রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৩৪ পূর্বাহ্ন

ডেঙ্গু: আক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

বেসামাল ডেঙ্গু পরিস্থিতি। শুধু রাজধানী নয়, ডেঙ্গু জ্বরে ভুগছে সারাদেশের মানুষ। আক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। চলতি সেপ্টেম্বর মাসে এখন পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ মাসের দুই সপ্তাহে এত বেশি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা খুবই অস্বাভাবিক। মাত্র ১৪ দিনে এ রোগে মৃত্যু হয়েছে ১৮৫ জনের। গত আগস্ট মাসেও প্রথম দুই সপ্তাহে মারা যান ১৬৫ জন।
রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুরোগী সবচেয়ে বেশি। শুধু তাই নয় অন্যান্য বছরের তুলনায়ও এবার বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম প্রতি ২৪ ঘণ্টার আপডেট তথ্য তুলে ধরছে। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য বলছে, চলতি বছর ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ৭৯০ জন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এক লাখ ৬০ হাজার ৯৬৪ জন। তাদের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ৭১ হাজার ৫০৩ জন ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ৯০ হাজার ৪৬১ জন। এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৮১ জন মারা যান। একই বছরের ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। তার আগে, ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় ডেঙ্গু সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় মশার ঘনত্ব বেড়েছে। মশা নিধনে জোরালো পদক্ষেপ না নেওয়া, ডেঙ্গু প্রতিরোধে পূর্বপ্রস্তুতি না থাকা, বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর বাড়বাড়ন্ত, সাধারণ মানুষের অসচেতনতাসহ নানাবিধ কারণ রয়েছে সংক্রমণ দীর্ঘায়িত হওয়ার পেছনে।
শুধু তাই নয়, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা নেই অনেকের। এখনও ভুল ধারণায় আটকে আছেন এক শ্রেণির মানুষ। যারা রাজধানী ঢাকায় বসবাস করেন তাদের মধ্যে যাদের বসবাস ছয় কিংবা সাত তলায় তাদের ধারণা আরও বিচিত্র। বিশেষ করে মেসে থাকা কিংবা ব্যাচেলর বাসায় যারা বসবাস করেন তাদের অনেকের ধারণা, ছয় বা সাত তলায় মশা আসে না।
রাজধানীর গুলবাগ এলাকায় বসবাস করেন রোহান আহমেদ। নব-নির্মিত ১০তলা ভবনের সাত তলায় থাকেন তিনি। পুরো ফ্লোরটিই তাদের মেস হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে গত এক বছর ধরে। কিন্তু মশার উপদ্রব কমাতে কোনো মশারি বা কয়েল ব্যবহার করেন না। সম্প্রতি তার জ্বর হয়।একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু পরীক্ষা করান। ডেঙ্গু পজেটিভ আসে। এখন বাসা থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন।
রোহান আহমেদ বলেন, এতদিন জেনে আসছি মশা দুই বা তিন তলার বেশি উঠতে পারে না। কিন্তু আমরা সাত তলায় থাকি সেখানেও ডেঙ্গুর হানা। শরীরটা মাঝে খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল, এখন ভালো আছি। নিয়মিত চেকআপ করছি। এখনও পজেটিভ কিন্তু শরীর আগের তুলনায় ভালো। তিনি বলেন, রাতে মশা কামড়ালে মনে করতাম ছারপোকা কামড় দিয়েছে, মশার কথা কখনও ভাবিনি। এখন নিজে আক্রান্ত হয়ে নিজের ভুলটা শুধরে নিচ্ছি। মেসের সবার পরামর্শে আমরা এখন মশারি ও কয়েল ব্যবহার করছি।
ফকিরাপুল কালভার্ট এলাকায় একটি বাসার ছয় তলার চিলেকোঠায় স্ত্রীসহ বসবাস করেন শিমুল আহমেদ। রয়েছে দুই বছর বয়সী কন্যা সন্তান। তিনি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। তুলনামূলক শরীর ভালো থাকায় চিকিৎসকের সেবা নিচ্ছেন বাসা থেকেই। শিমুল বলেন, অনেকটাই অবহেলা করেছি শরীর নিয়ে। শুরুতে বুঝতে পারিনি মশা ছয় তলার ছাদে উঠে আসবে। ভেবেছি রাতে দু’একটা ছারপোকা কামড় দেয়, মশার কথা কখনও মনে হয়নি। আক্রান্ত হওয়ার পর সচেতন হই। এখন বাসা পরিষ্কার রাখছি, মশারি ও কয়েল ব্যবহার করছি, অন্যদেরও পরামর্শ দিচ্ছি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাসা-বাড়ির যে কোনো তলা থেকে উপরের তলায় সহজেই যেতে পারে মশা। ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে অসাবধান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নি¤œমানের কয়েল এড়িয়ে মশারি ব্যবহার করা জরুরি। নি¤œমানের কয়েল ব্যবহারে ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে গিয়ে শ্বাসকষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অনুমোদনবিহীন বা মানহীন নি¤œমানের কয়েলে মৃত্যুও হতে পারে বলেও সতর্ক করেন বিশেষজ্ঞরা।
হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, মশা সাধারণত ছয় তলা বা সাত তলাতে উঠতে পারে না বিষয়টা এরকম না। তিন তলায় একজনের বারান্দায় ফুলের টবে লার্ভা জন্মেছে, সেখান থেকে মশা সহজেই ছয় বা সাত তলায় যেতে পারে। সুতরাং ভুল ধারণা যে ছয় বা সাত তলায় এডিস মশা যেতে পারে না। এই ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে অসাবধান হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের পরামর্শ থাকবে ডেঙ্গু সাবধানতায় মশারি বা ভালো মানের কয়েল ব্যবহার করা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাসিরুল ইসলাম। থাকেন পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার এলাকায়। একটি ফ্ল্যাটের ছয় তলায় মেস করে থাকেন কয়েকজন মিলে। শুরু থেকেই মশারি বা কয়েল ব্যবহার করতেন না। তাদের ধারণা দুই বা তিন তলার উপরে মশা যায় না। সম্প্রতি মেসের দুজন সদস্য জ্বরে আক্রান্ত হন। টেস্টে ডেঙ্গু ধরা পড়ে তারও। এখন প্রতিদিনই কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমান। তবে মশার কয়েলে এখন কাশি শুরু হয়েছে তার। নাসিরুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে গিয়ে কয়েলের ব্যবহার বাড়িয়েছিলাম। রাতে দুইটা করে কয়েল ব্যবহার করেছি। এখন শ্বাসকষ্টে ভুগছি, প্রচ- কাশি হচ্ছে। তিনি বলেন, নরমাল কয়েলের কারণে এটা হতে পারে। বদ্ধ ঘরে কয়েল জ্বালানো ঠিক হয়নি।
