার কোনো কোনো বর্ণনায় বলা হয়েছে- তার বোনেরা ছিল তার চেয়েও বড় জাদুকর। তাদের সাহায্যে সে জাদু করেছিল। যাই হোক, এ দু’টির মধ্যে যেকোনো একটিই সঠিক হবে। এ ক্ষেত্রে এ জাদুকে একটি পুরুষ খেজুরের ছড়ার আবরণের নিচে রেখে লাবিদ তাকে বনি জুুরাইকের জারওয়ান বা জি-আজওয়ান নামক কূপের তলায় একটি পাথরচাপা দিয়ে রাখল। নবী সা:-এর ওপর জাদুর প্রভাব পড়তে পূর্ণ এক বছর সময় লাগল। বছরের শেষ ছয় মাসে মেজাজে কিছু পরিবর্তন অনুভূত হতে থাকল। শেষ ৪০ দিন কঠিন এবং শেষ তিন দিন কঠিনতর হয়ে গেল। তবে এর সবচেয়ে বেশি যে প্রভাব তাঁর ওপর পড়ল তা কেবল এতটুকুই যে, দিনের পর দিন তিনি রোগা ও নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলেন। কোনো কাজের ব্যাপারে মনে করতেন, করে ফেলেছেন অথচ তা করেননি।
নিজের স্ত্রীদের সম্পর্কে মনে করতেন, তিনি তাদের কাছে গেছেন অথচ আসলে তাদের কাছে যাননি। আবার কোনো কোনো সময় নিজের দৃষ্টির ব্যাপারেও তাঁর সন্দেহ হতো। মনে করতেন কোনো জিনিস দেখেছেন অথচ আসলে তা দেখেননি। এসব প্রভাব তাঁর নিজের ব্যক্তিসত্তা পর্যন্তই সীমাদ্ধ ছিল। এমনকি তাঁর ওপর দিয়ে কী ঘটে যাচ্ছে তা অন্যরা জানতেও পারেনি। কিন্তু নবী হিসেবে তাঁর ওপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল তার মধ্যে সামান্যতম ব্যাঘাতও সৃষ্টি হতে পারেনি। কোনো একটি বর্ণনায় এ কথা বলা হয়নি যে, সে সময় তিনি কুরআনের কোনো আয়াত ভুলে গিয়েছিলেন। অথবা কোনো আয়াত ভুল পড়েছিলেন। কিংবা নিজের মজলিসে, বক্তৃতায় ও ভাষণে তাঁর শিক্ষাবলিতে কোনো পার্থক্য সূচিত হয়েছিল। অথবা এমন কোনো কালাম তিনি ওহি হিসেবে পেশ করেছিলেন যা আসলে তাঁর ওপর নাজিল হয়নি। কিংবা তাঁর কোনো নামাজ তরক হয়ে গেছে এবং সে সম্পর্কে তিনি মনে করেছেন যে, তা পড়ে নিয়েছেন অথচ আসলে তা পড়েননি। নাউজুুবিল্লাহ, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে গেলে চার দিকে হইচই পড়ে যেত। সারা আরব দেশে খবর ছড়িয়ে পড়ত যে, নবীকে কেউ কাত করতে পারেনি। একজন জাদুকরের জাদুর কাছে সে কাত হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর নবুয়তের মর্যাদা এ অবস্থায় পুরোপুরি সমুন্নত থেকেছে। তার ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি। কেবল নিজের ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এ জিনিসটি অনুভব করে পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন। শেষে একদিন তিনি হজরত আয়েশার কাছে ছিলেন। এ সময় বারবার আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকলেন। এ অবস্থায় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন অথবা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। জেগে উঠে হজরত আয়েশাকে বললেন, আমি যে কথা আমার রবের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম তা তিনি আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন। হজরত আয়েশা রা: জিজ্ঞেস করলেন, কী কথা? জবাব দিলেন, ‘দু’জন লোক (অর্থাৎ দু’জন ফেরেশতা দু’জন লোকের আকৃতি ধরে) আমার কাছে এলো। একজন ছিল মাথার দিকে, আরেকজন পায়ের দিকে। একজন জিজ্ঞেস করল, এঁর কী হয়েছে? অন্যজন জবাব দিলো, এঁর ওপর জাদু করা হয়েছে। প্রথম জন জিজ্ঞেস করল, কে করেছে? জবাব দিলো, লাবিদ ইবনে আসআম। জিজ্ঞেস করল, কোন জিনিসের মধ্যে করেছে? জবাব দিলো, একটি পুরুষ খেজুরের ছড়ার আবরণে আবৃত চিরুনি ও চুলের