ব্রিটিশ প্রশাসক এলএসএস ও’মলি বিশ শতকের গোড়ার দিকে ইস্টার্ন বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স: চট্টগ্রাম-এ স্থানের নাম সম্পর্কিত একটি কিংবদন্তি সংকলিত করেন। গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর বন্দর শহর চট্টগ্রাম গ্রন্থে পীর বদর শাহ ও চাটিগাঁ-সংক্রান্ত লোকগাথাটি উপস্থাপিত হয়েছে নিম্নরূপে: চট্টগ্রামে মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে চট্টগ্রাম ছিল জিন-পরী অধ্যুষিত দেশ। পীর বদর শাহ এখানে আগমন করে অলৌকিক চাটির (মৃৎ-প্রদীপ) আলোর সাহায্যে জিন-পরীর বিতাড়িত করার ফলে এ স্থানের নাম হয় চাটিগাঁ। (পৃষ্ঠা ৩)
পীর-আউলিয়া ও সুফি-সাধকদের পুণ্যভূমি চট্টগ্রাম বাংলার সমুদ্র-তীরবর্তী একটি বসতি এবং বাণিজ্য বন্দর। ঝড়-ঝঞ্ঝায় বদর পীরের কেরামত ও দোয়ায় দরিয়া থেকে নিরাপদে ডাঙ্গায় আসা এবং বিপদে উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ বদর পীর সম্পর্কিত নানা লোকগাথা চট্টগ্রাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় প্রচলিত রয়েছে। লোকগাথার বাইরেও এ সমুদ্র বন্দরের নানা খবর পাওয়া যায় অষ্টম-দ্বাদশ শতকের আরব ভূগোলবিদ ও আব্বাসীয় প্রশাসকদের লেখায়। পীর বদর শাহের দরিয়াপাড়ের মানুষের সঙ্গে ইসলাম ও আব্বাসীয় বণিকদের যোগসূত্রের প্রমাণ এ রচনাগুলো। কিংবদন্তির নানা রূপ হয়তো ইতিহাসের সূক্ষ্ম নিক্তিতে মাপা হতে পারে। কিন্তু আব্বাসীয় আমলের এ লেখনীগুলো ত্রয়োদশ শতকের আগেই চট্টগ্রাম ও বাংলার সমুদ্র উপকূলে মুসলিম বণিকদের যাতায়াত ও বসতি স্থাপনের প্রমাণ। আব্বাসীয় আমলের ভূগোলবিদ সোলাইমান তার সিলসিলাত-উত-তাওয়ারিখ গ্রন্থে রাজা রুহমির (ধর্মপালের) বাংলা রাজ্যের সঙ্গে আরবদের বাণিজ্য সম্পর্কের সংবাদ প্রদান করেন। সোলায়মানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইবনে খুর্দাদ বিহ বাংলা সমন্দর বন্দরের নাম উল্লেখ করেন। এ বন্দরে কামরুন (কামরূপ বা বর্তমান আসাম, ভারত) ও অন্যান্য স্থান থেকে নদীপথে ১৫ দিনে চন্দন কাঠ আমদানি করা হতো। এ বন্দরের আরেকটি কৃষিজাত বাণিজ্য পণ্য হলো চাল। (আবদুল করিম, পৃষ্ঠা ৩১-৩১)। আন্দালুসিয়ার মানচিত্রবিদ আল ইদ্রিসিও সমন্দর বন্দর সম্পর্কে লিখেছিলেন:
সমন্দর একটি বড় শহর, বাণিজ্য কেন্দ্র এবং সমৃদ্ধিশালী স্থান যেখানে অনেক লাভবান হওয়া যায়।…কাশ্মীর দেশ থেকে আসা এক নদীর তীরে এটি অবস্থিত।…এ শহর থেকে নৌকায় একদিনের দূরত্বে জনপূর্ণ এক বৃহৎ দ্বীপ আছে, যেখানে সব দেশের ব্যবসায়ীরা রীতিমতো যাতায়াত করে। এটা সরন্দীপ থেকে চার দিনের দূরত্বে।…এটা একটা সুন্দর বাণিজ্য শহর, যা এ দেশের রাজাকে খ্যাতি দান করেছে। (আবদুল করিম, পৃষ্ঠা ৩৩)
হালফিলের গবেষণাগুলোয় এটি সর্বজনবিদিত যে আরব লেখকদের সামান্দার বন্দরটির অবস্থান ছিল বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার উপকূলের কোনো একটি স্থানে। বাণিজ্যিক সূত্র ধরে এ এলাকায় ইবনে বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ের আগেই (ত্রয়োদশ শতকপূর্ব সময়ে) চট্টগ্রাম বন্দরে মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে। বণিকদের পাশাপাশি ধর্মপ্রচারকরাও এ বন্দর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন। ফলে আরব বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সঙ্গে স্থানীয় ধর্মান্তরিত মুসলিমদের সমন্বয়ে এ এলাকায় একটি মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছিল দশম-দ্বাদশ শতাব্দী কালপর্বে। বাংলায় ইসলাম প্রচারের কালপর্ব নির্ধারনের আলোচনাটি দুটি ধারায় বিভক্ত। বখতিয়ার রাজ্য জয়ের আগে কি বাংলায় সুফিরা এসেছিলেন? ত্রয়োদশ শতকের আগে বাংলাদেশের কোথাও মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছিল কি? বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকা আদি পর্বে মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্পর্শ পেয়েছিল? এই বাহাসটি প্রায় শতাব্দীকাল ধরেই গবেষক মহলে বিদ্যমান।
