শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৩৫ অপরাহ্ন

চৌরঙ্গী

শংকর
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৩

(শংকর এক জন জনপ্রিয় লেখক । তাঁর আসল নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়তাঁর ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘জনঅরণ্য’ কাহিনী অবলম্বনে ছবি বানিয়েছেন। তাঁর ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসটিও সিনেমা হয়েছে। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়করেছেন উত্তম কুমার। সেই প্রসঙ্গে শংকর বললেন, ‘সত্যজিৎই আমাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে।’
১৯৩৩ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায়দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে যান কলকাতার ওপারে হাওড়ায়। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড?াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে কখনও ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনও প্রাইভেট টিউশনি, কখনও শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। এক ইংরেজের অনুপ্রেরণায়শুরু করেন লেখালেখি। ‘বোধোদয়’ উপন্যাস প্রকাশের পর শংকরকে উৎসাহবাণী পাঠান শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলেছিলেন ‘ব্রাইট বোল্ড বেপরোয়া’। ভাবনা বা প্রকাশভঙ্গিতে তাঁর এই উপন্যাস নিজের অন্য লেখালেখি থেকে অন্য রকম হওয়ায় তিনি তা পড়তে দিয়েছিলেন মুম্বইনিবাসী শরদিন্দুকে। শরদিন্দু সেই লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এই লেখায়জননী জন্মভূমিকেই আমি সারাক্ষণ উপলব্ধি করলাম।’ পাঠকমহলের ‘নিন্দা ও প্রশংসার ডালি নিয়ে আমি নিজেও এক সময়‘বোধোদয়’কে ভালবাসতে শুরু করেছি’, বলেন মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি আশি পেরিয়েছেন শংকর। এখনও সমান তালে লিখে চলেছেন। ইদানীং তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। স্বামীজির জীবনের অনেক না জানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে শংকরের লেখায় আমি বিবেকানন্দ বলছি, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ। শংকরের লেখা বই আজও বেস্ট সেলার।)
ইন্টারনেটের সৌজন্যে খবরপত্রের পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হলো।- বি.স
(পূর্ব প্রকাশের পর)
ডাক্তার সাদারল্যান্ডের ব্যবহারে এমন একটা আন্তরিকতার সুর ছিল যে
বলবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
গুড়বেড়িয়া ডিউটি শেষ করে চলে গিয়েছে। তার জায়গায় ঘন্টার ডাকে যে এল, তার নাম জানি না। তাকে নম্বর ধরে ডাকি আমরা। সে এসে সেলাম করে দাঁড়াতেই ডাক্তার বললেন, দু গ্লাস পাইন-আপেল জুস প্লিজ।
আবার সেলাম করে সে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু সাদারল্যান্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে, দাঁড়াতে বললেন। এতক্ষণে আমারও নজর পড়ল। তার সারা মুখে বসন্তের দাগ। কিন্তু ডাক্তার সাদারল্যান্ড যেন হাঁ করে কোনো আশ্চর্য জিনিস দেখছেন।
জিজ্ঞাসা করলেন, কবে হয়েছিল?
বেয়ারা লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল। কোনোরকমে বললে, অনেকদিন আগে সায়েব।
ছোটবেলায়?