মধ্যে। জিজ্ঞেস করল, তা কোথায় আছে? জবাব দিলো, বনি জুুরাইকের কুয়ায় আজওয়ানের (অথবা জি-জারওয়ান) তলায় পাথরচাপা দেয়া আছে। জিজ্ঞেস করল, তাহলে এখন এ জন্য কী করা দরকার? জবাব দিলো, কুয়ার পানি সেচে ফেলতে হবে। তারপর পাথরের নিচ থেকে সেটি বের করে আনতে হবে। এরপর নবী সা: হজরত আলী রা:, হজরত ইবনে ইয়াসির রা: ও হজরত জুুবাইর রা:-কে পাঠালেন। তাদের সাথে শামিল হলেন হজরত জুবাইর ইবনে ইয়াস আযযুরাকি ও কায়েস ইবনে মিহসান আযযুরাকি (অর্থাৎ বনি যুরাইকের দুই ব্যক্তি)। পরে নবী সা: নিজেও কয়েকজন সাহাবিকে সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছে গেলেন। পানি তোলা হলো। কুয়ার তলা থেকে কথিত আবরণটি বের করে আনা হলো। তার মধ্যে চিরুনি ও চুলের সাথে মিশিয়ে রাখা একটি সুতায় ১১টি গিরা দেয়া ছিল। আর ছিল মোমের একটি পুতুল। তার গায়ে কয়েকটি সুঁই ফুটানো ছিল। জিবরাইল আ: এসে বললেন, আপনি সূরা আল ফালাক ও আন নাস পড়–ন। কাজেই তিনি এক একটি আয়াত পড়ে যাচ্ছিলেন, সেই সাথে এক একটি গিরা খুলে যাচ্ছিল এবং পুতুলের গা থেকে এক একটি সুঁইও তুলে নেয়া হচ্ছিল। সূরা পড়া শেষ হতেই সমস্ত গিরা খুলে গেল, সমস্ত সুঁই উঠে এলো এবং তিনি জাদুর প্রভাবমুক্ত হয়ে ঠিক এমন অবস্থায় পৌঁছে গেলেন যেমন কোনো ব্যক্তি রশি দিয়ে বাঁধা ছিল তারপর তার বাঁধন খুলে গেল। তারপর তিনি লাবিদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। সে তার দোষ স্বীকার করল এবং তিনি তাকে ছেড়ে দিলেন। কারণ, নিজের ব্যক্তিসত্তার জন্য তিনি কোনোদিন কারো ওপর প্রতিশোধ নেননি। শুধু এই নয়, তিনি এ বিষয়টি নিয়ে কোনো কথাবার্তা বলতেও অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি বললেন, আল্লাহ আমাকে রোগমুক্ত করেছেন, কাজেই এখন আমি কারো বিরুদ্ধে লোকদের উত্তেজিত করতে চাই না।
জাদুর প্রভাবে শরীরে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। সাধারণ চিকিৎসার দ্বারা যার সমাধান হয় না। রোগী এদিক সেদিক আরোগ্য না পেয়ে পেরেশান হয়ে দৌড়াতে থাকে। রোগীর পরিবার ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। জাদুকর ব্যক্তি কুফুরি মন্ত্র দিয়ে অথবা শয়তান জাদুকর জিন দিয়ে জাদু করে থাকে। এতে যাকে জাদু করা হয়েছে তার শারীরিক মানসিক ক্ষতি সাধিত হয়। অসুস্থ হয়ে আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে গড়ায়। সম্পদের উপর করলে সম্পদের ক্ষতি হয়। পদ-পদবির ক্ষতি হয়। পারিবারিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। জাদুকরের মূল উদ্দেশ্য অন্যের ক্ষতি সাধন করা। ৩. বদনজর : যখন কোনো ব্যক্তি তার নজর বা চোখের চাহনির মাধ্যমে অন্যের ক্ষতি করে, তাকে বদনজর বলে। মানুষের প্রশংসা, উচ্ছ্বাস, হিংসার কারণে বদনজর মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে। এই প্রভাব এতই মারাত্মক যে, এর কারণে মানুষ অসুস্থ হয়। সুখী মানুষ দুঃখী হয়। জীবিত মানুষ মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।
হাফিজ ইবনুল হাজার আসকালানি রাহ: বলেন, বদনজর মানে হলো, কারো প্রতি হিংসামিশ্রিত বিস্ময় নিয়ে কোনো মন্দ লোকের তাকিয়ে থাকা এবং এর ফলে তার ক্ষতি হওয়া। তবে ইবনে হাজার রহ.-এর এই সংজ্ঞার সাথে অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম একমত নন, অধিকাংশের মত হচ্ছে- ভালো-খারাপ সব লোকের নজরই লাগতে পারে। নফসে আম্মারা তো সবার ভেতরেই আছে তাই না?