মান্যবর এনামুল হক, আবদুল করিম এবং এমএ রহিম এ বিতর্কের নানা দিক পাঠক মহলে উপস্থাপন করেছেন। সুফিবাদের ইতিহাসে দেখা যায়, একাদশ শতকের শুরু থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত অসংখ্য সুফি বুখারা, সমরখন্দ, পারস্য, সিরিয়া ও আরব ভূখ- থেকে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন। এদের অনেকে সমুদ্রপথেও এসেছেন। অনেকেই স্থলপথে এসেছেন। এনামুল হক ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে সুফি আন্দোলন ও ইসলামের বিস্তারের ইতিহাসকে চারটি পর্বে ভাগ করেছেন: ক. প্রাথমিক পর্ব (১০০০-১১৫০) খ. প্রতিষ্ঠা পর্ব (১১৫২-১৪০০) গ. সংমিশ্রণের পর্ব (১৩৫০ থেকে ১৫৫০) এবং ঘ. সংস্কারপর্ব (১৫৫০-পরবর্তী সময়)। এ ইতিহাসবিদ চট্টগ্রাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় দশম শতক থেকেই মুসলিম বসতি গড়ে ওঠার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। এনামুল হক আরবীয় ও আরাকানি সূত্র বিশ্লেষণ করে দেখান যে অষ্টম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত আরব ব্যবসায়ীরা বাহর-উল-হরকন্দ (বঙ্গোপসাগর) উপকূলে অবস্থিত সমন্দর (চট্টগ্রাম বা সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত) বন্দরে বাণিজ্য ও বসতি স্থাপন করেছিল। এ সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে মেঘনার মোহনা থেকে পূর্ব দিকে নাফ নদী পর্যন্ত আরবদের রাজনৈতিক আধিপত্য ছিল। ইতিহাসবিদ মুহাম্মাদ আব্দুর রহিম সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল হিস্ট্রি অব বেঙ্গল গ্রন্থের প্রথম খ-ে বাংলা অঞ্চলে ইসলাম বিস্তার, মুসলিম বসতি স্থাপন, মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও স্থানীয় জনগণের ইসলাম ধর্ম গ্রহণসহ প্রাসঙ্গিক নানা বিষয় আকর সূত্র বিশ্লেষণপূর্বক পাঠক-গবেষক মহলে উপস্থাপন করেন। তিনি এনামুল হকের প্রস্তাবকে আরো অধিকতর ব্যাখ্যা করার জন্য নি¤েœাক্ত চারটি যুক্তি উপস্থাপন করেন: ১. প্রথম যুগের আরব ব্যবসায়ীরা বাংলার উপকূল সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল। ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলের প্রাচ্যদেশীয় আব্বাসীয় বাণিজ্য বলয় সুবিদিত। মালাবার, সিংহল, জাভা, সুমাত্রা, মালয়, বোর্নিয়াসহ এই জল-নেটওয়ার্কের অনেক দ্বীপেই মুসলিম ব্যবসায়ীরা বসতি স্থাপন করেছিল। সংগত কারণেই বাংলার ঐশ্বর্য এবং মূল্যবান পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এ আরব বণিকদের কিয়দংশ বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে বসতি স্থাপন করেছিল। ২. পঞ্চদশ শতকে বর্তমান বাংলাদেশের সন্দ্বীপ, হাতিয়া ও এ-সংলগ্ন উপকূলে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। কিন্তু বারথেমা ও বারবোসা মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত ‘বাঙলা’ শহরে অসংখ্য ইরানি, আরব ও আবিসিনীয় ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য মুসলিম বসতি দেখেছিলেন। কীভাবে এ বসতি স্থাপিত হয়েছিল? এটি প্রমাণ করে বাংলার উপকূলীয় এলাকায় তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম এবং সেই সূত্রেই তারা বসতি স্থাপন করেছিল।
