আমি যতোটুকু বুঝতে পারি, তার বেশি বুঝবার ভান করে যেন কারুর শ্রদ্ধা বা প্রশংসা পাবার লোভ না করি। তা সে মহাত্মা গান্ধীরই মত হোক আর মহাকবি রবীন্দ্রনাথের মত হোক কিংবা ঋষি অরবিন্দের মত হোক, আমি সত্যকার প্রাণ থেকে যেটুকু সাড়া পাই রবীন্দ্র, অরবিন্দ বা গান্ধীর আহ্বান ঠিক ততটুকু মানবো। তাঁদের বাণীর আহ্বান যদি আমার প্রাণে প্রতিধ্বনি না তোলে, তবে তাঁদের মানব না। — ‘ধূমকেতুর পথ’, কাজী নজরুল ইসলাম।
১
বলার অপেক্ষা রাখে না, নজরুল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার তাৎপর্য বিচার এক হিসাবে উপেক্ষিতই থেকেছে। নজরুলের ওপর লেখালিখি হয় নি এমন নয়, অনেক ভাল কাজও হয়েছে। সেগুলো প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ। জরুরী। প্রাথমিক, কারণ এই কাজগুলো সাঙ্গ না হলে বিচারের কাজ শুরু হতে পারে না। তথ্যের দরকার: দরকার তাঁর লেখালিখিগুলো এক সঙ্গে এক জায়গায় পাওয়া এবং তাঁর জীবনী সম্পর্কে মোটামুটি একটা তথ্যনির্ভর বিবরণী। ইত্যাদি।
নজরুল-বিচারের কাজটা নানান দিক থেকে হতে পারে। কবি ও সাহিত্যিক, গীতিকার ও সুরকার, সমাজ সংস্কারক, রাজনৈতিক কর্মী কিম্বা ব্যক্তি হিসাবে পরিবারে ও বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক চর্চা; সবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাবা যেতে পারে অন্য আরো নানান দিক থেকে। নিশ্চয়ই।
কিছু বিচার ও মূল্যায়ন হয়েছে, অনেকে করেছেন। সেইসব লেখালিখির মধ্যে তাঁকে নিয়ে সমাজের নানান শ্রেণীর, নানান সম্প্রদায়ের ও নানান অংশের চিন্তা ও উৎকন্ঠা ধরা পড়ে। সেই দিক থেকে নজরুল তাঁর সময়কালে এক ভাবে আলোচিত হয়েছেন। সেই আলোচনার মধ্যে সেই সময়কালের অর্থনৈতিক সম্পর্কের পরিবর্তন, সমাজের নতুন পরিগঠন, রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা ইত্যাদির লক্ষণ বা উৎক্ষেপ রয়েছে। তাঁকে নিয়ে আলোচনার সময় সেই লক্ষণ বা উৎক্ষেপগুলোই সামনে চলে এসেছে। সেটাই স্বাভাবিক। ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে এখনকার সময় অবধি বাংলাদেশের জনগণের, আবেগ, কল্পনা, আত্মচিন্তা ও আত্মপরিচয়ের টানাপড়েন ও বিবর্তন বোঝার জন্য নজরুল অসামান্য সামাজিক উপাদান। সেইদিকে বাংলাদেশে আগ্রহ আছে, কিন্তু খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। তাঁর গান ও সাহিত্যকর্ম নিয়েই আগ্রহ আমাদের বেশী। তাঁর জীবনকে গান ও সাহিত্যকর্মের আলো ফেলে আমরা বোঝার চেষ্টা করি। এতেও অবাক হবার কিছু নাই, এটাই প্রাথমিক ভাবে হবার কথা। কিন্তু উলটো দিক থেকে তাঁকে বোঝার চেষ্টা করি না। এওকটি জনগোষ্ঠির বেড়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে তার লেখালিখি ও সঙ্গীতচর্চা কিভাবে জড়িত সেই দিকটা এখনও অনালোচিতই থেকে গেছে। নজরুল নিয়ে আমাদের বিপুল আগ্রহ থাকলেও তার তাৎপর্য নিয়ে বাংলাদেশে আমরা যথেষ্ট ভেবেছি বলে মনে হয় না। বাংলা কবিতা বা সাহিত্যে তাঁর স্থান নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু সাহিত্য একই সঙ্গে সমাজ ও ইতিহাসকে চেনায়। সেই দিক থেকে নজরুলকে আমরা কতোটা চিনেছি তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে। অথচ সাহিত্য ও সঙ্গীতের দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশে নজরুলকে নিয়ে আগ্রহের অভাব আছে বলা যাবে না, তাঁকে নিয়ে চর্চার ধারা নেহায়েত দুর্বল নয়। তবে আগ্রহের ক্ষেত্র সীমিত। তাঁর গান আমাদের অধিকার করে থাকে; তুলনায় তাঁর সাহিত্য অতোটা নয়। তাঁর কবিতা আমরা পাঠ্য পুস্তকে পড়ি। কিন্তু যখন থেকে আধুনিকতাই কাব্যের পূজনীয় বস্তু হিসাবে চল হোল নজরুল তখন থেকে আড়ালে পড়ে গেলেন। সন্দেহ নাই তাঁর কবিতার পাঠক আছে, তবে আধুনিক কাব্য চর্চার তিনি অন্বিষ্ট নন। অনেকের কাছে তিনি অবান্তরও বটে। যেমন বুদ্ধদেব বসু।
যেদিকটার ওপর আমি এখানে জোর দিতে চাইছি সেটা হোল, নজরুল বাংলাভাষীদের ইতিহাসের দিক থেকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লক্ষণ। এক অর্থে একটা ভেদরেখা। দুটো রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাভাষীদের বিভাজিত হবার লক্ষণগুলো নজরুলের মধ্যে আমরা পড়ি বা পড়তে পারি। এই ভেদ্রেখা ঐতিহাসিক ভাবে শনাক্ত করবরা কাজটা হয় নি বলেই আমার দাবি। তাঁকে বাংলাদেশের সমাজ ও ইতিহাসের বিশেষ লক্ষণ হিসাবে একালে আমাদের নতুন করে পাঠ ও পর্যালোচনার দরকার আছে। অতীতে ফিরে যাবার জন্য নয়, নতুন বিশ্ববাস্তবতায় সামনে এগিয়ে যাবার জন্য। এটা বড় কাজ। সেই কাজের দায় নিতে এই লেখা লিখছি না, বরং এ ধরনের বড় একটি বিষয়ের দিকে কিছুটা নজর ফেরাবার চেষ্টার জন্যই এই লেখা।
২
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে যে ঔপনিবেশিক জমিদারি ব্যবস্থার পত্তন ঘটেছিল তার ওপরই গড়ে উঠেছে কলকাতা — ঔপনিবেশিক শহর ও তার জগত, সাহিত্য ও সংস্কৃতি; একই সূত্রে পাশাপাশি গড়ে উঠেছে হিন্দু স্বাদেশিকতা ও সম্প্রদায় চেতনা। অন্যদিকে ইংরেজ শাসন ও জমিদারিব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে গ্রামের রায়ত ও কৃষকদের আত্মসচেতনতা, মুসলমান সমাজে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব এবং হিন্দু স্বাদেশিকতার বিপরীতে তাদের নিজেদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্বাতন্ত্রবোধ, সম্প্রদায় হিসাবে নিজেদের ভিন্নতার উপলব্ধি। নজরুল এই দুইয়ের মধ্যে বিচরণ করেছেন। এক ঐতিহাসিক দ্বিধার চিহ্ন তিনি।
নজরুল কখনও শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন, কখনও ইসলামি গান। কখনও ইসলামি জাতীয়তার বীর সেনানী হতে চেয়েছেন, কখনও আবার হিন্দু মুসলমানের মিলনের জন্য কাতর। সন্দেহ নাই তিনি দুই তরফেই থাকতে চেয়েছিলেন। একবার ‘মুসলমান’, একবার ‘হিন্দু’। যে-ঐতিহাসিক বিভাজনটা আর্থ-সামাজিক কারনে গড়ে উঠেছিল, তিনি তা পছন্দ করেন নি। এতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু এর কোন মীমাংসা তাঁর জানা ছিল না। সমাজের বৃহৎ অংশ ঔপনিবেশিক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারনে ভূমির অধিকার হারিয়েছে, আর তাদের ঘাম আর পরিশ্রমের ফল ভোগ করছে আরেকটি সম্প্রদায়ের অভিজাত শ্রেণি; বাস্তবের এই বিরোধ শুধু আবেগ বা আদর্শ দিয়ে মুছে ফেলা সম্ভব ছিল না। কিন্তু চেষ্টার কমতি ছিল না নজরুলের মধ্যে।
