খেলাপি ঋণ আদায় এবং ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকায় সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর প্রতিনিধিদল। তারা খেলাপি ঋণ আদায় এবং ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে সরকার গৃহীত পদক্ষেপ জানতে চেয়েছে। বাংলাদেশে সফররত আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদলটি গতকাল রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক সভায় এসব বিষয়গুলো তুলে ধরে বলে জানা গেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষে সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ এবং আইএমএফের পক্ষে ছিলেন সংস্থাটি এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ।
সভা সূত্রে জানা গেছে,সংস্থাটি দেশের ব্যাংকিং খাত এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বলে উল্লেখ করেছে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ এখনো ১০ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এর মধ্যে সরকারের হাতে থাকা ব্যাংকগুলোর অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এখন ২০ শতাংশে ওপরে চলে গেছে। প্রতিনিয়ত এই ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার বেড়েই চলেছে। খেলাপি ঋণ কমানোর ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের দৃশত কোনো উদ্যোগই কাজে লাগছে না। এ পরিস্থিতিতে আগামী কয়েক মাসে খেলাপি ঋণের মাত্রা কিভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে সে বিষয়ে জানতে চেয়েছে আইএমএফ। একই সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের হস্তক্ষেপ কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
সূত্র জানায়, আলোচনার শুরুতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে ব্যাংকিং খাতে বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকের সার্বিক বিষয়ে একটি চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে দেখানো হয়, বিগত দিনে ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বলা হয়, বেশ কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ‘বার্ষিক কর্মসম্প্রদান চুক্তি’ (এপিএ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর আওতায় প্রতি তিন মাস অন্তর ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনা করা হয়। এর আওতায় বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয় ব্যাংকগুলোকে। এ পর্যায়ে আইএমএফের পক্ষ থেকে বলা হয়, এরপরও এসব ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হচ্ছে কেন, খেলাপি ঋণই বা বাড়ছে কেন। এর জবাবে বলা হয়, চেষ্টা করা হচ্ছে, খেলাপি ঋণ কমানোর। আগামী বছরের মাঝামাঝি এর দৃশ্যমান প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়। এ বিষয়ে আইএমএফ পক্ষ থেকে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলা হয়, ঋণের চুক্তি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে।
জানা গেছে, আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সভার অবস্থা জানতে গতকাল দুপুরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে সচিবালয়ে তার কক্ষে ডেকে নেন অর্থমন্ত্রী আ হ মুস্তফা কামাল। এ সময়ে সচিব সভার ফলাফল সম্পর্কে মন্ত্রীকে অবহিত করেন।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে এ সরকারি ছয়টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশ। মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৪ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৩২ দশমিক ৬৪ শতাংশই এখন খেলাপি। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণও ১৬ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। সোনালী ব্যাংকের ১২ হাজার ৩৮২ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। সরকারি খাতের সর্ববৃহৎ এ ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের হার ১৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ১৯ শতাংশের বেশি। বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ৮ হাজার ২৫ কোটি টাকা। এ ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৬২ দশমিক ৬৬ শতাংশই খেলাপি। বিডিবিএলের খেলাপি ঋণের হারও ৪৪ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে, যার পরিমাণ ৯৭১ কোটি টাকা।
গত এপ্রিল-জুন সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায়। এই খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এখন তা দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ১৪ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাতগুণ।