রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ১১:৪১ পূর্বাহ্ন

লোভাছড়া দেখার লোভ এবং জয়ন্তিয়া পাহাড়ের নিসর্গ

ফয়সাল আহমেদ
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৩

১৮ আগস্ট, ২০২৩। দীর্ঘ বাসযাত্রা শেষে সিলেট পৌঁছাই সকাল সাড়ে ৮টায়। রাত সাড়ে ১১টায় রওয়ানা দিয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা বেশি সময় লাগে ২৬০ কি.মি. পথ পাড়ি দিতে। কারণ একটাই, পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি সড়ক দুর্ঘটনায় দীর্ঘ যানজটে আটকে থাকা। সকালেই বন্ধু খোকনকে দেখে ক্লান্তি অনেকটা দূর হয়ে যায়। বন্ধুত্বের আলাদা একটি সঞ্জীবনী শক্তি থাকে। সেই সঞ্জীবনী শক্তিতে ক্লান্তি দূর হয় এবং উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। এই উদ্দীপনা থাকতে থাকতে আমরা দু’জনে ভ্রমণের একটি নতুন গন্তব্য লোভাছড়া চা বাগান ও পাহাড়ি উপত্যকার নীল জলরাশিতে নৌকা ভ্রমণের পরিকল্পনা করে ফেলি। খোকনের বাসা সিলেট বাস টার্মিনাল থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে। সে বাসায় ফিরে যায়। অল্পক্ষণের মধ্যে হোটেলে আসবে। হোটেলে স্নান ও খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ায় যাত্রাজনিত ক্লান্তি দূর হয়। এর মধ্যে খোকনের সহকর্মী বন্ধু নুর মোহাম্মদও তার কর্মস্থল ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে রওয়ানা হয়ে গেছেন। আমি বন্ধু হাবিব ভাইকেও ফোনে আমন্ত্রণ জানাই। বন্ধের দিন শুক্রবার থাকায় সবাইকে স্বল্প নোটিশেই পেয়ে যাই। হোটেলে চলে আসে খোকন, হাবিব ভাই এবং নুর মোহাম্মদ। খোকন ও নুর মোহাম্মদ যে সিএনজি নিয়ে আসেন তার মালিক ও চালক সুখীত ভাইও আমার পূর্ব পরিচিত। বন্ধুজন। সুখীত ভাইয়ের খানিকটা পুরনো এই সিনএজি নিয়েই আমরা কানাইঘাটের লোভাছড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি।
সিলেট থেকে কানাইঘাট যাওয়া যায় ৩টি পথে। একটি জকিগঞ্জের শাহবাগ হয়ে। একটি গোলাপগঞ্জের বাঘা হয়ে। আরেকটি জয়ন্তিয়াপুর হয়ে। আমরা জয়ন্তিয়াপুর হয়েই যাত্রা করলাম। প্রায় ৩০ কি.মি. চেনা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা অচেনা কানাইঘাটের ছোট পথে ঢুকে পড়ি। এই পথের পুরোটাই ছিল এবড়ো থেবড়ো। তাই বেশ কষ্ট হলো মূল গন্তব্যে পৌঁছাতে। ইতোমধ্যে মেঘালয়ের জয়ন্তিয়া পাহাড় আমাদের বেশ কাছে চলে এসেছে। বিশাল পাহাড়ের সারি আমাদের আমন্ত্রণ জানায় আরো কাছে যাওয়ার জন্য। তখনও আমাদের গন্তব্য আরো ১৫-১৬ কি.