নজরুলের সাম্য চিন্তা বা মানবতাবাদ নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হয়। কিন্তু নজরুলের সাম্যের ধারণা বা তথাকথিত মানবতাবাদের ধারণাকে ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে বোঝা অসম্ভব। বাংলাভাষীদের বাস্তব ও ঐতিহাসিক বিভাজনকে মনে রেখেই তাঁর সাম্য চিন্তা কিম্বা মানবতাবাদকে বুঝতে হবে। ভুমি অধিকার ও তার ওপর গড়ে ওঠা আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক ও নানাবিধ প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে বাস্তবের যে বিরোধ তাকে নজরে রেখেই নজরুলকে বোঝা দরকার। ‘হিন্দু’ কিম্বা ‘মুসলমান’ কোন প্রাকৃতিক বা চিরায়ত সত্তা নয়। বিভিন্ন কালপর্বে কিম্বা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে এর মানেও এক রকম নয়। এদের গঠন ঐতিহাসিক এবং আত্ম-পরিচয় হিসাবে তাদের রাজনৈতিক ভূমিকাও অবস্থা ভেদে সব সময় এক রকম থাকে নি। নজরুল আত্ম-পরিচয়ের হানা হানি ঘৃণা করেছেন, কিন্তু হানহানির বাস্তব ঐতিহাসিক শর্ত বুঝেছেন বলা যাবে না। ফলে একে মোকাবেলা করতে চেয়েছেন নৈতিক বা মানবিক জায়গা থেকে। মন্দির আর মসজিদকে এই বিভাজনের কারন হিসাবে গণ্য করেছেন। তার এই বোঝবুঝির ধরণ এখনকার বোঝাবুঝির গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান। বাংলাভাষীরা দুতো রাজনৈতিক জঙ্গোষ্ঠি হিসাবে বিভক্ত হবার কারন মন্দির বা মসজিদ নয়। নজরুলের মনে হয়েছে এক জায়গায় তাদের অস্বীকার বা অন্য জায়গায় তাদের উভয়কেই স্বীকার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে তিনি এই ঐতিহাসিক বিভাজন রোধ করতে পারবেন। সেটা ছিল অসম্ভব। ইতিহাস তার নিজের গতিতেই এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাঁর চিন্তার এই সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই তাঁকে আন্তরিক ভাবে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের একটা রাজনীতি আছে। সেটা পরিবর্তনশীল। সেই রাজনীতির ইতিহাস ভুলে গিয়ে উভয়ের পরিচয়কে স্থির, অনড় ও অপরিবর্তনশীল গণ্য করাকে অনেকে আজকাল রাজনীতির সংস্কৃতায়ন (culturalization of politics) বলে থাকেন। যার মানে হচ্ছে কোন জনগোষ্ঠি নিজেকে যেমন করে রাজনৈতিক পরিচয়ে হাজির করতে চায় তার সেই পরিচয়কে প্রাকৃতিক ও চিরায়ত গণ্য করা। যেহেতু প্রকৃতিগত ভাবেই মুসলমান বুঝি মুসলমান কিম্বা হিন্দু হিন্দুই, অতএব এই পরিচয়ের কোন ইতিহাস নাই। এই প্রাকৃতিক পরিচয়ের কোন পরিবর্তন, রূপান্তর বা পরিচয়ের ভিন্ন অর্থ বা দ্যোতনা তৈরী অসম্ভব। এই অনুমান থেকে এই সিদ্ধান্ত তৈরি হয় যে আত্ম-পরিচয়ের এই প্রাকৃতিকতা বা চিরায়ত ভেদাভেদ অতিক্রম করা যাবে না। একে স্বীকার করেই রাজনীতি করতে হবে।
পরিচয়কে অনৈতিহাসিক ভাবে প্রাকৃতিক গণ্য করে রাজনীতি করা কেমন? প্রাকৃতিক ও চিরায়ত সত্তা হিসাবে মুসলমানকে ‘মুসলমান’ আর হিন্দুকে ‘হিন্দু’ গণ্য করে রাজনৈতিক সহনশীলতার চর্চা। এই রাজনীতি বহুকে সহা বা ধর্ম নিরপেক্ষ সংস্কৃতি হিসাবেও পরিচিত। এই রাজনীতির মূল কথা হচ্ছে প্রাকৃতিক বা চিরায়ত সত্তা হিসাবে ধর্ম আছে, ধর্ম থাকবে, কিন্তু থাকবে ‘প্রাইভেট’ ব্যাপার হয়ে, সমাজের বাইরে। ধর্মকে রাজনীতিতে আনা যাবে না।