আজ্ঞে, হাঁ সায়েব।
টিকে নিয়েছিলে? সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন।
না সায়েব, টিকে নেবার আগেই হয়েছিল।
আই সি। সাদারল্যান্ড সায়েব বললেন।
বেয়ারা অর্ডার তামিল করতে বেরিয়ে গেল। সাদারল্যান্ড আমাকে বললেন, ভগবান ওকে যে মুহূর্তে দয়া করেছেন। আর একটু হলেই চোখ দুটো যেত।
একটা সাধারণ হোটেল-বেয়ারার জন্য একজন অপরিচিত বিদেশি যে এতখানি অনুভব করতে পারেন, তা নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না।
মনের ভাব আমার পক্ষে চেপে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। বলে ফেললাম, লোকটি আপনার কথা হয়তো চিরদিন মনে রাখবে। কোনোদিন হয়তো এই হোটেলের কোনো অতিথি এমন আন্তরিকভাবে তাকে প্রশ্ন করেননি।
ডাক্তার সাদারল্যান্ড চমকে উঠে আমার দিকে ফিরে তাকালেন। মনের ভাব চেপে রাখার জন্যই যেন বললেন, মাই ডিয়ার ইয?ং ম্যান, সব না জেনেশুনে ওই রকম মন্তব্য করে বসাটা উচিত নয়। এই হোটেলের অতীতের কতটুকু আর আমাদের জানা আছে? তাছাড়া আমি একজন ডাক্তার। এপিডেমিয়োলজিস্ট। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আমাকে যে মাইনে দিয়ে পুষছেন, গাড়িভাড়া এবং পথের খরচ দিয়ে দেশ-বিদেশে পাঠাচ্ছেন, তার একমাত্র কারণ, তারা আশা করেন, মানুষের রোগ সম্বন্ধে আমি খবর নেব। সংক্রামক ব্যাধির হাত থেকে পৃথিবীর মানুষদের চিরকালের জন্য মুক্ত করবার চেষ্টা করব, তাই না?
ডাক্তার সাদারল্যান্ড চুপ করলেন। কিন্তু তিনি যে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন, তা বুঝতে পারলাম।
কোল্ড ড্রিঙ্ক হাজির হওয়ার পর, সাদারল্যান্ড জিজ্ঞাসা করলেন, এই হোটেলে তুমি কতদিন কাজ করছ?
বেশি দিন নয়। আমাকে বলতে হল।
তুমি হোটেলের বার-এ গিয়েছ? সাদারল্যান্ড জিজ্ঞাসা করেছেন।
বার-এ আমার এখনও ডিউটি পড়েনি। তবে এমনি গিয়েছি অনেকবার।
সাদারল্যান্ড এবারে আমাকে যে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন, তার জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। বললেন, আমার একটা বিষয়ে জানবার আগ্রহ আছে। বলতে পারো, তোমাদের বার কি হোটেলের গোড়াপত্তন থেকে ওই একই জায়গায় আছে, না মাঝে মাঝে স্থান-পরিবর্তন হয়েছে?
বললাম, আমাদের বার-এর জায়গাটা তো খারাপ নয়। কেন, আপনার কি কোনো সাজেশন আছে? তা হলে মিস্টার মার্কোপোলোকে জানাতে পারি।
সাদারল্যান্ড মাথা নাড়লেন। আমার কোনো সাজেশন নেই। আমি শুধু জানতে চাই, বারটা ঠিক ওইভাবে কতদিন আছে?
সে-কথা বলা শক্ত। হোটেল বাড়িটা সিম্পসন সায়েবের হাতছাড়া হয়ে বহুজনের হাতে হাতে ঘুরেছে। প্রত্যেক নতুন মালিকই নিজের খেয়াল অনুযায়ী পরিবর্তন করেছেন। বাইরের খোলসটা ছাড়া, শাজাহান হোটেলের ভিতরের কিছুই আজ অক্ষত নেই।
সাদারল্যান্ড বললেন, আমি খুব পিছিয়ে যেতে চাই না। ধরো, গত শতাব্দীর শেষের দিকে। অর্থাৎ কলকাতায় যখন বারমেডরা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে পানীয় বিক্রি করত।
ঠিক সেই সময় বেয়ারা এসে বললে, বোসদা আমাকে খুঁজছেন।
আমি বোসদাকে এখানে আসতে বললাম। তিনি এখানে আমার থেকে অনেক বেশি দিন রয়েছেন। হয়তো সাদারল্যান্ডের কৌতূহল মেটাতে সমর্থ হবেন। ঘরে ঢুকেই বোসদা বললেন, রাত্রে আপনার ঘুম হয়েছিল তো? যদি সম্ভব হয়, আজ তিনতলার একটা ঘর আপনাকে দেবার চেষ্টা করব। সাদারল্যান্ড কিন্তু বিশেষ আগ্রহ দেখালেন না। তিনি শাজাহান হোটেলের পুরনো দিনে ফিরে যেতে চাইছেন। সব শুনে বোসদা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হবস সায়েবের সঙ্গে তোমার আলাপ আছে?