মি. বাকী। একটি দুই রাস্তার বাঁকে এসে স্থানীয় এক অটোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করায় সে বললো, কানাইঘাট শহর হয়ে নৌকা নিয়ে যাওয়া যায়। আবার চিন্তারবাজার হয়েও যাওয়া যায়। এখান থেকে দূরত্ব একই। তবে রাস্তা খারাপ কানাইঘাটের দিকে। রাস্তার কথা বিবেচনা করে আমরা চিন্তারবাজার হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু এই রাস্তা প্রথমে ভালো থাকলেও শেষে ভয়ানক খারাপ দেখতে পাই। সিএনজির দুলুনীতে আমাদের নাভিশ্বাস অবস্থা। অভিজ্ঞ সুখীত ভাই নির্বিকারভাবে চালিয়ে যান। দেখতে পাই লোভাছড়া চা বাগানের ঢোকার একটি গেইট। আমরা যেহেতু নৌকায় যাত্রা করব তাই চা বাগানের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করিনি। আমাদের মাথায় একটাই চিন্তা, কীভাবে চিন্তারবাজার যাওয়া যায়। একটি প্রাইমারি স্কুলের সামনে এসে আমরা আর সুখীত ভাইয়ের বাহন নিয়ে যেতে ভরসা পেলাম না। এর মধ্যে সুখীত ভাইয়ের সিএনজির সামনের চাকার নাটবল্টু জাতীয় কিছু একটি পড়ে গেল। গাড়ি থামিয়ে তিনি চাকা চেকও করলেন। কিছু বললেন না। সিদ্ধান্ত হয়, সুখীত ভাই কানাইঘাট বাজারে চলে যাবে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে চিন্তারবাজার যাব। সেখান থেকে নৌকা নিয়ে লোভাছড়া ঘুরে একই নৌকায় আবার কানাইঘাট বাজারে ফিরে আসব।
আমরা সিনএজি ছেড়ে হাঁটতে থাকি। স্থানীয় একজন তরুণ সিএনজিতে আমাদের খানিকটা এগিয়ে দেয়। রাস্তা এখানে এতটা ভাঙ্গা যে স্থানীয় এই সিএনজিও এক সময় রণে ভঙ্গ দেয়। আবারো হাঁটা। বেশ খানিকটা হেঁটে এসে দেখি এই গ্রামের নাম নিহালপুর। ইউনিয়ন সুরইঘাট। আমাদের নৌকায় চড়তে হবে কিছুটা দূরের চিন্তারবাজার ঘাট থেকে।
অবশেষে সকল দুশ্চিন্তার অবসান হয়। আমরা চিন্তারবাজার এসে পৌঁছাই। চিন্তারবাজার এসে খুব বেশি চিন্তায় পড়তে হয়নি আমাদের। অল্প সময়ের মধ্যেই নৌকা পেয়ে যাই। যদিও স্থানীয় একজন বাইক চালকের কাছে চিন্তারবাজার কোথায় এবং আমরা যেসব স্থানে ঘুরে বেড়াব সেখানে নৌকা ভাড়া সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। সে তার মত করে তথ্য দিয়ে বাইক চালিয়ে চলে যায়। আমরা যখন চিন্তারবাজার ঘাটে এসে পৌঁছাই তখন দেখি পথে দেখা হওয়া সেই বাইকচালক আবারো চলে এসেছে। হাবিব ভাই ধরে ফেলেন চালাকি। আমরা বাইক চালককে বলি, আমরা রিজার্ভ নয়, লোকাল নৌকায় গুলাগুল পর্যন্ত যাব। লোকটি বুঝতে পারে এখানে সুবিধা করতে পারবে না। চলে যায়। এর মধ্যে একটি নৌকা ঘাটে ভেড়ে। বেশ লম্বা নৌকা। যেন বাইচ নৌকার ছোট সংস্করণ। পাহাড়ি নদীতে পাথর বা এ জাতীয় দ্রব্য পরিবহনের জন্য এ রকম নৌকা জাফলংয়েও দেখেছি। একজন মুরুব্বী দাঁড়িয়েছিলেন ‘গুলাগুল’ বাজারে যাবেন বলে। তিনিই নৌকা চালককে বলেন, আমাদের নিয়ে লোভাছড়া যাওয়ার জন্য। দেখলাম তিনি চালককে নাম ধরে ডাকছেন। তিনিই বললেন, মাঝি তাঁর পাশের বাড়ির ভাতিজা। মুরুব্বী জানালেন, তার গুলাগুল বাজারে ঔষধের দোকান আছে। আমাদের নৌকার মাঝির নাম নুরুল আমিন। নুরুল লোভাছড়া ঘুরিয়ে আনবে। দিতে হবে ১০০০ টাকা। আমরা দামাদামি করে ৮০০ টাকায় রফা করি। অন্যসময় হলে ১৫০০ টাকা লাগত।