এর উলটো পিঠে আছে সংস্কৃতির রাজনীতিকরণ (politicization of culture)। সংস্কৃতি বা সামাজিক স্তরের পরিচয়কে সাংস্কৃতিক বা সামজিক স্তরে না রেখে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের স্তরে উন্নীত করা। যেমন দাবি করা, রাষ্ট্রকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হতে হবে। তার পাল্টা যখন বলা হয় রাষ্ট্রকে শরিয়া ভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র বানাতে হবে তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা তা মানতে রাজি থাকে না। একটা দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরী হয়। খোদ রাষ্ট্রই ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম ঘটে। অথচ সামাজিক বা সাংস্কৃতিক আত্ম-পরিচয়ের রাজনীতিকরণ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য হুমকি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছে কেউই হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, চাকমা, সাঁওতাল, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কিম্বা নারী বা পুরুষও নয়। প্রত্যেকে নাগরিক। রাজনীতির সংস্কৃতায়ন কিম্বা সংস্কৃতির রাজনীতিকরণ; এই দুই প্রবণতার বিপদ এড়ানোর ওপর বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় একটি জনগোষ্ঠির টিকে থাকা না থাকা নির্ভর করে। নাগরিকতার এই বোধ নজরুলের আমলে যেমন বিকশিত হয় নি, এখনও বিকশিত হয়েছে বলা যাবে না। নজরুলের কালপর্ব থেকে আমরা খুব এগিয়েছি ভাববার কোন কারণ নাই।
৩
বাঙলা উন্নয়ন বোর্ড ১৯৬৪ সালের শেষের দিকে ‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলামের সব রচনা কয়েক খ-ে প্রকাশের পরিকল্পনা নেয়। কবি আব্দুল কাদির এই দরকারী কাজটি করেন। তাঁর সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশের সময় প্রথম খ-ে সংকলিত লেখালিখিকে দেশাত্মবোধের প্রেরণাসম্পন্ন বলেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘নজরুল ইসলামের সাহিত্য-জীবনের প্রথম জীবনের যুগের’ লেখালিখির পেছনে ‘দেশাত্মবোধ ছিল প্রধান প্রেরণা’ (আব্দুল কাদির, ১৯৬৬, পৃষ্ঠা ১০)। দেশ বলতে আবদুল কাদির ‘অখ- ভারত’ বুঝিয়েছিলেন, নাকি ‘অবিভক্ত বাংলা’ সেটা পরিষ্কার ছিল না। কাদির লিখছিলেন পাকিস্তান কালপর্বে। যে সময় ভারতই শুধু ভাগ হয় নি, সাতচল্লিশে বাঙালিও বিভক্ত হয়েছে। ‘দেশ’ বলতে কী বুঝি সেটা স্পষ্ট না হলে বাংলাদেশের জনগণের ইতিহাস আমরা নিজেরাই বুঝবোনা। নজরুলকেও না।
এখনও আমরা নজরুলের ‘দেশাত্মবোধ’ স্পষ্ট বুঝেছি দাবি করা যাবে না। নজরুল ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, অবশ্যই। কিন্তু অখ- ভারতকে তার ‘দেশ’ গণ্য করেছিলেন কিনা সন্দেহ। আবদুল কাদিরও ‘দেশ’ বুঝেছেন দাবি করা কঠিন। ঔপনিবেশিক আমলে ‘দেশ’ বলতে ভারতের জনগণ যা বুঝেছে, ভারত ভাগ হবার পর পাকিস্তানের অধিবাসীরা সেই ভাবে ভাবেন নি। ঠিক তেমনি একাত্তরে ‘দেশ’ বলতে আমরা পাকিস্তান বুঝি নি। সুনির্দিষ্ট না করলে নজরুলের ‘দেশাত্মবোধ’ সে কারনে বিশেষ কো অর্থ বহন করে না।
