তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। ঢাকা ফার্মগেট, তেজগাঁও পলিটেকনিক গার্লস হাই স্কুলে পড়ি। ভাইজান প্রায়দিন দুপুরেই আমদের বাসায় আসতেন। দুপুরের খাবার শেষে একটু স্ন্যাপ নিতেন। সোফাতেই গা’টা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকতেন। আমি ভীষণ শান্ত স্বভাবের ছিলাম। ভাইজান আমাকে আদর করতেন, কিন্তু আমার সাহস হতো না ভাইজানের সাথে কথা বলার। কারণ এই ভাইজান মো: ফারুক আহমদ বাদল তখন চলচ্চিত্র প্রজোযক। নায়ক-নায়িকাদের নিয়েই তার কাজকর্ম। ভাইজান দেখতেও হ্যান্ডসাম। গায়ের রঙ দুধে আলতা। আর কণ্ঠস্বর? ভয়ঙ্কর সুন্দর। ভয়ঙ্কর এই জন্য বললাম, তিনি দরজায় এসে দাঁড়িয়েই বলতেন, লুৎফা চলে এসেছি। খুব তাড়াতাড়ি পেট পূজা করতে হবে। ওখানে বোম ফোটার সম্ভাবনা শতভাগ। বুঝতেই পারছ যুদ্ধ অনিবার্য। ভাইজান একদমে কথাগুলো শেষ করে ধপাস করে সোফায় বসে পড়তেন। ভাইজানের কথাগুলোই যেন গান। যেমন শুদ্ধ বাংলা তেমনি তার কণ্ঠ। আমি আর লতা দূরে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতাম। মাসুম শাহীন কাছে গিয়ে দুষ্টুমি করত। ওরা খুব ছোট। মেজাজ বোঝার বয়স ওদের নয়। তার দুপুরের ভোজন শেষ হলে কাছে যেতাম। অযথা ঘোরাঘুরি। মনের কথা তখন মনেই প্রকাশ করার মতো সাহসী মানসিকতা হয়নি। এমনি প্রায় দিনই ভাবি আজ বলবই। বলা আর হয় না। লতা খুব ছটফটে আমার চেয়ে ছোটও সে। চঞ্চলা চপলা হরিণীলতা। একদিন কোনো ভূমিকা না রেখেই বলে ফেলে- মামা আমাদের আপনার সাথে নিবেন এফডিসিতে? ভাইজান বলেন, তুমি ওখানে গিয়ে কী করবে? লতা বলে- খালামনি নবিতুনকে দেখবে। শাবানা, ববিতা ওদের সবাইকে দেখবে। আমিও দেখব। ভাইজান এক মিনিট নীরব থেকে বললেন, চলো। ভালো ড্রেস পরো। লতা তো বনের হরিণী দুরন্ত বেগে ছুটে এসে আমাকে বলে, তাড়াতাড়ি। আমরা চটজলদি তৈরি হয়ে ছুটলাম। গেটে দাঁড়িয়ে বলি, প্রতিদিন এই পথে যাই, এর ভেতরে কী হচ্ছে দেখার জন্য প্রাণটা আকুপাকু করত। কিন্তু উপায় নেই। আজ এখানে নবিতুনকে দেখব। বাস্তবে তার শুটিং দেখব। শাবান, ববিতাকে দেখব।ভাইজান বলেন, চুপচাপ বসে থাকবে লক্ষ্মী মেয়ের মতো কোনো নড়ন চড়ন নেই। মনে থাকবে তো? আমরা দুজনেই মাথা নিচু করি। লতা ভাইজানের হাত ধরে রেখেছে। আমি ওদের পেছনে পেছনে। দেখি সারেং বৌয়ের সেই নবিতুন কবরী বসে আছেন। একমাথা সমান খোঁপা। খোঁপায় গোঁজা শাদা তাজা ফুল। মাথাটা একটু কাৎ করে বসে আছেন। শাড়ির ভাঁজ অসম্ভব কায়দায় পরিপাটি। নায়ক জাফর ইকবাল ও ববিতা দাঁড়িয়ে কাগজ হাতে। আমি খুঁজি নবিতুনকে, যিনি নায়ক ফারুকের সারেং বৌ। যার কষ্টে কেঁদেছিলাম। লতা ওর ফ্রকের লেস খুলে আমার চোখ মুছিয়েছিল। এখন দেখছি মেমসাহেবা বসে আছেন। লতাকে ধাক্কা দেই। লতাও আমাকে ধাক্কা দেয়। ভাইজান আমাদের মুখাবয়ব দেখে বলেন, আসো পরিচয় করিয়ে দিই। উনি কবরী দি। উনি ববিতা, উনি জাফর ইকবাল। আরেকটু পরে অনেকেই আসবে। কিন্তু মামা এখন যে তোমাদের যেতে হবে। আমাদের দুজনেরই মন খারাপ হয়ে গেল আমরা একটু বসলে তাই কী ক্ষতি? আমরা তো আর কথা বলিনি। বাসায় ঢুকে বড় আপার মালা শাড়ি পরলাম। বহুভাবে আয়নায় দেখলাম নিজেকে। কবরীর মতো তো লাগছে না! এরপর ববিতার কলা খাওয়ার আর্ট চোখ থেকে সরছে না। টেবিলে রাখা কলা প্রায় সব দুজনের প্রাকটিসেই চলে গেল। আপা বলে, এত কলার খোসা? কলা শেষ? দেয়ালের আয়না টেবিলে কেন? ভাগ্যিস ভাঙেনি। আপার বকাবকিতে দুজনেই চুপচাপ পড়ার টেবিলে। আজ সারাহ বেগম কবরী নেই। রয়ে যাবে তার কর্মের নিপুণতা। যা মানুষকে কাঁদাবে-হাসাবে-ভাসাবে। নিয়ে যাবে সুদূর অতীতে। মানুষের দেহের কোনো মূল্য নেই। মূল্যমান হয় কাজে। মানুষের রূপের চেয়ে গুণের কদর অনেক বেশি। ব্যবহারে বংশের পরিচয়। বাহ্যিক সৌন্দর্যে নয়, ফুল আপনার জন্য ফোটে না। অন্যকে আনন্দ দিতে গন্ধ দিতে, রঙের দ্যোতনা দেয়ার জন্যই ফোটে। কবরী সেই সুগন্ধী বকুল যার রূপ-গুণ-গন্ধ আজন্মকালের। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।