তার সঙ্গে সামান্য পরিচয় আগে থেকেই ছিল। সেদিন এক ডিনার পার্টিতে এসেছিলেন। কাউন্টারে এসে আমার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলেছিলেন।
বোসদা বললেন, হোটেল সম্বন্ধে সত্যিই যদি কিছু জানতে চাও তা হলে ওঁর কাছে না গিয়ে উপায় নেই।
ডাক্তার সাদারল্যান্ড বললেন, তুমি কি জানো, কখনও এই হোটলে বারমেড রাখা হতো কিনা?
বোসদা বললেন, ইংরিজি সিনেমাতে অনেক দেখেছি। যুবতী মহিলা বার-এ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ড্রিঙ্কস সরবরাহ করছেন। কিন্তু আশ্চর্য, এখানকার কোনো হোটেলে তেমন তো দেখিনি।
আমি বললাম, সত্যি তো, বাইরে থেকে ক্যাবারের জন্য সুবেশা তরুণীরা আসছেন; সঙ্গীত ও নৃত্যনিপুণাদের জন্য প্রচুর অর্থব্যয় করছি আমরা, অথচ বার-এ তো একজনও মহিলা রাখা হয়নি।
বোসদা বললেন, বুদ্ধিটা মন্দ নয়ত। মার্কোপোলোর মাথায় একবার লাগিয়ে দিলে হয়।
বিষণ্ণ ডাক্তার সাদারল্যান্ড এবার একটু হাসলেন। আই অ্যাম অ্যাফ্রেড, তোমাদের ম্যানেজারের মাথায় বুদ্ধিটা ঢুকলেও কিছু লাভ হবে না। কারণ এদেশে কোনো বার-এ মহিলা নিয়োগ করা বে-আইনি। তোমাদের এক্সাইজ আইনে লেখা আছে, যে-বাড়িতে মদ বিক্রির লাইসেন্স দেওয়া হবে, সেখানে কোনো মহিলার চাকরি করা সরকারের বিনা অনুমতিতে নিষিদ্ধ।
আমাদের দেশের আবগারি আইনে তার দখল দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ভাবলাম, ভরতবর্ষের কোথাও প্রহিবিশন আইনের কৃপায় সায়েব বোধহয় পুলিসের খপ্পরে পড়েছিলেন। তখনই বোধহয় বিভিন্ন রাজ্যের বার-লাইসেন্স-এর নিয়মগুলো মুখস্থ করেছিলেন।
সাদারল্যান্ড জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের বার-লাইসেন্সটা কখনও পড়ে দেখেছ?
হলদে রংয়ের সরকারি কাগজটা সযতেœ বার-এ রেখে দিতে দেখেছি। কিন্তু তার পিছনে কী যে লেখা আছে, তা জানবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমাদের কোনো দিন হয়নি।
সাদারল্যান্ড বললেন, দেখবে, ওখানে সরকার নির্দেশ দিচ্ছেন, পাঁচ আনার কমে কোনো ড্রিঙ্কস বিক্রি করা চলবে না!
পাঁচ আনা! এ-আইন কবেকার তৈরি? বোসদা বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেন।
সেই যুগে যখন এক বোতল স্কচ হুইস্কির দাম ছিল এক টাকা বারো আনা। তখন সবচেয়ে প্রিয় ব্র্যান্ড ছিল ডানিয়েল ক্রফোর্ড। মদ খেয়ে লিভার নষ্ট করে কেউ মারা গেলে লোকে বলতো, শ্রীযুক্ত অমুক ডানিয়েল ক্রফোর্ড রোগাক্রান্ত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন।
আমার সন্দেহ এবার ঘনীভূত হল। বললাম, আপনি কি বিভিন্ন দেশের বার নিয়ে কোনো বই লিখেছেন?