ঠিক যে নজরুল ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে যে-জনগোষ্ঠিকে কল্পনা করতে চেয়েছিলেন সেখানে হিন্দু-মুসলমান ভেদ ছিল না। অথচ বাস্তবে সেই ভেদ তৈরী হয়ে গিয়েছিল, তাঁর লেখালিখির মধ্যে দুই সম্প্রদায়ের প্রতি অতএব আলাদা আবেদন প্রস্তাব করবার তাগিদ ছিল। কখনও তিনি ‘হিন্দু’ হয়ে লিখেছেন, কখনও ‘মুসলমান’ হয়ে। দুই সম্প্রদায়ের আশা আকাঙ্ক্ষা ও অভিপ্রায় তখন এক বিন্দুতে বা এক কাতারে ছিল, ইতিহাস তা বলে না।
মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার এবং সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে স্থানীয় বা লৌকিক ভাষার পাশাপাশি যখন ক্রমে ক্রমে একটি সার্বজনীন সাহিত্যের ভাষা গড়ে ওঠে, আর তার সঙ্গে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিকাশ ও নগরায়ন —তখন জাতিবোধেরও নতুন ভেদ তৈরী হয়, তা ভূগোল হিসাবে অখ- ভারতের কল্পনার চেয়ে অধিক শক্তিশালী হবার কথা। অখ- ভারত একটি ভৌগলিক কল্পনা। বিপরীতে ‘বাঙালি’ ভৌগলিক ধারণা নয়। এই অর্থে যে এর উৎপত্তি, নির্মাণ ও গঠন ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যে। যদি তা মানি তাহলে নজরুল নিজেকে কতোটা ভারতীয় ভাবতেন, কিম্বা কতোটা বাঙালি সেটা একটা বৈধ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে পারে। তাহলে প্রথম যুগে নজরলের মধ্যে ‘দেশাত্মবোধই প্রধানতম প্রেরণা’ ছিল এই অনুমান বিস্তর ব্যাখ্যার দাবি করে।
এই প্রশ্নের অন্য একটি গুরুত্ব রয়েছে। আমরা বাংলাভাষা, সংস্কৃতি ও বাঙালি পরিচয়কে হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ থেকে আড়াল করে রাখতে চাই। যা আসলে অবাস্তব ও অনৈতিহাসিক। ঐতিহাসিক বিভাজনকে না মানলে তার মীমাঙ্গসা কখনই সম্ভব নয়। এই না মানা বহাল কি মন্দ সেটা কোন কাজের তর্ক নয়। রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা হিসাবে এর ইতিবাচক দিক থাকতেই পয়ারে। সেটা হোল ইতিহাস ও বাস্তবতার ভেদচিহ্ন আমরা অতিক্রম করতে চাই। নজরুলের মধ্যে এই চাওয়াটা প্রবল ছিল। তাঁর শ্যামা সঙ্গীত বা কীর্তন রচনাকে নিছকই সাহিত্যিক চর্চা হিসাবে গণ্য করবার সুযোগ নাই। রবীন্দ্রনাথ তো বাঙালি হয়েও ‘ইসলামি সঙ্গীত’ রচনা করেন নি। এটা কূটতর্ক বলে আমরা পরিহার করতে পারি, কিন্তু এটাই ইতিহাস। অবশ্যই। এ প্রশ্ন মনে রাখলে নজরুলকে বুঝতে সুবিধা। আর নজরুলকে বুঝলে বাংলাদেশের কৃষক সমাজ বা পূর্ব বাংলার প্রধান জনগোষ্ঠিকেও বোঝা সহজ। হিন্দু মুসলমান ভেদকে বাস্তব ও ঐতিহাসিক বলার অর্থ এই নয় যে এই ভেদ প্রাকৃতিক অতএব চিরায়ত। ওপরে তা ব্যাখ্যা করেছি। যদি না হয় তাহলে এই ভেদ মোটেও অনতিক্রম্য নয়। অতিক্রম করতে হলে অতিক্রমণের নতুন রাজনীতি দরকার। যে রাজনীতি উপমহাদেশে নতুন ইতিহাসের শর্ত তৈরী করবে। কিন্তু ইতিহাস বা বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ভেদবুদ্ধির নিরাকরন সম্ভব নয়। ইতিহাসের নতুন শর্তও কখনো অর্জন করা যাবে না। অতিক্রম করে যাবার একটাই মাত্র পথ হতে পারে —ইতিহাসকে নির্মোহ ভাবে বিচার করবার শক্তি ও দূরদৃষ্টি অর্জন করা। অর্থাৎ হিন্দু কিম্বা মুসলমানকে এই ভেদবুদ্ধির জন্য দোষারোপ না করে এই ভেদ তৈরী হবার ঐতিহাসিক কারণগুলোকে বোঝা। এবং অতীতের ভুলের পূর্বানুবৃত্তি বন্ধ করা। এই ইতিহাস ও বাস্তবতাকে মনে করিয়ে দেবার জন্যই ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং শহর কলকাতার পরিগঠন সম্পর্কে বলেছি। ঔপনিবেশিক আমলের বাংলাভাষা ও সাহিত্য এবং তার মধ্যে ‘বাঙালি’ পরিচয় নির্মানের ইতিসকেও একই সঙ্গে নজরুলকে বুঝতে গিয়ে স্মরণ করেছি। স্মরণ রাখার দরকার আছে।
