ভারতের নিউজক্লিক মিডিয়া আউটলেটের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান এবং কয়েকজন প্রথম সারির সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন অধিকারকর্মীরা। এর মধ্যে রয়েছেন বুকার পুরস্কারজয়ী লেখিকা অরুন্ধতী রায়ও। তারা এ অভিযানকে ‘মুক্ত সংবাদ মাধ্যমের গলা টিপে ধরার’ উদ্যোগ বলে অভিহিত করেছেন। বুধবার বিভিন্ন শ্রেণির অধিকারকর্মী এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি।
চীনের কাছ থেকে তহবিল পাওয়া এবং তা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহারের অভিযোগে ওই সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় পুলিশ। তারা ভারতের প্রথম সারির কিছু সাংবাদিকের বাড়িতে তল্লাশি চালায়। গ্রেপ্তার করে নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা প্রবীর পুরকায়স্থকে। বলা হয়, অর্থায়নের বিষয়ে সন্ত্রাস বিরোধী আইনের অধীনে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীরা পুলিশের এই উদ্যোগকে স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর দমনপীড়ন বলে আখ্যায়িত করছেন। জবাবে মন্ত্রীরা বলছেন, পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করছে। মঙ্গলবার ৩০টি স্থানে সমন্বয়ের মাধ্যমে অভিযান চালায় পুলিশ।
ভারতের সাম্প্রতিক সময়ে মিডিয়ার বিরুদ্ধে এটাই সবচেয়ে বড় এবং বিস্তৃত অভিযান। পরে পুলিশ নিশ্চিত করে, তারা নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা প্রবীর পুরকায়স্থ, প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিষয়ক প্রধান অমিত চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করেছে।
উল্লেখ্য, নিউজক্লিক একটি নিরপেক্ষ এবং বর্তমান সমসাময়িক বিষয়ের ওয়েবসাইট। সরকারের সমালোচনার জন্য এটি বেশ পরিচিত। তারা চীনের কাছ থেকে বেআইনিভাবে অর্থ পেয়েছে বলে পুলিশের দাবি। তবে নিউজক্লিক কর্তৃপক্ষ এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এমন গ্রেপ্তার এবং তাদের বাড়িতে তল্লাশির নিন্দা জানিয়েছেন সাংবাদিকরা, সংবাদ বিষয়ক সংগঠন, মানবাধিকার কর্মীরা। তারা একে সরকারের আরেকটি খেয়ালখুশি এবং ভীতিপ্রদর্শনের উদাহরণ বলে বর্ণনা করেছেন। গত বুধবার সাংবাদিকরা এবং লেখক-লেখিকারা দিল্লিতে একটি প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছেন। এতে যোগ দেয়া একজন মানবাধিকারকর্মী যোগেন্দ্র যাদব বিবিসিকে বলেছেন, এটা হলো কণ্ঠরোধের চেষ্টা। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এটা হলো ভারতীয় মিডিয়ার ওপর আক্রমণ। এতে যোগ দেয়া অরুন্ধতী রায় বলেন, ‘আনলফুল একটিভিটিজ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট’ সংশোধন করে এতে সন্ত্রাসীদের সংজ্ঞার অধীনে আনা হয়েছে বুদ্ধিজীবী, লেখক-লেখিকা এবং সাংবাদিকদের। ওইসব সাংবাদিকের ফোন, কম্পিউটার জব্দ করেছে পুলিশ। সন্ত্রাস বিরোধী আইনের অধীনে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে সাংবাদিক এবং সন্ত্রাসীর মধ্যে পার্থক্যকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আগামী নির্বাচন অত্যাসন্ন। তার আগে তারা নির্লজ্জভাবে তাদের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করছে।
যেসব সাংবাদিককে এ মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তারা হলেন অভিসার শর্মা, পরানজয় গুহ ঠাকুরতা, অনিন্দ্য চক্রবর্তী, উরমিলেশ, ভাশা সিং, জনপ্রিয় স্যাটায়ারিস্ট সঞ্জয় রাজুরা, ইতিহাসবিদ সোহেল হাশমি। কয়েকজনকে নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ স্টেশনে। ওদিকে দিল্লিতে অবস্থিত সংবাদ মাধ্যমটির ওয়েবসাইট অফিসে তল্লাশি করেছে পুলিশ। উল্লেখ্য, নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যে, এই ওয়েবসাইট চীনা প্রপাগা-া ছড়িয়ে দিতে একজন মার্কিন মিলিয়নারের কাছ থেকে তহবিল পেয়েছে। এরপরই আগস্টে নিউজক্লিকের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। তার ডিত্তিতেই তল্লাশি চালায় পুলিশ। কিন্তু এই তল্লাশিকে ‘নৃশংস, নিষ্ঠুর এবং কলঙ্কিত’ বলে অভিহিত করেছেন ইতিহাসবিদ রামাচন্দ্র গুহ। তিনি আরও বলেন, ওই ওয়েবসাইটটি ‘ঘনিষ্ঠজনদের পুঁজিবাদী’ করে তোলার ওপর আলোকপাত করেছিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি ক্ষমতায় আসে ২০১৪ সালে। তখন থেকে বেআইনি অর্থায়নের অভিযোগে অনেক মিডিয়া আউটলেটের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে। এতে বিশ্বের সবচেয়ে গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে মুক্ত সংবাদ মাধ্যম নিয়ে আতঙ্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছরের শুরুতে ট্যাক্স কর্মকর্তারা ভারতে অবস্থিত বিবিসির অফিসে তল্লাশি চালায়। এর কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। ২০০২ সালে গুজরাট রাজ্যে দাঙ্গার সময় নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা নিয়ে সমালোচনামূলক একটি প্রামাণ্যচিত্র সম্প্রচার করার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিবিসির দিল্লি এবং মুম্বই অফিসে তল্লাশি চালানো হয়। করোনা মহামারি সরকার যেভাবে মোকাবিলা করেছে তা নিয়ে সমালোচনামূলক রিপোর্ট প্রকাশ করার পর ২০২১ সালে আয়কর ফাঁকি দেয়ার অভিযোগে দৈনিক ভাস্কর পত্রিকাকে অভিযুক্ত করে আয়কর কর্মকর্তারা।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়। নিউজক্লিকে তল্লাশি এবং সাংবাদিক প্রবীর পুরকায়স্থ, অমিত চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার হলো স্বাধীন ও সমালোচনামূলক মিডিয়াকে ধ্বংস করার জন্য ভারত সরকারের সর্বশেষ উদ্যোগ।