যাত্রা শুরু হলো ‘লোভা নদী’র পথ ধরে ছড়ার উৎস সন্ধানে পাহাড়ের দিকে। ইঞ্জিন নৌকাটি অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের স্বচ্ছ নীল জলরাশি এবং দিগন্ত বিস্তৃত ছবির মতো সুন্দর পাহাড়ের অনেকটা কাছাকাছি নিয়ে যায়। আমরা সবাই মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি দিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতির দিকে। ইতোমধ্যে অবশ্য গুলাগুল বাজারে মুরুব্বী নেমে যান। নুরুল মাঝি নৌকার জন্য তেল নিয়ে আসে গুলাগুল বাজার থেকেই। আমরা আবার চলতে শুরু করি। কি অসাধারণ সেই দৃশ্য! দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ালেও এতদিন এখানে আসা হয়নি। প্রথাগত পর্যটন স্পট নয় বলে অনেকেই আসে না। অনেকে আসে না রাস্তাঘাট এবং প্রয়োজনীয় পর্যটন অবকাঠামো না থাকার কারণেও। আজ ছিল ভাদ্রমাসের প্রখর রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুর বেলা। তারপরও দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে নিজেদের ভালোলাগাগুলো একের পর এক ক্যামেরাবন্দী করতে থাকি আমরা। নুরুল মাঝি একসময় নৌকার গতি কমিয়ে বলে, ভারতের ঝুলন্ত ব্রিজ পর্যন্ত যেতে হলে বিডিআরের অনুমতি লাগবে। আপনারা ক্যাম্পে গিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারেন অনুমতি দেয় কি না। মাঝির পরামর্শে আমরা নদীর পাড় ঘেষে গড়ে তোলা চেকপোস্টে বিডিআরের হাবিলদারের সাথে কথা বলি। তিনি এক কথায় আমাদের বলেন, এখন যাওয়ার অনুমতি দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ বর্ষার কারণে নদী এখন ভরপুর। যাওয়ার পথে কখনো কখনো ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে যেতে হবে। তাই ঝামেলা এড়াতে আমরা কোনো পর্যটককে পারমিশন দিতে পারছি না। অবশ্যই যৌক্তিক কারণ। আমরা আর সময় নষ্ট না করে খানিকটা হতাশ হয়েই চলে আসি নৌকায়। অবশ্য শীত মৌসুমে নদীর পানি কমে গেলে পার ধরে ঝুলন্ত ব্রিজ বা জিরোপয়েন্ট পর্যন্ত যাওয়া যায়। এবার ফেরার পালা। ফেরার পথে আমরা লোভাছড়া চা বাগানের বাংলো এবং ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে একটি সিঁড়ি বাঁধানো ঘাটে নামি। চা বাগানের ভেতরের বাংলোয় ঢুকতে বাঁধা দেওয়া হয়। বলা হয়, পাবলিক প্রবেশ নিষেধ।
অবশ্য এই বাগানের মালিক ‘নানকা সাহেব’ আবার হাবিব ভাইয়ের পূর্ব পরিচিত। কিন্তু হাবিব ভাই মোবাইলে নম্বর খুঁজে পান না। নানকা সাহেবের সাথে আবার হাবিব ভাইয়ের পরিচয় বন্ধু সাংবাদিক সংগ্রাম সিংহের মাধ্যমে। আমি হাবিব ভাইকে বলি, সংগ্রামদার কাছে মোবাইল নম্বর পেতে পারেন। আমি সংগ্রামদা’কে ফোন করি। তিনি দ্রুত ম্যাসেঞ্জারে নম্বর পাঠিয়ে দেন। ফোন দিই নানকা সাহেবকে। আমি প্রথমে কথা বলি। এরপর হাবিব ভাই কথা বলেন। হায়! তিনি সিলেট। তাই এবার আর যাওয়া হলো না ঐতিহাসিক লোভাছড়া চা বাগানের অভ্যন্তরে। লোভাছড়া চা বাগানের ঐতিহাসিক কিছু গুরুত্ব রয়েছে। এটিই এখন পর্যন্ত বিদেশী কারো মালিকানাধীন চা বাগান। তিন প্রজন্ম পর এখনকার বর্তমান স্কটিশ মালিকের নাম জেমস ফার্গুসন ওরফে নানকা। তিনি শুধু ব্যবসায়ী নন, এলাকার জনপ্রিয় ব্যক্তিও বটে। তিনবার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছিলেন। সিদ্ধান্ত