প্রত্যেক স্ত্রীই চান তার স্বামী যেন তাকে পর্যাপ্ত সময় দেন এবং কাছে থেকে তাকে ভালোবাসেন। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ- ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে জীবন যাপন করো (সূরা নিসা, আয়াত-১৯)। সদ্ভাব বলতে প্রতিটি মহৎ কাজ, কথা ও উত্তম চরিত্রকেই বুঝিয়েছে। স্ত্রীর সাথে সদ্ব্যবহার ও সঙ্গদানে রাসূল সা: ছিলেন পৃথিবীর সবার চেয়ে সেরা ও আদর্শিক ব্যক্তি। কারণ তিনি নিজেই বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তিই উত্তম যে তার পরিবারের কাছে ভালো। আর আমি আমার পরিবারের কাছে সবার চেয়ে ভালো ব্যক্তি’ (জামে তিরমিজি-৩৮৯৫)।
স্ত্রীর সাথে রাসূল সা:-এর ব্যবহার ও চালচলন অত্যন্ত মধুর ও ভালোবাসাপূর্ণ ছিল। ছিল স্নিগ্ধ, স্নেহশীল ও অমায়িক। যা তাঁর সিরাতের পাঠক মাত্রই অনুধাবন করতে পারেন। তাঁর বৈবাহিক জিবনের আদর্শ আজও মুসলিম সমাজের পথপ্রদর্শক এবং সেই জীবন চরিতের যথাযথ অনুসরণেই রয়েছে দাম্পত্য জীবনের শত সঙ্কট থেকে মুক্তি।
পবিত্র এই বন্ধন আজ কত হুমকির মুখে। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে দাম্পত্য জীবনের সমস্যা। সমাজ আজ যেসব দাম্পত্য সঙ্কটের মুখোমুখি এবং পত্র-পত্রিকায় পাতা খুললে চোখে পড়ে, তা দেখে সচেতন ব্যক্তিমাত্রই আঁতকে উঠতে হয়। শুধু ঢাকার দুই সিটির মেয়রের কার্যালয়ের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে তালাকের আবেদন এসেছিল মোট ১৩ হাজার ২৮৮টি। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে সাত হাজার ৬৯৮টি, উত্তর সিটিতে পাঁচ হাজার ৫৯০টি। এ হিসাবে রাজধানীতে প্রতিদিন ভেঙে যাচ্ছে প্রায় ৩৭টি দাম্পত্য সম্পর্ক, অর্থাৎ তালাকের ঘটনা ঘটছে ৪০ মিনিটে একটি করে। আর চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে আবেদনের সংখ্যা দুই হাজার ৪৮৮। বিয়েবিচ্ছেদ যে কয়েক বছর ধরে বাড়ছে, তা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যেও দেখা যায়। বেশি বাড়ছে শিক্ষিত দম্পতিদের মধ্যে। বিবিএসের ২০২১ সালের ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ বছর ধরে তালাকের হার ঊর্ধ্বমুখী। সবচেয়ে বেশি রাজশাহী বিভাগে, কম সিলেটে।
হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: ফজরের নামাজ আদায় করে সূর্যোদয় পর্যন্ত নামাজের স্থানে বসে থাকতেন। এরপর একজন একজন করে প্রত্যেক স্ত্রীর কাছে গিয়ে সালাম দিতেন ও দোয়া করতেন (আল-মুজামুল আওসাত-তাবারানি-৮৭৬৪)। এখানে খেয়াল করার বিষয় হলো, আল্লাহর রাসূল সা: প্রতিদিন সকালে এমনটি করতেন এবং এটিই ছিল দিনের শুরুতে তাঁর প্রথম কাজ। তাঁর স্ত্রীরা প্রতিদিন তাকে নিজের কাছে পেতেন।
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রাহ:) বলেন, রাসূল সা:-এর পক্ষ থেকে স্ত্রীদের জন্য দিনের শুরুতে থাকত সালাম ও দোয়া এবং দিনের শেষে থাকত তাদের সাথে বসা, আলাপচারিতা ও অন্তরঙ্গতা (ফাতহুল বারি-৯/৩৭৯)। হজরত আয়েশা রা: থেকেও এমনই বর্ণনা পাওয়া যায়। এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, রাসূলের স্ত্রীরা প্রতিদিনই তাঁর শুভ সান্নিধ্যে ধন্য হতেন। ফলে স্বামীর অনুপস্থিতি তাঁদেরকে ব্যথিত করত না। অথচ আমাদের সমাজে এমন বহু লোক আছে যারা স্ত্রীকে সঙ্গদানের হক যথাযথ আদায় করেন না। দিনের পর দিন তাকে ফেলে রাখেন নিঃসঙ্গ অবস্থায়। কোথায় এই বেদনাদায়ক জুলুম। আর কোথায় সেই মহানবীর অনুপম আদর্শ!
সমাজে অনেক লোক এমন আছে যে নাকি প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমনকি মাঝরাত পর্যন্ত তার বন্ধুদের সাথে সময় কাটায়, এরপর যখন সে নিজের ঘরে আসে, তখন দেখা যায় তাঁর স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়েছে। সেও ক্লান্ত অবস্থায় বিছানায় এলিয়ে পড়ে। কল্পনা করুন তো, কেমন হবে তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক!
হজরত আয়েশা রা: বলেন, রাসূল সা: ফজরের সুন্নাত নামাজ আদায় করার পর আমি যদি জাগ্রত থাকতাম, তাহলে আমার সাথে কথাবার্তা বলতেন। নতুবা ফজর নামাজের জন্য ডেকে দেয়া পর্যন্ত আমার সাথে শুয়ে থাকতেন (বুখারি-১১৬১)। আয়েশা রা: আরো বলেন, আল্লাহর রাসূল সা: যখন কোনো সফরে বের হতেন, তখন স্ত্রীদের মধ্যে লটারি করতেন। যার নাম লটারিতে উঠতো তাকে সাথে নিয়ে সফরে যেতেন (বুখারি-৫২১১)। মোট কথা, স্ত্রীর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ও তাকে সময় দানের অপূর্ব এই আদর্শ তিনি কখনো ত্যাগ করেননি।