আল-কুরআনের বদনজরের কথা : পিতা বলল, হে আমার সন্তানেরা! তোমরা এক দরজা দিয়ে (মিসরে) প্রবেশ করো না; বরং ভিন্ন ভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে (মানুষের সন্দেহ কিংবা কুদৃষ্টি এড়ানোর জন্য) আমি আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে তোমাদের কোনোই উপকার করতে পারব না। আল্লাহ ছাড়া হুকুমদাতা কেউ নেই। আমি তাঁর ওপরই নির্ভর করি। যারা নির্ভর করতে চায়, তারা তাঁর ওপর নির্ভর করুক।
তাদের পিতা যেভাবে আদেশ করেছিল যখন তারা সেভাবে প্রবেশ করল, তখন আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে তা তাদের কোনো কাজে এলো না। তবে ইয়াকুব তার মনের একটি অভিপ্রায় পূর্ণ করেছিল মাত্র। আমার দেয়া শিক্ষার বদৌলতে অবশ্যই সে ছিল জ্ঞানবান, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ প্রকৃত ব্যাপার সম্পর্কে অবগত নয়। (সূরা ইউসুফ : ৬৭-৬৮) আর কাফেররা যখন উপদেশবাণী শোনে, তখন তারা যেন তাদের দৃষ্টি (বদনজর) দ্বারা তোমাকে আছড়ে ফেলবে। আর তারা বলে এ তো এক পাগল। (সূরা কালাম-৫১)
হাদিসে বদনজরের আলোচনা : ১. ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, বদনজর সত্য। যদি কোনো বস্তু তাকদির থেকে অগ্রগামী হতো, তবে তা বদনজরই হতো।’ (মুসলিম)
২. আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো। কেননা, বদনজর সত্য ও বাস্তব ব্যাপার।’ (ইবনে মাজাহ) ৩. রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘বদনজর মানুষকে কবর পর্যন্ত পৌঁছে দেয় এবং উটকে ডেগ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। (হিলইয়াতুল আউলিয়া) অর্থাৎ মানুষের ওপর বদনজর লাগার কারণে সে মৃত্যুবরণ করে, যার ফলে তাকে কবরে দাফন করা হয়। আর উটের ওপর যখন বদনজর লাগে তা মৃত্যুপর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন সেটি জবাই করে ডেগে রান্না করা হয়। ৪. জাবির রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে তাকদির অনুযায়ী মৃত্যুর পর অধিকাংশ মৃত্যু নজর লাগার কারণে হবে।’ (আস সুন্নাহ ইবনে আসেম)
৫. হজরত জাবের রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘বদনজর মানুষকে কবরে পৌঁছিয়ে দেয় আর উটকে ডেকচিতে প্রবেশ করায়।’ (আবু নুয়াইম হুলইয়াতুল আউলিয়া)
৬. হজরত আবু যার রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘বদনজর আল্লাহর হুকুমেই মানুষকে আকৃষ্ট করে। এমন সুউচ্চ পর্বত পযন্ত উঠিয়ে আবার ফেলে দেয়।’ (মুসনাদে আহমাদ)
৭. হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘বদনজর এমন সত্য যে, তা সুউচ্চ বস্তুকে পতিত করে দেয়।’ (মুসনাদে আহমাদ)
৮. আসমা বিনতে উমাইস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:, জাফরের ছেলেরা বদনজরে আক্রান্ত। আমি কি তাদের জন্য রুকিয়া করব? রাসূল সা: বললেন, ‘হ্যাঁ, যদি কোনো জিনিস তাকদিরকে অতিক্রম করার মতো থাকত তবে তা হতো বদনজর।’ (তিরমিজি) ৯. আবু উমামা সাহল ইবনে হানিফ বলেন, একবার আবু সাহল বিন হানিফ খারারে (মদিনার একটি কূপ) গোসল করছিলেন, গোসলের সময় তিনি সাধারণভাবে তার কাপড় খুলে ফেলেন তখন আমির বিন রবিয়াহ তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সাহল রা:-এর গায়ের রঙ ছিল সাদা, দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। আমির রা: বলেন, আমি এত সুন্দর আর কখনো দেখিনি।