মোটেই না, ডাক্তার সাদারল্যান্ড উত্তর দিলেন। যদি একান্তই লিখিÍ স্মলপক্স সম্বন্ধে লিখব। মদ সম্বন্ধে লিখে অপচয় করবার মতো সময় আমার নেই।
টেলিফোনে হবস সায়েবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ঠিক হল; ভদ্রলোক গল্প করতে এবং শুনতে ভালোবাসেন। বোসদা বললেন, সময় থাকলে আমিও যেতাম। তুমি ডাক্তারকে নিয়ে যেও। বেলা আড়াইটা নাগাদ তিনি তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন।
সাদারল্যান্ডের ঘর থেকে বেরিয়ে বোসদাকে বললাম, এই যে ওঁকে নিয়ে যাব, তাতে কোনো কথা উঠবে না তো?
বোসদা রেগে উঠলেন। কে কথা তুলবে? হোটেলের জন্য রক্তপাত করে তারপর আমার খুশিমতো যদি কিছু করি, তাতে কারুর নাক গলাবার অধিকার নেই। কেন, কেউ কিছু বলেছে নাকি?
না, বলেনি। কিন্তু হয়তো কোনো আইন অমান্য করবার জন্য হঠাৎ চাকরি গেল।
চাকরি নষ্ট হওয়াটা এখানে কিছু নয়। কত লোক তো আমারই চোখের সামনে এল আর গেল। অক্ষয় বটের মতো আমিই শুধু গাট হয়ে বসে আছি। আমাকে কেউ নড়াতে সাহস করে না। হাটে হাঁড়ি ভাঙবার ক্ষমতা যদি কারও থাকে, তা এই স্যাটা বোসেরই আছে। আর এও বলে রাখলাম, ব্যাটা জিমি যদি তোমার কোনো ক্ষতি করবার চেষ্টা করে, তবে সেও বিপদে পড়বে। বোসদা যে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন তা বুঝতে পারলাম।
একটু থেমে বোসদা নিজের মনেই বললেন, আমরা কি আর মানুষ! আমাদের মধ্যে যাদের পয়সা আছে তাদের টাকায় ছাতা ধরছে। কয়েক পারসেন্ট সুদ নিয়েই আমাদের বড়লোকরা সন্তুষ্ট হয়ে আছেন। বেলা নটার সময় ঘুম থেকে উঠছেন, তারপর চা পান করে বিশ্রাম নিচ্ছেন। বিশ্রাম শেষ করে মধ্যাহ্ন ভোজন করছেন। মধ্যাহ্ন ভোজনের পর আবার বিশ্রাম নিচ্ছেন। তারপর উঠে জলখাবার খেয়ে গড়গড়া টানছেন। তারপর একটু গড়ের মাঠে হাওয়া খাওয়া। ফিরে এসে আবার বিশ্রাম। বিশ্রাম শেষ করে ভোজন পর্ব। তারপর আবার বিশ্রাম। নিজের বংশ ছাড়া ওঁরা কিছুই বাড়ালেন না। তা যদি করতেন, তা হলে স্যাটা বোস দেখিয়ে দিত মেড-ইন-ক্যালকাটা ছোঁড়ারা হোটেল চালাতে পারে কি না। যাদের বুদ্ধি আছে, পরিশ্রমের ক্ষমতা আছে, মাসিক কয়েকখানা নোটের বদলে তারা সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে বসে আছে। অথচ অন্যের কাছ থেকে ধার করা টাকা, আর আমাদের গতর নিয়ে দুনিয়ার লোকরা শুধু নিজেদের নয়, নিজেদের ভাগ্নে, ভাইপো, জামাই সবার ভাগ্য ফিরিয়ে নিলে।Íবোসদা এবার দুঃখে হেসে ফেললেন।