ফলপ্রসূ অন্বষণের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে পারে বাংলাভাষা, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে তৈরী ‘বাঙালি’ পরিচয় বাংলাদেশের মানুষের কাছে এতো প্রিয় হবার ব্যাখ্যা কি? যে-পরিচয় বাংলাদেশের জনগণকে রক্ত দিয়ে শহিদ হয়ে অর্জন করতে হয়েছে? ভৌগলিক পরিচয়, কিম্বা অখ- ভারতীয় পরিচয় গৌণ হবার পেছনে তার ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে কি তার কৃষক পরিচয়ই প্রধান ছিল না? আসলে বাঙালি মুসলমানের ইতিহাসকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কৃষকের লড়াই থেকে আলাদা করে বিচার করবার কোন সুযোগ নাই। একইভাবে সে বাঙালিও বটে। উচ্চবর্ণের হিন্দুর হাতে ঔপনিবেশিক আমলে যে ভাষা ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের জনগণ তাকে গ্রহণ করেছে। উঁচু জাতের তৈয়ারি জিনিস বলে প্রত্যাখান করে নি, বরং আত্মীকরণের জন্য লড়েছে। সেই ভাষার মধ্যে নিজের বসত পোক্ত করতে সাধনা করেছে। নজরুল নিজেই তো বিশাল উদাহরণ। বাংলার কৃষক তার ধর্মবোধ ও ধর্মীয় পরিচয় নিয়েই বাঙালি হয়েছে। দুইয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য করে নি
নজরুল বলছেন; আমাদের বাঙলার মুসলমান সমাজ যে বাঙলা ভাষাকে মাতৃভাষা বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছেন এবং অত্যল্পকালের মধ্যে আশাতীতভাবে উন্নতি দেখাইয়াছেন, ইহা সকলেই বলিবেন, এবং আমাদের জন্য ইহা কম শ্লাঘার বিষয় নহে। আমাদের সাধারণ অসাধারণ প্রায় সকল বাঙালী মুসলমানই এখন বাঙলা পড়িতেছেন, বাঙলা শিখিবার চেষ্টা করিতেছেন, ইহা বড়ই আশা ও আনন্দের কথা।
কিন্তু লক্ষ্য করবার ব্যাপার যে এই সামাজিক সত্য ঘোষণা করার পর নজরুল আলাদা ভাবে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করবার জন্য মুসলমানদের জন্য কোন মুসলমানি বা ইসলামি সাহিত্য চর্চার প্রস্তাব করেন নি।;এখন আমাদের বাঙলা সাহিত্যে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করিতে হইলে সর্বপ্রথম আমাদের লেখার জড়তা দূর করিয়া তাহাতে ঝর্ণার মতো ঢেঊ ভরা চপলতা ও সহজ মুক্তি আনিতে হইবে। যে সাহিত্য জড়, যাহার প্রাণ নাই, সে নির্জীব সাহিত্য দিয়া আমাদের কোন উপকার হইবে না, আর তাহা স্থায়ী সাহিত্যও হইতে পারে না। বাঙলা সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ ছাড়া খুব কম লেখকেরই লেখায় মুক্তির জন্য উদ্দাম আকাঙ্ক্ষা ফুটিতে দেখা যায়; বাঙলা সাহিত্যে মুসলমান (নজরুল ইসলাম, ১৯৬৬, পৃষ্ঠা ৮২০)।
