দেশে দুধ ও মাংসের উৎপাদন বাড়াতে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। প্রুভেন বুল (প্রজননের জন্য পরীক্ষিত বা প্রমাণিত ষাঁড়) তৈরি প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। সেই প্রুভেন বুল তৈরি শিখতে বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে যেতে চান ২৪ জন কর্মকর্তা। এ খাতে মোট প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ৯২ লাখ টাকা। ‘দুধ ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রুভেন বুল তৈরি’ প্রকল্পের আওতায় এই ব্যয় প্রস্তাব করেছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। বিদেশে যাওয়া ছাড়াও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ বাবদ চাওয়া হয়েছে ১৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর আওতায় ৩৫ হাজার ৫৭২ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তবে কোন দেশে যাওয়া হবে সেটা স্পষ্ট করা হয়নি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রস্তাবনা নিয়ে ১৬ অক্টোবর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইস) সভা করবে পরিকল্পনা কমিশন। সভায় সার্বিক প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা হবে। পরিকল্পনা কমিশন জানায়, ইন্টারনেট বিল বাবদ ৯৭ লাখ, সেমিনার ও কর্মশালা বাবদ ৩৬ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। মনোহারি বাবদ এক কোটি ৩৩ লাখ, সম্মানি ভাতা বাবদ চার কোটি ৮০ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। সম্মানি দেওয়া হবে চার লাখ ৮০ হাজার জনকে।
এছাড়া ১২ জনের পরামর্শক সেবা বাবদ চাওয়া হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা। ১২শ ষাঁড় বাছুর সংগ্রহ করা হবে। এ খাতে ব্যয় ১৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ৩২৩টি যানবাহন বাবদ তিন কোটি ৯৪ লাখ, ৩৭২টি আসবাবপত্র বাবদ ৩৮ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। এসব খাতের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের বন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উইংয়ের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মাদ মফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর আমাদের কাছে প্রকল্পের প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে। কেউ চাইলেই অনুমোদন হবে না। সামনে পিইসি সভা হবে। পিইসি সভায় সার্বিক বিষয়ে আলোচনা করেই সব কিছু অনুমোদন দেওয়া হবে।’ প্রকল্পের মোট প্রস্তাবিত ব্যয় ৩৯৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০২৮ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য: সংশ্লিষ্ট বিভাগ জানায়, গ্রামীণ পরিবেশে অনেক শংকর জাতের গাভি এখন প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ লিটার দুধ দেয়। উচ্চ উৎপাদনশীল গাভির উৎপাদনশীলতা ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন ভালো মানের সিমেন। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে সিমেন ব্যবহার করা না হলে অপরিকল্পিত এবং অসংহত প্রজননের ফলে একসময় উচ্চ উৎপাদনশীল গাভির বাচ্চার মধ্যে উৎপাদন ক্ষমতায় বিরূপ প্রভাব পড়বে।
প্রাণীর প্রজননের ক্ষেত্রে শুধু উৎপাদন বৃদ্ধিই মূল কথা নয়, বরং উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন স্থায়ীকরণ, আবহাওয়ার সঙ্গে প্রাণীর অভিযোজন, সফল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রাণীর উৎপাদন দক্ষতার যথাযথ প্রকাশ- সবই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই উন্নত জেনোটাইপের গাভিকে প্রজনন করানোর ক্ষেত্রে সুপিরিয়র কোয়ালিটির প্রুভেন বুলের সিমেন ব্যবহার করা উচিত। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কৃত্রিম প্রজনন দপ্তরের পরিচালক ডা. আনন্দ কুমার অধিকারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এর বেশি কিছু আমি বলতে চাই না। কারণ আমি বিভাগে নতুন এসেছি।’ বৈদেশিক প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে ডা. আনন্দ কুমার অধিকারী বলেন, ‘প্রুভেন বুল তৈরির জন্য বৈদেশিক প্রশিক্ষণের দরকার হয়।’ সাধারণত কোন দেশে যাওয়া হয়? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের জন্য ভারত যাওয়া উপযুক্ত। ভারতের সঙ্গে আমাদের অনেক মিল আছে। প্রুভেন বুল বলতে ভারত ভালো। এছাড়া ইউরোপীয় দেশ নেদারল্যান্ডস, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াও ভালো।’
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম: আট বিভাগের ৬৪ জেলার সব উপজেলা থেকে গড় দুধ উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে দেশি-ফ্রিজিয়ান ও দেশি-শাহিওয়াল ক্রসব্রিড, রেড চিটাগং, পাবনা, মুন্সিগঞ্জ এবং নর্থবেঙ্গল গ্রে জাতসহ মোট ১২শ ষাঁড় সংগ্রহ করা হবে। এর মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নির্বাচন করা হবে ছয়শটি ক্যান্ডিডেট ষাঁড়। নির্বাচিত প্রতিটি ক্যান্ডিডেট ষাঁড় থেকে সিমেন সংগ্রহ করে মাঠ পর্যায়ে কৃত্রিম প্রজনন করা হবে। ব্রিডিং ভ্যালুর ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়িত ষাঁড়গুলোকে র্যাংকিং করে ঘোষণা করা হবে প্রুভেন ষাঁড় হিসেবে। প্রকল্পের আওতায় মোট ৩৪ হাজার ৩৭৫ জন খামারিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এর মধ্যে সাড়ে সাত হাজার উচ্চ উৎপাদনশীল গাভি মালিককে এলিট গাভি ইনসেনটিভ দেওয়া হবে। প্রুভেন বুলের সিমেন ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণ, টিকা, ওষুধ এবং প্রাণিখাদ্য কেনা হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের মতামত: প্রস্তাবিত প্রকল্পের মূল কাজ দেশি জাতের দেশি-ফ্রিজিয়ান ও দেশি-শাহিওয়াল ক্রসব্রিড, রেড চিটাগং ক্যাটেল, পাবনা, মুন্সিগঞ্জ, নর্থবেঙ্গল গ্রে ইত্যাদি গরুর জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণে প্রুভেন বুল তৈরি করা। এটি একটি গবেষণাধর্মী কাজ। রেড চিটাগাং ক্যাটলের জাত উন্নয়নের জন্য বিএলআরআই এরই মধ্যে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। আলোচ্য প্রকল্পে প্রস্তাবিত প্রুভেন বুল তৈরির কাজটি বিএলআরআই’র মাধ্যমে করা যেতে পারে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্প সংখ্যা ২৪টি এবং মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৯ হাজার ৬৪৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ, এ প্রকল্পগুলো শেষ করতেই আগামী বছরগুলোতে গড়ে প্রায় এক হাজার ২শ কোটি টাকা জিওবি বরাদ্দ প্রয়োজন। প্রস্তাবিত প্রকল্পের অর্থায়ন পরিকল্পনার বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতামত জানা যেতে পারে। পরিকল্পনা কমিশন আরও জানায়, গরুর কৃত্রিম প্রজননের জন্য দেশে প্রতি বছর গড়ে এক কোটি ৬৮ লাখ ডোজ সিমেন প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে এক লাখ ডোজ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর উৎপাদন করে। বর্তমানে বেসরকারি উদ্যোগে লালতীর, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সিমেন উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। বেসরকারি খাতের সিমেন উৎপাদনের সক্ষমতা মাথায় নিয়েই প্রকল্প নিতে হবে।
উচ্চ জেনেটিক মেরিট সম্পন্ন সুপিরিয়র ব্রিডিং বুল নির্বাচনের মাধ্যমে উচ্চ উৎপাদনশীল এলিট গাভির প্রজনন করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গবাদিপশুর গড় দুধ ও মাংস উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। তাই দুধ ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে ‘দুধ এবং মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রুভেন বুল তৈরি’ শীর্ষক প্রকল্পটি প্রণয়ন করা হয়েছে।-জাগোনিউজ২৪.কম