এ-সব কথা এখানে বলে যে কোনো লাভ নেই, বুঝি। চৌরঙ্গীর মনুমেন্টের তলায় দাঁড়িয়ে যদি বলতে পারতাম, তা হলেও হয়তো কিছু কাজ হতো, কিন্তু সে সুযোগ আর আমাদের কী করে জুটবে বলো।
বুড়ো হবস সায়েবের ওখানে যাচ্ছ তাহলে? লাঞ্চের সময় বোসদা জিজ্ঞেস করেছিলেন।
সরকারিভাবে লাঞ্চ আরম্ভ হয় সাড়ে বারোটা থেকে। কিন্তু কর্মচারীদের খাওয়া তার আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়া সেরে, তবে তারা লাঞ্চরুমের দরজা খুলে দেয়। বাইরের ব্যস্ত অতিথিরা তখন আসতে শুরু করেন। ক্লাইভ স্ট্রিটের সায়েবদের অপচয় করবার মতো সময় দুপুরবেলায় থাকে না।
হোটেলের বাসিন্দারা অনেকে একটু দেরিতে আসেন। লাঞ্চরুমে ঢোকবার আগে, অনেকে বার-এর কাউন্টারেও খানিকটা সময় কাটিয়ে যান। কেউ আবার সোজা লাঞ্চরুমে গিয়ে লাল পট্টি জড়ানো তোবারককে ডেকে পাঠান। শাজাহান হোটেল ডিক্সনারিতে তার নাম ওয়েট বয়। বোসদা কিন্তু বলেন, ভিজে খোকা! ভিজে খোকা সায়েবের সেলাম পেলেই ছুটে আসে। সায়েব সাধারণ ঠান্ডা বিয়ার অর্ডার দেন। বিয়ারের মগে চুমুক দিতে দিতে গরম সুপ এসে যায়। দূরে গোমেজ সায়েবের ইঙ্গিতে শাজাহান ব্যান্ড বেজে ওঠে। পাঁচটা ছোকরা এক সঙ্গে তাদের সামনের কোরের উপর ঝুঁকে পড়ে যন্ত্রসঙ্গীত আরম্ভ করে দেয়।
গোমেজ কন্ডাক্টর। বোসদা বলেন, ব্যান্ডপতি-কখনও আবার আদর করে ব্যান্ডোস্বামী বলেন। গোমেজ তার পাঁচটি ছেলেকে নিয়ে সবার আগে প্রাইভেট রুমে লাঞ্চের জন্য হাজির হন।
শেফকে বলেন, তাড়াতাড়ি যা হয় ব্যবস্থা করুন। শেফ আমাদের খাওয়ানোটাকে ভূতভোজন বলে মনে করেন। গোমেজ ব্যস্ত হয়ে পড়লে বলেন, অত ব্যস্ত হলে আমি পারব না।
গোমেজ বলেন, শাজাহান ব্যান্ড আজ লাঞ্চ আওয়ারে তাহলে বন্ধ থাকবে।
শেফ কপট উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আহা তাহলে সর্বনাশ হবে। কেবল বাজনা শোনবার জন্যেই তো কলকাতার নাগরিকরা বেলা একটার সময় নিজেদের কাজ ছেড়ে শাজাহান হোটেলে চলে আসেন!
গোমেজও ছাড়বার পাত্র নন। শেফ মিস্টার জুনোকে বলেন, গানই যদি বুঝবে, তা হলে হাঁড়ি ঠেলবে কেন?