রবীন্দ্রনাথ প্রেরণা। তাকে মনে রেখে বাংলা সাহিত্যের ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের মধ্যে বাংলা ভাষার চর্চা করে নিজেদের স্থায়ী আসন পাকাপোক্ত করতে হবে। বাঙালি মুসলমানকে যে স্থান দখল করতে বলেছিলেন সেটা বাংলা ভাষা বা ইতিহাসের বাইরের কোন আসন নয়; বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যেই বাঙালি মুসলমানের আসন। নজরুলকে এভাবে বুঝলে তাঁর ইসলাম ও মুসলমানের পক্ষে লিখালিখি, কিম্বা তার ইসলামী গান ও কবিতাকে আমরা অনায়াসে বুঝব। তিনি ‘মুসলমান’ বলে এইসব লেখেন নি, বরং বাঙালি বলে অনায়াসেই লিখেছেন। কিন্তু এর রাজনৈতিক তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী, কারণ এই চেষ্টার মধ্য দিয়ে যেটা প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছিল সেটা হোল ইসলাম বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছিন্ন অংশ। ইসলাম আরবের বা বাইরের কিছু নয়। ঠিক একই কারণে হিন্দু পুরান, হিন্দু সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ওপর বাঙালি হিসাবে তার অধিকার জ্ঞান থেকেই হিন্দুর ভাষা ও বাগধারাকে নজরুল গ্রহণ করেছেন অনায়াসে। শ্যামা সঙ্গীত ও কীর্তন লিখেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই; অর্থাৎ বাঙালি হিসাবেই তার ভেতর থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এইসব উৎসারিত হয়েছে। এই সকল কারণে নজরুল বাংলাদেশে যতোটা প্রাসঙ্গিক তাঁর সমসাময়িক অন্যরা ততোটা নন। রবীন্দ্রনাথ মহৎ কিন্তু এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের খোলা ও উদার চৈতন্যের ক্ষেত্রগুলো বুঝতে ঠাকুর খুব সহায়ক নন। যে ধর্মীয় সম্প্রদায় থেকে তিনি এসেছেন সেই সম্প্রদায়ের পক্ষে তাঁকে এই লড়াইটা করতে হয় নি।
৪
এটা তাহলে ভেবে দেখা দরকার বাংলাভাষীদের এক অংশের কাছে নিজ ধর্মের পাশাপাশি ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিচয়টা যদি মুখ্য হয়ে উঠতে পারে, অন্য অংশের কাছে ভারতের ভৌগলিক অখ-তা মুখ্য হয়ে রইল কেন? শুধু ভৌগলিক অখ-তার ভিত্তিতে পরিচয় নির্মাণ প্রয়োজনীয়ই বা মনে হোল কেন? জাতপাত শ্রেণির প্রশ্ন এখানে অবশ্যই ভূমিকা পালন করেছে। কৃষক বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে লড়েছে, লড়েছে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে। তাকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করতে হয়েছে জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। বাঙালি মুসলমানের এই ইতিহাস বাদ দিলে তাকে চেনাই যায় না। এই ইতিহাস যাদের তারা প্রায় সকলেই কৃষক।
অপর পক্ষ কৃষকদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়াননি তা নয়। দাঁড়িয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার উদাহরণ। তারপরও তাঁর ‘বাঙ্গালি’র ধারণার মধ্যে মুসলমান অনুপস্থিত; জমিদার হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রজা বৎসল ছিলেন না বলা যাবে না। কিন্তু যেখানে ভেদরেখা তৈরী হয়েছে সেটা হোল অখ- ভারত চিন্তা। ভূখ-কে মাতৃরূপে বন্দনা। হিন্দু ধর্ম ও অখ- ভারত এখানে একাকার হয়ে আছে। রাজনৈতিক আত্ম-পরিচয় নির্মাণের কর্তব্য যখন দেখা দিল সেখানে ভাষা, সংস্কৃতি বা বাঙালির ধর্ম, ঐতিহ্য বা ইতিহাস নির্ণায়ক হোল না। হোল ভূখ-গত কল্পনা —অখ- ভারত চিন্তা।
