আইএমএফের মতে, ‘মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) হলো কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশে উৎপাদিত সব পণ্য ও পরিষেবার চূড়ান্ত বাজারমূল্য। বেশ ক’বছর যাবৎ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.২৫ শতাংশ হারে বেড়ে বর্তমানে ৪১৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম চূড়ান্ত হওয়া এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। তবে করোনা এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- মারাত্মকভাবে বিঘিœত হওয়ার পরও জিডিপিতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি, এই চমকপ্রদ তথ্য দেশের মানুষের মধ্যে চিন্তার উদ্রেক করেছিল। প্রশ্ন উঠছিল, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিমাপের জন্য জিডিপির হার কতটা কার্যকর পন্থা। অথচ এক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেশের অর্থনীতি কতটা অসার তা প্রমাণ করে দিলো।
অন্যদিকে, আয়বৈষম্য হলো সমাজে সম্পদ বাড়ছে অথচ সমাজের সব সম্পদ সবার মধ্যে সঠিকভাবে বা সমভাবে বণ্টিত হচ্ছে না। জিডিপির প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয়ের মূল বিতর্কটি হলো মূলত এর দ্বারা মানুষে মানুষে বৈষম্য বুঝতে না পারা। ওইসিডি যথার্থই বলেছে, ‘জিডিপি মূলত আয়ের পরিমাপ করে, তবে সমতার পরিমাপ নয়, জীবনের পরিমাপ নয়; কারণ এটি সামাজিক সংহতি ও পরিবেশের মতো মূল্যবোধগুলো হিসেবে আনতে পারে নাই। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও জীবনের তুলনা করতে গিয়ে বলতে হয়, একদিকে মুষ্টিমেয় দুর্নীতিবাজ হাজার কোটি টাকার মালিক হচ্ছে ফলে জিডিপি বাড়ছে, অন্য দিকে লাখো মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে ফলে ৩০ টাকা কেজির চাল কিনতে ওএমএসের ট্রাকের পেছনে মাথা ঢেকে, লাইন দিচ্ছে। শিক্ষা, চিকিৎসার এমনকি দু’বেলা খাবার জোটানোর ব্যবস্থাও নেই। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্য সংযোজন এসব দিয়ে মানুষ দেশের উন্নয়ন এবং জীবনমান বুঝতে পারে না। সুতরাং এই শুভঙ্করের ফাঁকি আর শুনতে চাচ্ছে না। মানুষ তার নিজেদের যাপিত জীবন দিয়েই উন্নয়ন বোঝে। জিডিপি গণনায় শুধু মাথাপিছু গড় আয় হিসাব করা হয়। কিন্তু সবচেয়ে গরিব ৪০ শতাংশের মাথাপিছু আয় এবং জীবনযাত্রার মান হিসাব করা হয় না। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বৈষম্যও বাড়ছে: গত বায়ান্ন বছরে বাংলাদেশের জিডিপি তিন গুণ বেড়ে এখন ৪১৬ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ গত পনেরো বছরে চারগুণ বেড়ে চলতি অর্থবছরে ২ হাজার ৭৬৫ মার্কিন ডলার। একই সাথে আয়বৈষম্য বাড়ছে অনেকগুণ বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়লেও তিনটি দেশের বৈষম্য গত আড়াই দশকে ব্যাপক বেড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০২১ সালে একটি উন্নয়ন সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা দুঃখ প্রকাশ করে বলছিলেন, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের যে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা একটি বৈষম্যপূর্ণ সমাজের দিকে নিয়ে যাচ্ছে দেশকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় জরিপের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে অসমতা সর্বকালের সর্বোচ্চ অবস্থানে। সর্বশেষ উন্নয়ন সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশীদের উদ্যোক্তা মনোভাবের প্রশংসা করেছেন। তবে একই সাথে তারা দেশকে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের দিকে নিয়ে যাওয়া বৃহৎ পরিসরের দুর্নীতিরও সমালোচনা করেন। আইএমএফ সম্প্রতি ‘সাউথ এশিয়াস পাথ টু রেজিলিয়েন্ট গ্রোথ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া মানব উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বৈষম্যের কথা বলতে গেলে, বাংলাদেশের সামগ্রিক মানব উন্নয়ন স্কোর ২০১৯ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৬৩২। কিন্তু, তা