তিন মাস পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সময় যত ঘনিয়ে আসছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী তৎপরতা তত বাড়ছে। এদিকে, প্রকাশ্যে নির্বাচন না করার কথা বললেও তলে তলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিএনপির নেতৃবৃন্দ। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীনরা চান বরাবরের ন্যায় এবারও নির্বাচনী বৈতরণি পার হবেন। তারপরও চিন্তার ভাঁজ কপালে তাদের!
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৯৯১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রতিটিতে আওয়ামী লীগের ভোটের সংখ্যা বেড়েছে। তবে, এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। যাদের ভোটে ক্ষমতা নিশ্চিত হবে সেই ভোটাররা কি নিজ নিজ অধিকার প্রয়োগ করতে ভোটকেন্দ্রে আসবেন? স্থানীয় সরকারসহ একাধিক নির্বাচনে যাদের উপস্থিতি সেভাবে লক্ষ করা যায়নি। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সেই ভোটারদের উপস্থিতি একান্ত কাম্য ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের। বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছেন দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। ১৯৯১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রতিটিতে আওয়ামী লীগের ভোটের সংখ্যা বেড়েছে। তবে, এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। যাদের ভোটে ক্ষমতা নিশ্চিত হবে সেই ভোটাররা কি নিজ নিজ অধিকার প্রয়োগ করতে ভোটকেন্দ্রে আসবেন? স্থানীয় সরকারসহ একাধিক নির্বাচনে যাদের উপস্থিতি সেভাবে লক্ষ করা যায়নি। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ভোট নিয়ে বিরোধীদের অপপ্রচার, নাগরিকদের স্থান পরিবর্তন, ভোটের দিন গণপরিবহন না থাকা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে সাংগঠনিক ব্যর্থতা এবং দলীয় সমর্থকদের একটি অংশের ভোটের প্রতি অনীহা— স্থানীয় নির্বাচনে ভোট কম পড়ার অন্যতম কারণ। তবে, জাতীয় নির্বাচনে সমর্থকরা অতীতের মতো ধারাবাহিকভাবে তাদের ভোট দেবেন। কারণ, জাতীয় নির্বাচনে গাছাড়া ভাবের কোনো সুযোগ নেই। বিরোধীপক্ষ সামান্যতম সুযোগও হাতছাড়া করবে না— এমন বোধোদয় আছে তাদের।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচনে বিরোধী দল যদি শক্তিশালী থাকে, নির্বাচনের প্রাণচ লতা বলেন, অংশগ্রহণের প্রবণতা বলেন, এগুলো বাড়ে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক একটু হলেও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিস্তার করে। ফলে এর প্রতি আকর্ষণও একটু কম থাকে। সবকিছু মিলিয়ে মনে হতে পারে ভোটারের উপস্থিতি আগের চেয়ে কম। কিন্তু যখনই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হবে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে, তখন নিশ্চয়ই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বেন।’
‘একজন মানুষ যখন ভোটার হন, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়া তার নৈতিক দায়িত্ব, নাগরিক দায়িত্ব। এরপরও আমরা বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছি। ভোটারদের কেন্দ্রে নিতে আমাদের দল থেকে মোটিভেশনাল ক্যাম্পেইনগুলো বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। বিভিন্ন জায়গায় আমরা সভা-সমাবেশ করছি। ভোটারদের নৈতিক অধিকারের বিষয়ে তাদের সচেতন করা হচ্ছে। এ ছাড়া, আগামীতে যারা প্রার্থী হবেন, তারা তাদের মতো করে জনমত তৈরির চেষ্টা করবেন। সেখানে তারা ভোটারদের অধিকারের বিষয়গুলো উপস্থাপনের চেষ্টা করবেন। আমরা আশা করি, আগামী নির্বাচনে ভোটারদের সন্তোষজনক উপস্থিতি থাকবে।’
বাড়ছে প্রাপ্ত ভোটের হার: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৬৭টিতে জয় পায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। মাত্র সাতটি আসনে জয় পায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। তাদের চেয়ে বেশি আসন পায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অন্যতম অংশীদার জাতীয় পার্টি। তাদের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ২২টি। অন্যান্যরা চারটি আসনে জয়ী হয়। সবকিছু মিলিয়ে মনে হতে পারে ভোটারের উপস্থিতি আগের চেয়ে কম। কিন্তু যখনই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হবে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে, তখন নিশ্চয়ই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বেন
এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রাপ্ত ভোটের হার ৭৫ শতাংশ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোট ১২ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে। নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের ১১০ জন প্রদত্ত ভোটের ৯০ শতাংশেরও বেশি পান। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত প ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৫.৪ শতাংশ ভোট পড়েছিল। আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩০.০৮ শতাংশ, বিএনপি ৩০.৮১ শতাংশ, জাতীয় পার্টি ১১.৯২ শতাংশ, জামায়াতে ইসলামী ১২.১৩ শতাংশ এবং অন্যান্য দল পেয়েছিল ১৫.০৬ শতাংশ ভোট। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পড়েছিল ৭৫.৪৯ শতাংশ ভোট। সেখানে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩৯.৪৪ শতাংশ, বিএনপি ৩৩.৬০ শতাংশ, জাতীয় পার্টি ১৬.৪০ শতাংশ, জামায়াতে ইসলামী ৮.১৬ শতাংশ এবং অন্যান্য দল পেয়েছিল ৪.০৪ শতাংশ ভোট।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৭৫ শতাংশ ভোট পড়েছিল। সেখানে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪০.১৩ শতাংশ, বিএনপি ৪০.৯৭ শতাংশ, জাতীয় পাটি ১.১২ শতাংশ, জামায়াতে ইসলামী ৪.২৮ শতাংশ এবং অন্যান্য দল পেয়েছিল ১৩.০৫ শতাংশ ভোট।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৮৬.৩৪ শতাংশ। সেখানে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪৮.০৪ শতাংশ, বিএনপি ৩২.৫০ শতাংশ, জাতীয় পাটি ৭.০৪ শতাংশ, জামায়াতে ইসলামী ৪.৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য দল পেয়েছিল ৭.৭২ শতাংশ ভোট।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোটের হার বাড়ছে। অনেক সময় ভোট বাড়লেও ক্ষমতায় আসতে পারেনি দলটি। বর্তমানে কেন্দ্রে ভোটার টানার বিষয়ে বেশ টেনশনে আছে টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৪০ শতাংশ। সেখানে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭২.১৪ শতাংশ, জাতীয় পাটি ৭ শতাংশ এবং অন্যান্য দল পেয়েছিল ২০.৮৬ শতাংশ ভোট। এ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। তবে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দলীয় সরকারের অধীনে হওয়া ওই নির্বাচন বর্জন করে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। বিএনপি ২৭৮টি আসন পেয়ে একতরফা জয় পায়। মোট তিনটি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। অন্য দুটি দলের মধ্যে ফ্রিডম পার্টি একটি আসন পায়। বাকি ১০টি আসনে জয়লাভ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এ ছাড়া, ১০টি আসনের ফলাফল অসমাপ্ত ছিল। একটি আসনের নির্বাচন আদালতের আদেশে স্থগিত করা হয়। সংসদনেতা হন খালেদা জিয়া। এ সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র ১১ দিন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোটের হার বাড়ছে। অনেক সময় ভোট বাড়লেও ক্ষমতায় আসতে পারেনি দলটি। বর্তমানে কেন্দ্রে ভোটার টানার বিষয়ে বেশ টেনশনে আছে টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, বিএনপির পদত্যাগে শূন্য হওয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ- ২ ও ৩, বগুড়া- ৪ ও ৬, ব্রাহ্মণবাড়িয়া- ২ ও ঠাকুরগাঁও- ৩ আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। ভোট পড়েছে গড়ে ২৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। দেশের নির্বাচনী ঐতিহ্যের নিরিখে এটি খুবই কম। এর আগে বহুল আলোচিত গাইবান্ধা- ৫ আসনে ভোট পড়েছিল ৩৮ শতাংশ। এ ছাড়া, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকারের প্রতিটি নির্বাচনে (সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন) ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় পর্যায়ের এসব নির্বাচনে ভোট দিতে মানুষের অনীহা ক্ষমতাসীন দলকে বেশ চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ভোটারদের এমন খরা কাটাতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে তারা। ইতোমধ্যে তার বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন স্থানীয়ভাবেই হয়। সেখানে রাজনীতি থাকলেও সেভাবে তা প্রতিফলিত হয় না। জাতীয় নির্বাচনে যেমনটি হয়। এ নির্বাচনে স্বস্তিদায়ক পরিবেশ থাকে, মানুষের ভোট দেওয়ার আগ্রহ থাকে। ‘অতীতের স্থানীয় নির্বাচনের সঙ্গে এবারের নির্বাচন মেলানো ঠিক হবে না’— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে মানুষ অংশগ্রহণ করতে চান। অংশগ্রহণও করেন। সেখানে একটি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ কাজ করে, পরিবেশও নিরাপদ থাকে। ভয়-ভীতি, আতঙ্ক, বাধা দেওয়া— এ ধরনের পরিবেশ যদি কেউ অবতারণা না করেন, সেক্ষেত্রে মানুষ খুবই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বাংলাদেশে বিশেষ করে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটি দারুণ দৃষ্টান্ত।’ ‘যেহেতু নির্বাচনে সন্ত্রাসী কর্মকা- করার কোনো সুযোগ থাকবে না বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সকল রাজনৈতিক দল সেভাবে দায়িত্বপালন করবে, সেক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনে জনগণ ব্যাপক হারে অংশগ্রহণ করবে’— মনে করেন বাহাউদ্দিন নাছিম।
বিএনপি নির্বাচনে না এলে ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ হবে কি না— জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে জয়টাকে আমরা গুরুত্ব দিই। জয়লাভের জন্য আমরা এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। আমরা মনে করি, যেকোনো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল নির্বাচন অংশগ্রহণ করবে। সেক্ষেত্রে কে করবে না, তার জন্য আমরা অপেক্ষা করব না। আমাদের আশা, সবাই অংশগ্রহণ করবে এবং প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হবে।’ দলীয় সূত্রে আরও জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে দৃশ্যমান কিছু সাংগঠনিক উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শুরু হয়েছে ‘রোড টু স্মার্ট বাংলাদেশ’ নামের কর্মসূচি। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশের প্রতিটি ওয়ার্ডে স্থানীয় প্রচারকর্মী মনোনয়ন করা হয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষক ও মেন্টর নিয়োগ করা হয়েছে। সারাদেশে প্রশিক্ষণের জন্য দুই শতাধিক ব্যক্তিকে ‘মাস্টার ট্রেইনার’ মনোনীত করে কর্মশালা শুরু হয়েছে।- ঢাকা পোস্ট