শেফ তখন সবচেয়ে খারাপ কাচের বাসনপত্তরগুলো ওয়েটারদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলেন, গানের কিছু বুঝি না, কিন্তু এইটুকু জানি, পাখিরাও খাবার পর গাইতে পারে না। ভরাপেটে সঙ্গীতচর্চা একমাত্র শাজাহানেই সম্ভব।
গোমেজ তখন দলের ছেলেদের বলেন, বয়েজ, তোমরা আরম্ভ করে দাও। অনুগত ছেলেরা সঙ্গে সঙ্গে মুখে সুপ তুলতে আরম্ভ করে। গোমেজ তখন ন্যাপকিনটা কোমরে লাগাতে লাগাতে বলেন, পাখিদের সঙ্গে ওখানেই আমাদের তফাত। ওরা পেটের জন্যে গান করে না, আমরা শুধু পেটের জন্যেই এই ভরদুপুরে সঙ্গীতচর্চা করি।
কথা-কাটাকাটি হয়তো আরও এগুতো, কিন্তু বোসদা এসে টেবিলের একটা চেয়ার দখল করে বলেন, জুনো সায়েব, আমি গোঁড়া হিন্দু। আমার রিলিজিয়াস ফিলিঙে তোমরা হাত দিচ্ছ। খাওয়ার সময় আমাদের কথা বলা শাস্ত্রমতে নিষেধ। এখনই হয়তো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যাবে!
সকলেই হাসতে হাসতে কথা বন্ধ করে দেন। জুনো গদগদ হয়ে বলেন, স্যাটা, মজার কথার স্টক তোমার কি কখনও শেষ হবে না?
ডিয়ার জুনো সায়েব, আমার স্টক তোমার ওই ফ্রিজের মতো। তলার দিকে গোটা দশেক আইসক্রিম সব সময় লুকানো আছেÍবোসদা বলেন।
জুনো সায়েব হা হা করে হেসে ফেলেন। বলেন, গ্রীদি। গ্রীদি বয়েজ আর নত নাইস ফর হোতেল।
বোসদার পিঠে স্নেহভরে থাবড়া মেরে জুনোনা কিচেনের দিকে চলে যান। যাবার আগে বলেন, বোস্, একটা মেরেজ কোরো। হামরা পারবে না। দ্যা ভাই তোমাকে বয়েল করে ম্যানেজ করতে পারবে।
বোসদা হাসতে হাসতে বললেন, সায়েব, তোমার সেই পুডিং-এ স্যান্ড।
হোয়াত্ জুনো না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলেন।
তোমার সেই গুড়ে বালি। আমার বিয়েও হবে না, তোমার পাপের ভোগও শেষ হবে না। মুখের মধ্যে খাবার পুরতে পুরতে বোসদা বললেন।
আমি অবাক হয়ে ওঁদের কথাবার্তা শুনছিলাম। ওয়েটাররা খাবার আনতে একটু দেরি করছিল।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে গোমেজ যেন আঁতকে উঠলেন, লাঞ্চরুমের দরজা খুলতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে গোমেজ বললেন, গেট আপ বয়েজ। আর সময় নেই।
পাঁচটা ছেলে যেন বোবা। মুখে তাদের কথা নেই। এক সঙ্গে সেই অবস্থায় উঠে পড়ল।
ঘরের কোণে একটা ছোট্ট আয়না রয়েছে। তার উপর ইংরিজিতে লেখাঅস ও পড়ৎৎবপঃষু ফৎবংংবফ? তার নীচে খড়ি দিয়ে দুষ্টুমি করে কে বাংলায় লিখে দিয়েছে। আমি কি ঠিকভাবে জামা কাপড় পরিয়াছি?
ওরা সবাই একে একে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের টাইগুলো ঠিক করে নিতে লাগল। গোমেজ দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে রইলেন। লাইন বেঁধে মার্চ করে ওরা বেরিয়ে যেতে, দুটো হাত দোলাতে দোলাতে তিনিও ওদের শেষে লাইনে যোগ দিলেন।
বোসদা আর আমি তখনও বসে রইলাম। তিনি হেসে জুনোকে বললেন, মাই হেভেন-গন্ মাদার মরবার সময় বলেছিলেন, ফাদার সতু, থ্রি ওয়ার্লড রসাতলে গেলেও মুখের রাইস ফেলে উঠবে না। (সংকলিত)
——চলবে




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com