সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৩ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
বগুড়ার শিবগঞ্জে আলু বীজ বিক্রেতাদের সিন্ডিকেট! কুড়িগ্রাম যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে হস্তশিল্পের উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে ভাগ্য বদলে গেছে নারী উদ্যোক্তা রাজিয়ার তারাকান্দায় শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অভিভাবক সমাবেশ চকরিয়ায় সামাজিক বনায়ন উদ্ধারে মানববন্ধন ও র‌্যালি বরিশাল বিভাগীয় সাংবাদিক পরিষদের ২০২৪ বিদায় উপলক্ষে সভা বীরগঞ্জে সাংবাদিকদের সাথে উপজেলা বিএনপি সভাপতির মতবিনিময় সভা পাঁচবিবিতে কোয়েল পাখি পালনে হাসানের মাসে আয় লক্ষাধিক টাকা মোংলার মাটিতে কোন ফ্যাসিস্টদের ঠাঁই হবে না-সমন্বয়ক মোল্ল্যা রাহমাতুল্লাহ সিংড়ায় আমি মধ্যবিত্ত কাব্যগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন মুক্তির ডাক ৭১: নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ

পাকিস্তানের কেন এ দুর্ভাগ্য

শেখ ফয়সল আমীন
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৩

পাকিস্তানের ডন পত্রিকার বরাত দিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো একটি সংবাদ সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রকাশ করেছে। সংবাদটির সারকথা হচ্ছে—বিভিন্ন দেশে আটক ভিক্ষুকদের ৯০ শতাংশই পাকিস্তানি। হজে ভিক্ষুক-পকেটমার না পাঠাতে পাকিস্তানকে সতর্কবার্তা দিয়ে সৌদি আরব বলেছে, তাদের কারাগারগুলো পাকিস্তানি বন্দি দিয়ে পরিপূর্ণ। সংবাদটি চোখে পড়ার পরক্ষণেই গত কয়েক দশকে পাকিস্তান নামক দেশটির নেচিবাচক সৃজন ও প্রত্যাহিক অবনমনের নানা ঘটনা সিনেমার রিলের মতো করে চোখের সামনে ভেসে উঠল। একটি দেশ! যার কোথাও, কোনো স্থানে জীবনের নিরাপত্তা নেই, মৌলিক অধিকার তো দূরের কথা। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, জীবনাধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়ন, লৈঙ্গিক সমতাসহ সুশাসনের সূচকগুলো সেখানে খুবই নাজুক। ফলে মানুষের জীবন ও মান তলানিতে এসে ঠেকেছে। তবে সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দেশটিতে জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই; না ঘরে, না মসজিদে বা সামাজিক কোনো সম্মিলনে। ভয়েস অব অ্যামেরিকার তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের প্রথম ৯ মাসে পাকিস্তানে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ সাত শতাধিক বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। হত্যা আর ক্যুর মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠান এবং অবসান বা পতন, এটিই যখন একটি দেশের কালানুক্রমিক প্রথা হয়ে দাঁড়ায়, তখন দেশটি নিজের ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে বিশ্বনাগরিকের জন্যও অনিরাপদ হয়ে ওঠে। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান মার্শাল ল জারির মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন; বিগত ৬৫ বছরে সেই মন্দচর্চার ধারাবাহিক অনুসরণ ও অনুকরণই পাকিস্তানকে আজ অতলান্তিক পতনের দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে। সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারী রাজনৈতিক শাসন দেশটির রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের কার্যকর অংশগ্রহণকে ঝুঁকিপূর্ণ করার পাশাপাশি সে দেশের রাজনৈতিক বহুত্ববাদ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক স্থায়িত্বসহ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সংহতি ও সহনশীলতাকে বিপন্ন করে ফেলেছে। ফলে নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি জনগণের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অধিকারও আজ খাদের কিনারায় এসে ঠেকেছে, যা মোটা দাগে মানবাধিকার ও উন্নয়নের সব পথ রুদ্ধ করে দেয়। পরিসংখ্যান বলছে, ধাপে ধাপে ৩৩ বছর সামরিক শাসন চলেছে দেশটিতে এবং সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক জঙ্গিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, সে কথাও উঠে এসেছে নানা গবেষণায়।
ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা পাকিস্তানের গায়ে যেসব কারণে লেগেছে, তার অন্যতম হচ্ছে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অবনমন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে,Pakistan is experiencing severe economic challenges reflecting long-standing structural weaknesses. /PakistanÕs economy is currently under severe stress with low foreign reserves, a depreciating currency, and high inflation| তাছাড়া, শাসকশেণির মধ্যে ন্যায়পরায়ণতার অভাব, প্রশাসনিক দুর্নীতি, ঘন ঘন সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকট এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছ থেকে গৃহীত ঋণ পরিশোধের অক্ষমতা দেশটির অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে আরো ঘণীভূত করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত ৩৫ বছরে আইএমএফ পাকিস্তানকে ১৩ বার বেইল-আউট করেছে। আসলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা পাকিস্তানের এই রুগ্ণ অর্থনীতির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। প্রতিহিংসা ও সহিংসতাপ্রবণ নেতৃত্ব দেশটিকে বিশ্ব পর্যায়েও একটি ভারসাম্যহীন ইমেজ বা ট্যাগ দিয়েছে।
সুশাসনের জন্য জ্ঞান, তথ্য ও শিক্ষার অন্তর্ভুক্তিমূলক অধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো সর্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশটির অধিকাংশ প্রান্তে তালেবানি দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায়। তাছাড়া দেশটির সামাজিক কাঠামো অত্যন্ত সামন্ততান্ত্রিক ও নিপীড়নমূলক। অথচ সামাজিক উন্নয়নের চেয়ে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করাকে পাকিস্তান বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করে। নারী শিক্ষার দাবিতে সোচ্চার মালালা ইউসুফজাইয়ের কথা আমাদের সবার স্মরণে আছে। তাকে হত্যাচেষ্টার পরেই জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবানের মুখপাত্র এহসানুল্লাহ এহসান সেই ঘটনার দায় স্বীকার করে এবং মালালাকে ‘বিধর্মী ও অশ্লীলতার প্রতীক’ হিসেবে আখ্যা দেয়। সে সময় তারা তাকে আবারও আক্রমণ করবে ঘোষণা দেয়। সে ঘটনায় আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে পাকিস্তান সরকার ১০ জনকে গ্রেফতার করে। আদালতের সন্ত্রাসবিরোধী বিভাগে বিচারও হয়। বিচার শেষে আজীবন কারাদ-প্রাপ্ত ১০ আসামির মধ্যে আট জনকে কয়েক সপ্তাহ বাদে গোপনে ছেড়ে দেয় সরকার, যা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিবাদের একটি প্রোজ্জ্বল উদাহরণ।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও মৌলবাদী মানসিকতা পাকিস্তানকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। The Institute for Conflict Management, New Delhi, Bharat-এর তথ্য বলছে, ৬ মার্চ ২০০০ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে ১৬ হাজার ৩৪৮টি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী হামলা হয়েছে, যাতে প্রাণ গেছে ৬৬ হাজার ৯০৫ জনের। যদিও এই তথ্য শুধু গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে সমন্বিত। কয়েক দিন আগে ২৯ সেপ্টেম্বর ঈদে মিলাদুন্নবি (স.) উপলক্ষ্যে আয়োজিত মিছিলে ভয়াবহ বোমা হামলায় অন্তত ৫২ জন নিহত হয়েছে। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের বিরুদ্ধে একটি পুরোনো অভিযোগ যে, তারা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে প্রতিপালন ও জনবল সরবরাহ করে। কারণ এসব জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসআইয়ের শ্যাডো-মিলিটারি ফোর্স হিসেবে কাজ করে এবং বিভিন্ন প্রক্সি-ওয়ারের নেতৃত্ব দেয়। United States National Security Council (NSC)-এর দায়িত্বশীল সদস্য ড্যানিয়েল বেঞ্জামিন ও স্টিভেন সাইমনের এ বিষয়ে একাধিক প্রতিবেদন রয়েছে। সর্বোপরি দেশটিতে রাষ্ট্রযন্ত্র ও জঙ্গিতন্ত্র মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ফলে শান্তি ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার সূচকে তলানিতে দেশটির অবস্থান। আসলে সৃষ্টিলগ্ন, অর্থাৎ ১৯৪৭ সাল থেকেই পাকিস্তানে মানবিক সংস্কৃতির কোনো সৃজন হয়নি। জীবনমুখী সংস্কৃতির সংকট দেশটির সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মনস্তত্ত্বে সদাচারের সংকট তৈরি করেছে। দীর্ঘকালে সেই সংকট আজ বিষবৃক্ষে রূপ লাভ করেছে। রক্ত আর সহিংসতায় সৃজিত হয়েছে দেশটির ইতিহাস ও পরিচয়। ফলে শান্তির চেয়ে সহিংসতাই তাদের বড় প্রিয়। জীবন নয়, যুদ্ধই তাদের লক্ষ্য। অসাম্প্রদায়িকতা সেখানে বেআইনি। সব ধর্মের সহাবস্থান ও মর্যাদা সেখানে অলীক।
অথচ আজ উদার গণতন্ত্র, মঙ্গল রাষ্ট্র, মুক্ত মত, মুক্ত পথের বিশ্বে মানুষের বসবাস। এখানে ব্যক্তি সংস্কৃতি গিয়ে মেশে বিশ্বসংস্কৃতির উন্মুক্ত উদ্যানে। এখানে নারী-পুরুষ সমানে সমান। এখানে ব্যক্তি অধিকার সংরক্ষিত হয় সামাজিক, রাষ্ট্রিক তথা বৈশ্বিক দায় ও দায়িত্বে। কিন্তু পাকিস্তান মানুষের মাঙ্গলিক অধিকার ও মূল্যবোধকে লালন ও ধারণ করতে পারেনি; তা করার দায়িত্বও বোধ করেনি হয়তো কখনো; যার ফলে রচিত হয়েছে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের উপাখ্যান। ( সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক) লেখক :কলামিস্ট ও বিশ্লেষক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com