৩. আরব বণিকদের আধিপত্যের স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে কিছু স্থান নাম: চট্টগ্রাম (সমন্দর), গাঙ্গেয় বদ্বীপ (শাত-আল-গঙ্গা), বার্মিজ আরকানি শব্দ থুরা-তন (সুলতান)। এ শব্দগুচ্ছ এ অঞ্চলে একটি মুসলিম রাজ্যের স্মৃতিবাহক। ৪. ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় বহু আরবি শব্দ, বাগধারা ও ভাষা প্রয়োগ রীতির সংমিশ্রণ রয়েছে। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকের চট্টগ্রামের একাধিক কবির রচনায় আরবি শব্দমালার প্রয়োগ দেখা যায়। এটি প্রমাণ করে, বাংলাদেশে মুসলিম রাজ্য বিজয়ের আগেই চট্টগ্রামকেন্দ্রিক আরব-মুসলিম বসতি ছিল। উপর্যুক্ত বৃহৎ প্রেক্ষাপটে মুহাম্মদ আব্দুর রহিম উপসংহার টানেন যে বাংলায় রাজনৈতিক বিজয়ের (১২০৪ সাল) আগেই ইসলামের প্রচার ও মুসলিম বসতি স্থাপিত হয়েছিল। তিনি বখতিয়ার পূর্ববর্তী সুফিদের তালিকায় (কিংবদন্তি ও লোক কাহিনীর অবলম্বনে প্রস্তুতকৃত) যাদের নাম শামিল করেছেন: বাবা আদম শহিদ (বিক্রমপুর, মুন্সিগঞ্জ), শাহ সুলতান রুমি (মদনপুর, কেন্দুয়া, নেত্রকোনা), শাহ সুলতান মাহিসোয়ার (মহাস্থান, বগুড়া), মখদুম শাহ দৌলা (পাবনা)। কিংবদন্তি অনুসারে, এ সুফিরা আরব বা ইরানের কোনো এলাকা থেকে সদলবলে বাংলাদেশে আসেন এবং স্থানীয় হিন্দু রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করেন কিংবা অলৌকিক শক্তি প্রদর্শন করে স্থানীয় অমুসলিম রাজাকে ইসলামে অনুরক্ত করেন।
আবদুল করিম, বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ইতিহাস (১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) গ্রন্থে উপর্যুক্ত প্রস্তাবের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের সুফি বাবা আদম শহিদ, শাহ সুলতান রুমি, শাহ সুলতান মাহিসোয়ার, মাখদুম শাহ দৌলাহ শহিদÍএই চারজন সাধক সম্পর্কিত স্থানীয় শ্রুতি বিশ্লেষণপূর্বক সিদ্ধান্ত নেন যে তারা সবাই মুসলিম বিজয়ের পরে; সম্ভবত মুসলিম শক্তি বিস্তারের প্রাথমিক বছরগুলোতে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোয় এসেছিলেন। পূর্ববর্তী গবেষকদের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা ত্রয়োদশ শতকের আগে মুসলিম বাণিজ্যবলয়-বসতি স্থাপন প্রস্তাব মেনে নিয়েই অধ্যাপক আব্দুল করিমের এই উপসংহার।
বদর পীর ছিলেন চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ইসলাম প্রচার ও জনমানসের পীর। যিনি লোকমুখে নানা কিংবদন্তির মাধ্যমে এখনো সমুদ্রযাত্রায় কিংবা বিপদে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গ বেয়ে অষ্টম শতক থেকেই বাংলা দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে ইসলাম প্রচার হতে থাকে। পাহাড়, জঙ্গল ও সমুদ্রের বিপদময় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে সাহস দেন সুফি-সাধক-পীর। কিংবদন্তির বুননে হাজির হন তারা নানা চরিত্রে। কখনো সমুদ্রে বা কখনো ডাঙ্গায়। কখনো উপকূলের ঝড়ে বা কখনো পাহাড়ের জিন-পরীর বালা কাটাতে। কিংবদন্তির সমান্তরালে থাকা আরব ও আরাকানি আকর সূত্র বলে দেয় সুলতানি যুগে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ প্রথম চট্টগ্রামকে সোনারগাঁ সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করলেও তারও প্রায় পাঁচশ বছর আগে এ এলাকায় মুসলিম বসতি তৈরি হয়েছিল। লেখক: শহিদুল হাসান: সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়