বর্ষা মৌসুমে গ্রামাঞ্চলে পথ-ঘাট এবং বসতভিটার আশপাশে পানি জমে যায়। আবাসস্থল হারিয়ে মানুষের কাছাকাছি চলে আসে বিষধর সাপ। এরফলে এই সময়টাতে বিষধর সাপে কাটা রোগীর সংখ্যাও বেড়ে যায়। সাপে কাটার ঘটনাগুলোর প্রায় ৯৫ ভাগই গ্রামাঞ্চলে ঘটে। অথচ বেশিরভাগ অ্যান্টিভেনমই সরবরাহ করা হচ্ছে শহরের হাসপাতালে। সেগুলোর অনেকগুলোই অব্যবহৃত অবস্থায় মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আর উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম না থাকায় রোগীকে আসতে হচ্ছে শহরে। এতে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে মৃত্যুর হারও। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপে কাটার পর দ্রুততম সময়ে অ্যান্টিভেনম দেওয়া নিশ্চিত করতে উপজেলা পর্যায়ে এর সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। চলতি বছরের জুলাই মাসে প্রকাশিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে বছরে প্রতি লাখে ২৪৪ জন মানুষ বিষধর সাপের কামড়ের শিকার হন। এর মধ্যে চার থেকে পাঁচ জন মারা যান। সে হিসাবে প্রতি বছর ৪ লাখের বেশি মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে মারা যাচ্ছেন অন্তত ৭ হাজার ৫১১ জন।
স্বাস্থ্য অধিফতরের ‘এনসিডিসি রিসার্চ ইনফোগ্রাফিকস’ নামের জার্নালে ‘ন্যাশনাল সার্ভে অন অ্যানুয়াল ইনসিডেন্স অ্যান্ড ইপিডোমিওলজি অব স্নেকবাইট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণার বরাতে বলা হয়েছে, সাপের কামড়ের শিকার এসব মানুষের ৯৫ ভাগই গ্রামের বাসিন্দা।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সাপ কামড়ালে তিনভাবে বিষ মানুষের শরীরে প্রভাব ফেলে। হেমোটক্সিন হয় বা রক্তকে দূষিত করে, মায়োটক্সিন বা মাংসপেশীকে অকার্যকর করে দেয় এবং নিউরোটক্সিন অর্থাৎ মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। এসব ক্ষেত্রে বিষধর সাপ কামড়ালে রোগীকে বাঁচাতে হলে শরীরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে সব হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম পাওয়া যায় না। তাই রোগীদের উপজেলা বা জেলা শহরের হাসপাতাল ঘুরে বিভাগীয় শহর বা রাজধানী ঢাকায় নিয়ে আসতে হয়। ততক্ষণে অনেক রোগী স্ট্রোক বা পক্ষঘাতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আবার অ্যান্টিভেনম সহজলভ্য না হওয়ায় গ্রামাঞ্চলের বড় অংশ রোগীই ওঝা বা কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিতে চলে যান।গত এক মাসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে সাপা কাটার চিকিৎসা নিতে আসা কয়েক জন রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছে বাংলা ট্রিবিউন। তাদের অনেকেই সাপের কামড়ের চিকিৎসায় কার্যকরী অ্যান্টিভেনম উপজেলায় না পেয়ে জেলা সদরে এবং সেখানে না পেয়ে ঢামেকে এসেছেন। তারা বলছেন, কাছাকাছি অ্যান্টিভেনম না থাকায় বাধ্য হয়ে রোগীর স্বজনদের ছুটতে হয় ঢাকা কিংবা বিভাগীয় শহরে। সেখানে পৌঁছাতে এতটা দেরি হয়ে যায় যে, শেষ পর্যন্ত সাপের কামড়ে আহত অনেককে বাঁচানো যায় না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০২২ সালের শুরুর দিকে সারা দেশের ৮০টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিভিল সার্জন কার্যালয়, জেলা সদর হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনম সরবরাহ করা হয়েছে। তখন ৪১ হাজার ৪৭০ ডোজ প্রতিষেধক সরবরাহ করা হয়েছে। এর মাঝে যেসব অ্যান্টিভেনম এখনও অব্যবহৃত আছে, সেগুলোর মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।
উপজেলা সদরে অ্যান্টিভেনম না পাওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, উপজেলা ও জেলা সদরে অনেক সময় অ্যান্টিভেনম থাকলেও সেখানকার চিকিৎসকেরা জটিলতার ভয়ে তা দেন না। তার মতে, সাপে কাটা রোগীকে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের পর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যেমন অনেকের তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এমন রোগীকে সামাল দিতে আইসিইউর দরকার হয়। উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে তো সেই সুযোগ নেই, তাই সাপে কাটা রোগীকে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, আমরা চেষ্টা করছি উপজেলাগুলোতে অ্যান্টিভেনম দেওয়ার। কিন্তু অনেকে নিচ্ছে না। অনেক উপজেলাতে বিতরণ হয়েছে, কিন্তু তারা ব্যবহার করছে না। ২০২২ সালের আগস্টে অনেকগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। যারা প্রয়োগ করবেন তাদের অনেকের অভিজ্ঞতা না থাকায় ভয়ে দিতে চায় না। তবে আমরা প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করছি।-বাংলাট্রিবিউন