পরে শূন্য দশমিক ৪৭৮-এ নেমে আসে, যা প্রমাণ করে যে অসমতার কারণে মানব উন্নয়নে ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য যে দেশের উন্নয়ন আটকে রাখছে, এটি তার উদাহরণ। প্রকৃত অর্থে, দেশের উন্নয়নের বেশির ভাগই নাগরিকদের কঠোর পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভর করে। অথচ এমন কিছু নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে যা উন্নয়নকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বৈষম্যের দিক থেকে ২০১৮ সালে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৪০তম। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, ‘একটি ব্যাপক ও গভীর বৈষম্যপূর্ণ সমাজে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার টেকসই করা যায় না।’ সম্পদের অসম বণ্টন ও ভোগবৈষম্য কোনো সমাজেই কাক্সিক্ষত নয়। নিঃসন্দেহে জিডিপি প্রবৃদ্ধিই জনগণের জীবনের মান বোঝার জন্য সেরা সূচক নয়। যদিও কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পারস্পরিক তুলনার জন্য এ সহজ পদ্ধতিটি বিশ্বব্যাপী গ্রহণ করা হয়েছে। এই সূচকে আয়ের বৈষম্য, পরিবেশের ক্ষতি, গেরস্থালি কাজের হিসাব, সম্পদের অপচয়, সমরাস্ত্রের খরচ, পুঁজি পাচারসহ নানা প্রসঙ্গ সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না। জিডিপির পাশাপাশি যদি মানব উন্নয়ন সূচক উপস্থাপন করা হয়, তাহলে একটি দেশের উন্নয়ন তথা অগ্রগতির সার্বিক চিত্রের সন্ধান মেলে।
মূলত জিডিপির প্রবৃদ্ধি যেমন বিবেচ্য তেমনি উন্নয়ন কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক হলো, ঝুঁকি থেকে মানুষকে কতটা নিরাপদ রাখল, কতটা কর্মসংস্থান হলো ও সর্বোপরি কতটা টেকসই হলো সেটিই বিবেচ্য। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয় সামনে আসছে না।’ জিডিপি বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সাম্যের জন্য প্রয়োজন দুর্নীতি জিরো পর্যায়ে নামিয়ে আনা; যদিও এটি কঠিন তবে সরকারের পৃষ্ঠপোষকরা দুর্নীতিমুক্ত হলে এটি সম্ভব। বাজারের মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা; যেন তা দরিদ্র, নি¤œমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পৃথিবীর সব দেশ সুদহার সমন্বয়ের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। বলা বাহুল্য যে অর্থনীতির এই অব্যবস্থার মূল কারণ সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। সুতরাং সুদ থেকে বের হয়ে লাভ-লোকসান, ক্রয়-বিক্রয় ও ইজারাভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু করতে হবে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে উৎপাদন তথা সরবরাহ ব্যবস্থায় গুরুত্ব দিতে হবে।
জিডিপি বনাম জীবন-মৃত্যু: ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার প্রবন্ধকার সারাহ ও’কনর তার এক প্রবন্ধে বলেছেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের চেয়েও জীবনে আরো অনেক কিছু আছে। তিনি বলেন, আপনার গর্ভবতী সহকর্মীকে আপনার সীমিত বেতনের ছুটির কিছু দান করেন, যাতে সে কাজে ফিরে যাওয়ার আগে তার নবজাতকের সাথে আরো কিছুক্ষণ থাকতে পারে। মহামারী চলাকালীন সময় লিউকেমিয়া আক্রান্ত একজন সহকর্মী, যিনি কাজ করতে সক্ষম নন তাকে তাদের সবেতন ছুটি দেন।
আমেরিকার মতো উন্নত দেশের অনেক সংস্থা এগুলো নিয়ে ভাবে। প্রায় এক-চতুর্থাংশ মার্কিন নিয়োগকর্তার একটি ‘পেইড টাইম অফ ডোনেশন প্রোগ্রাম’ রয়েছে। এই প্রোগ্রাম সহকর্মীদের যারা অসুস্থতা বা আঘাতের সম্মুখীন হয়েছে এবং যারা সব সঞ্চিত ছুটি নিঃশেষ করেছে তাদের পেইড ছুটি ডোনেশন দেয়। বিশেষজ্ঞগণ কয়েক দশক ধরে যুক্তি দিয়ে আসছেন যে, জিডিপি জাতীয় সমৃদ্ধি বা জীবনযাত্রার মানগুলোর একটি অপর্যাপ্ত পরিমাপ। তবে আরো ভালো কিছু নিয়ে আসতে পারেনি। অর্থের চেয়েও আয়ু হচ্ছে একটি দেশ কিভাবে কাজ করছে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। এটি শিশু এবং মায়েদের চিকিৎসা, খাদ্যের মান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, দূষণ, চাকরি এবং অপরাধ ইত্যাদির দ্বারা প্রভাবিত হয়। এটা ‘স্বাস্থ্যকর আয়ুষ্কাল’, অর্থাৎ মানুষ কত বছর ধরে শালীন স্বাস্থ্যে বাস করে তার একটি পরিমাপ।