নি¤œমানের মশার কয়েল ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে আগেও সতর্ক করেন সংশ্লিষ্টরা। ব্র্যান্ডের কয়েলের পাশাপাশি নকল কয়েলে সংলাব বাজার। মানহীন কয়েলে অতিরিক্ত মাত্রায় রাসায়নিকের ব্যবহার ক্ষতি করছে সুস্থ মানুষের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ নিয়ে গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন ধরে। গবেষণার অংশ হিসেবে তিনি ২০০২ সাল থেকে মশা ও কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ এবং বিতরণ সামগ্রী পরীক্ষা করছেন নিয়মিত। ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘মশা তাড়ায় এমন কয়েলের নন-ব্র্যান্ডের সংখ্যা অনেক বেশি। সেগুলোতে নির্ধারিত মানের অতিরিক্ত মাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার হয়। যেটা ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, মশার কয়েল শ্বাসতন্ত্রীয় ক্ষতিসহ আরও অনেক ক্ষতি করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বদ্ধ ঘরে বাতাস এত বেশি বিষাক্ত হয়ে যায় যে মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। একটি মশার কয়েল প্রায় চার ডজনের মতো সিগারেট পুড়লে যে পরিমাণ কার্বনড্রাই অক্সাইড বা বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয় সেই পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস একটি নি¤œমানের কয়েল তৈরি করে। এ জন্য মশার কয়েল যারা ব্যবহার করবেন তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে তারা যেন মানস্পন্ন কোম্পানির কয়েল ব্যবহার করেন। শুধু সামনের দোকানে কয়েল থাকবে আর ব্যবহার করবেন এটা যেন না হয়। দেখতে হবে এটা মানসম্পন্ন কি না, বিএসটিআই অনুমোদন দিয়েছে কি না, এটা দেখতে হবে। তা না হলে ডেঙ্গুর মশা তাড়াতে গিয়ে, বা ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে গিয়ে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটা শিশুদের জন্য মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বেশি ব্যবহার হলে দীর্ঘমেয়াদে কিডনি রোগ এবং ক্যানসারেরও ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
যদিও নি¤œমানের কয়েল বেচাকেনা বন্ধে অভিযান পরিচালনা করছে বিএসটিআই। প্রতিষ্ঠানটির উপ-পরিচালক (সিএম) রিয়াজুল হক বলেন, ‘অবৈধ কয়েল উৎপাদন-বিক্রি বন্ধে প্রতি সপ্তাহে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে বিএসটিআই। তারপরও আমরা পেরে উঠছি না, চেষ্টা করছি। একটি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করলে তারা আবার আরেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ব্র্যান্ডের নাম পাল্টে অন্য এলাকায় গিয়ে আবারও একই কাজ করেন।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদ বলেন, ‘মশা থেকেই ডেঙ্গু হচ্ছে। এই মশা নিয়ন্ত্রণে আনতেই প্রধানত উদ্যোগ নিতে হবে। সেই মশা মারার কার্যক্রম তো আমরা দেখছি না। তবে ১৩ সেপ্টেম্বর, এক সভায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম শফিকুর রহমান বলেন, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসির চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। শুরু থেকেই আমরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে মাইকিং করে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছি। মেয়র যখন যেখানেই যাচ্ছেন ডেঙ্গু সচেতনতায় লিফলেট বিতরণ করছেন।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগে ব্যক্তি সচেতনতা খুব জরুরি। বাসা-বাড়ি পরিষ্কার থাকলে এডিসের লার্ভা প্রতিরোধ করা যায়। ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘ভোরের আলো, বিশেষ পরিপূর্ণভাবে সূর্য উঠার আগে জানালা-দরজা খুলে দিতে হবে এবং সন্ধ্যার বেশ আগেই বন্ধ করে দিতে হবে। একই সঙ্গে দিনের বেলায় শিশুরা যদি ঘুমায় তাদেরকে মশারি দিতে হবে। ছয় তলা বা সাত তলায় নিজেদের ঘরে বা চারপাশে, ছাদের কার্নিশে বা ছাদে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করতে হবে নিয়মিত। সবমিলিয়ে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যদি মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা না যায়, তাহলে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে চিকিৎসা নিয়ে শরীর ঠিক করবো এরকম যেন না ভাবা হয়। কারণ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর একটি অংশের পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে যায়। তাই কোনো ভুল ধারণা থেকে কেউ যেন অসাবধান না হয়।’ উৎস:জাগোনিউজ২৪.কম




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com