এমনকি কোনো কুমারী নারীর চামড়াও এত সুন্দর দেখিনি। এর পরপরই সাহল রা: মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন এবং মারাত্মক অসুস্থ হয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সা:-কে এ বিষয় জানানো হলো। আরো বলা হলে যে, সাহল রা: মাথা উঁচুু করতে পারছেন না। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘তোমরা কি এর জন্য কাউকে দায়ী করছ?’ তারা বললেন, আমির বিন রবিয়াহ। রাসূলুল্লাহ সা: তাকে ডাকলেন এবং কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, ‘কেন তোমরা তোমাদের এক ভাইকে হত্যা করছ? তোমরা কেন তার কল্যাণ কামনা করে দোয়া করছ না? তার জন্য তুমি তোমার শরীর ধৌত করবে।’ অতঃপর আমির রা: তার মুখম-ল, উভয় হাত, কনুই থেকে কব্জি, হাঁটু, পায়ের পাতার পাশ এবং ইজারের ভেতরের অংশ একটি পাত্রের পানি দিয়ে ধৌত করলেন এবং এই পানি দিয়ে সাহল রা:-এর শরীরের পেছন দিক থেকে ঢেলে দেয়া হলো। সাহল রা: এতে সুস্থ হয়ে উঠলেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)
১০. ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কুনজর সত্য এবং তাকদিরের লিখনকে ডিঙ্গিয়ে যাওয়ার মতো কোনো কিছু যদি থাকত তা হতো কুনজর। কেউ যদি তোমার কাছে বদনজরের প্রভাব দূর করার জন্য আসে, তুমি তা করে দাও।’ (সহিহ মুসলিম)
১১. হুমাইদ ইবনে কাইস মাক্কি রাহ: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, জাফর ইবনে আবি তালিবের দু’টি ছেলেকে রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে নিয়ে আসা হলে রাসূলুল্লাহ সা: তাদের মহিলা খাদেমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই ছেলেরা এত জীর্ণশীর্ণ কেন। খাদেমা জবাব দিলেন, হে আল্লাহর রাসূল তাদের ওপর খুব তাড়াতাড়ি বদনজর লেগে যায়। আমরা তাদেরকে কোনো ঝাড়ফুঁক করাইনি। হয়তো বা আপনি তা পছন্দ করেন না। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘এদের জন্য ঝাড়ফুঁকের ব্যবস্থা করো। কেননা, কোনো বস্তু যদি তাকদিরের অগ্রে কোনো কর্ম সম্পাদন করতে পারত তবে তা হতো বদনজর।’ (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)
১২. ওরওয়া ইবনে জুবাইর রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: উম্মে সালমা রা: ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন ঘরে একটি বাচ্চা কান্না করছিল। লোকেরা আরজ করল, বাচ্চাটির উপর বদনজর লেগেছে। তখন রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘বদনজরের জন্য ঝাড়ফুঁক করাচ্ছে না কেন?’ (মুয়াত্তা ইমাম মালিক) পরিশেষে আমরা বলতে পারি, আমার বুঝে আসুক আর না আসুক আমাকে এগুলো বিশ্বাস করা উচিত এবং তার জন্য আমাকে রুকইয়াহ বা কুরআন সুন্নাহ-ভিত্তিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করা উচিত।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com