হয় আমরা চারজন ছাড়াও বন্ধু সংগ্রাম সিংহসহ সম্ভব হলে একরাত মুক্তিযোদ্ধা নানকা সাহেবের বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে আড্ডার আয়োজন করব। চা বাগান থেকে আবার নৌকায় চড়ে বসি। এবার শেষ গন্তব্য কানাইঘাট। প্রায় ১৫ মিনিটের যাত্রায় আমরা কানাইঘাট শহরের একটি ঘাটে নেমে আসি। নুরুল মাঝির সাথে অল্পক্ষণের সঙ্গ আমাদের ভালো লাগে। তার ফোন নম্বর নিয়ে আসি এবং বলি, আবার আসলে আপনাকে নিয়েই বেড়াব।
আমি দ্বিতীয়বারের মতো কানাইঘাট আসলাম। পূর্বে স্কুলে পড়া অবস্থায় কানাইঘাট বাজার থেকে ‘ভারতীয় জিনিসপত্র’ কেনার জন্য এসেছিলাম জকিগঞ্জের এক বন্ধুকে নিয়ে। তখন মনে হয়েছিল সিলেট থেকে কানাইঘাট দিল্লীর মত দূরের কোন গন্তব্য। এত বছর পরে এসে কানাইঘাট থানা শহরের তেমন কোনো পরিবর্তন দেখি না। শহরের খানিকটা বিস্তৃতি এবং মানুষজন বেড়েছে এই যা। আমরা একটি রেস্তোরাঁয় প্রচ- ঝাল দিয়ে তৈরি ২ ধরনের শুটকি ভর্তা, ছোট মাঝের ঝোল দিয়ে দারুণ এক আহার সারি।
ঐতিহ্যগতভাবে জয়ন্তিয়া এলাকার মানুষ ঝাল বেশি খান। জয়ন্তিয়া পরগণা বলতে আজকের জয়ন্তিয়াপুর ছাড়াও গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জকিগঞ্জ এবং কানাইঘাট নিয়ে বিস্তৃত ছিল। টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে যাত্রা করলে দেখতে পাব সাহসী ও যোদ্ধা জয়ন্তিয়ার অধিবাসীগণ বিভিন্ন আগ্রাসনকারী এবং সর্বশেষ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন রাজ্য টিকিয়ে রেখেছিল ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত। সেই সময়ে জয়ন্তিয়া রাজ্যের বিস্তৃতি আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জয়ন্তিয়া পাহাড়ের সন্নিহিত বিশাল বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ছিল। যার একটি কেন্দ্রস্থল ছিল আজকের এই জয়ন্তিয়াপুর শহর। বর্তমানে জয়ন্তিয়া হিলসের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের জোয়াই শহর।
আবারো সুখীত ভাইয়ের সিএনজি নিয়ে ফেরার পথ ধরি। শাহবাগ হয়ে চারখাই নামক তিন রাস্তার মোড়ে চা বিরতি এবং খানিকক্ষণ আড্ডা। এখান থেকে গোলাপগঞ্জ হয়ে সিলেট পৌঁছাতে রাত প্রায় ৮টা বাজে। সকলেই ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত দীর্ঘ এই যাত্রায়। আমি যেন খানিকটা বেশিই ক্লান্ত। গতরাত থেকেই যাত্রার উপরে আছি। নুর মোহাম্মদ বিদায় নিয়ে চলে যান তার কর্মস্থল ফেঞ্চুগঞ্জে। আজ তার অফিসের সহকর্মীরা হাকালুকি হাওড়ে একটি নৌভ্রমণের আয়োজন করেছে। এটি তারই প্রস্তাবিত ভ্রমণ। তারপরও তিনি সারাদিন আমাদের চমৎকার সঙ্গ দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন ফেঞ্চুগঞ্জে। হয়ত শেষ পর্ব রাতের আহারে অংশ নিতে পারেন। খোকন ও হাবিব ভাই চলে যান যার যার নীড়ে। সুখীত ভাইকে বিদায় জানিয়ে আমিও ফিরে আসি আমার অস্থায়ী নীড়ে।-।। রাইজিংবিডি.কম




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com