অবশ্যই নীতিনির্ধারকরা আয়ুষ্কাল সম্পর্কে যতœশীল। কিন্তু রাজনীতিবিদরা যদি এই পরিসংখ্যানগুলোকে তাদের জিডিপি প্রবণতার মতো আবেশী এবং উদ্বেগের সাথে তুলনা করেন তবে বিশ্বটি কেমন হতে পারে? কখন ইউরোপের অথবা চীনের জিডিপি আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে সে সম্পর্কে যতটা ভাবি তার চেয়েও বেশি ভাবতে হবে মানুষের মানবতা, সুখ, স্বাস্থ্য এবং আয়ুষ্কাল নিয়ে। এর মানে এই নয় যে জিডিপি কোনো ব্যাপার নয়। এটি একটি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা একটি দেশ বিশ্বে কী করতে পারে, সাথে তার জনগণের জন্য কী ধরনের জীবন সরবরাহ করতে পারে তা নির্ধারণ করতে সহায়তা করে। মাথাপিছু জিডিপি এবং আয়ুষ্কাল মোটামুটিভাবে সম্পর্কযুক্ত, তবে এর অনেক ব্যতিক্রম রয়েছে যা থেকে শিক্ষা নেয়া যেতে পারে। যেমন স্পেন, ইতালি এবং জাপানের আয়ুষ্কালের কথা যখন আসে তখন তাদের স্বাস্থ্যকর খাবারের সাথে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক পাওয়া যায়। যারা স্বাস্থ্যের বিষয়ে যতœশীল এবং নীতিনির্ধারক বা জনসাধারণকে প্রভাবিত করতে চান তারা প্রায়শই অর্থনীতিতে এর প্রভাব তুলে ধরার চেষ্টা করেন। ম্যাককিন্সির একটি গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, ‘দুর্বল স্বাস্থ্যের পেছনে প্রতি বছর বৈশ্বিক জিডিপি’র ১৫ শতাংশ ব্যয় হয়। এ খাতে ইংল্যান্ডকে প্রতি বছর ৩০ বিলিয়ন পাউন্ড খরচ করতে হয়, কারণ লোকেরা প্রায়শই অসুস্থ থাকে এবং কাজ করতে পারে না। এমনকি পরিণত বয়সের আগেই মারা যায়।
তাই আমরা দীর্ঘ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের পরিবর্তে জিডিপি চাই না বরং আমরা এমন জিডিপি চাই যাতে দীর্ঘ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে পারি। পরিশেষে বলতে হয়, সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের ব্যাপক অগ্রগতি হলেও স্বাস্থ্যশিক্ষার সুবিধা দেশের ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সমানভাবে বণ্টিত হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি মূলত রাজনৈতিক সমস্যা। সরকারি প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহির অভাব আমাদের অগ্রগতি এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটি রাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও চ্যালেঞ্জ করছে। সুতরাং এখন মাথাপিছু আয় এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধি নয়, প্রয়োজন অর্থনীতির সংহতি। প্রয়োজন মধ্যবিত্ত এবং নি¤œমধ্যবিত্তের প্রতি নজর দেয়া; এর জন্য সামাজিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা, সবাইকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করা। এর জন্য ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। বাজারের আতঙ্ক কমিয়ে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই বিলিয়নিয়াররা দেশের সঙ্কটের সময়ে বঞ্চিতদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ায়; আমাদের দেশে অনেক কোটিপতি রয়েছে; তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। নীতিনির্ধারকদের সাথে ভিন্ন মতের খোলামেলা আলোচনা করে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যগুলো যে দেশকে সার্বিক বৈষম্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা অনুধাবন করে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে আমরা প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি চাই তবে তা অবশ্যই জীবনের বিনিময়ে নয়। জনগণ সাম্য চায়, সবাই মিলে খেয়ে পরে বাঁচতে চায়; মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে ভাবতে হবে। লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট, ইমেইল;mizan12bd@yahoo.com