এই দিকটা বুঝলে আমরা একই সঙ্গে বুঝব যে নজরুল সেই রাজনৈতিক মুহূর্তের সন্তান যখন এই দ্বিধার সমাধান তাঁর কাছে ছিল না। তিনি দেশভাগ চেয়েছেন এমন কোন প্রমান নাই। কিন্তু ইসলাম আর আর ধর্মের মতো এই দেশের জনগণের ইতিহাস ও সংস্কৃতি; এই সত্য ধারণ করতে তিনি ভোলেন নি। আর সেটা ধারণ করেছেন নিঃসংকোচে। নিশ্চয়তার সঙ্গে। যে কারণে নজরুল নিজেকে যতোটা বাঙালি দাবি করতে পারেন, অন্যরা; এমনকি রবীন্দ্রনাথও ততোটা পারেন কিনা সে তর্ক তোলা যেতে পারে। এই তর্ক তোলা অন্যায় হবে না। কেউ বাঙালিকে বিভক্ত করেছে, আর কেউ ঐক্যবদ্ধ; এই ইতিহাস আমাদের নতুন ভাবে পাঠ করতে শিখতে হবে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী ইতিহাস আর বাঙালির ইতিহাস সমার্থক নয়। রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী হবার শিক্ষা কিম্বা প্রেরণ দেন, এই অভিযোগ এ কারনেই ওঠে। বিপরীতে নজরুল বাঙালিকে একই সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান জ্ঞান করে তাদের ‘বাঙালি’ হবার পথ অন্বষণের জন্য অনুপ্রাণিত করে। কখনো তাঁকে মসজিদে পাওয়া যায়, কখনও মন্দিরে। মন্ধির ও পূজা ছাড়া রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে সামগ্রিক বা সার্বজনীন ভাবে বুঝেছেন দাবি করা যাবে না।
আসলেই। বাঙালির এক অংশের কাছে ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি আর অন্য অংশের কাছে ভৌগলিকতা বাঙালির রাজনৈতিক পরিচয়ের নির্ণায়ক হতে পারল কিভাবে? নাকি অন্য অংশের কাছে ভৌগলিকতার আড়ালে ধর্মীয় পরিচয়টাই প্রধান ছিল। ভারতের নানান জাতি, নানান ধর্ম নানান ভাষা, নানান সংস্কৃতি। তাদের ঐক্যের ভিত্তি অখ- ভূখ- বা অখ- ভারত হিসাবে দাবি করা হয়, সেই কল্পনার ঐতিহাসিক ভিত্তি কতোটুকু? ভূগোল দেশ-চেতনার একটি স্বাভাবিক উপাদান হতে পারে, কিন্তু দেশ, জাতি বা জনগোষ্ঠির পরিগঠনে প্রধান নির্ণায়ক হতে পারে না। বহু জাতি বহু ভাষা বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র ও বিভিন্নতাকে অখ- ভূগোলের চেতনা দিয়ে ‘এক’ নির্ণয় করা যায় না। ভূখ- প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হলেও ওর পেছনে ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, লোকায়ত ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানান, বোধ, উপলব্ধি ও চেতনা কাজ করে। অখ- ভারত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ পরিগঠনের বাইরের দিক, কিন্তু তার প্রধান আশ্রয় বা মর্ম নয়। অখ- ভারতের ভূগোল বাঙালিদের একটি অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য হোল না, অথচ কেন বাঙালিদের আরেকটি অংশের কাছে সেটাই প্রধান পরিচয়ে পরিণত হোল?
বাঙালি হবার সাধনার চেয়ে ভারতীয় হবার সাধনা ভাল কি মন্দ সেই তর্ক অর্থহীন। ধর্মীয় পরিচয় এই অখ- ভারতীয় পরিচয়ের প্রধান নির্ণায়ক বলে দাবি করা হয়। ইতিহাসকে জানা ও পরস্পরকে বোঝার জন্য এইসকল প্রশ্ন জারি রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরণের প্রশ্নের প্রতি নজর নিবদ্ধ রাখলে যে সিদ্ধান্তে আমরা পোঁছাই তার নমুনা সম্প্রতিকালের ঐতিহাসিকদের মধ্যে আমরা খুঁজে পাই। অখ- ভারত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ পরিগঠনের বাইরের দিক হলেও তার প্রধান আশ্রয় বা মর্ম হিন্দুর ধর্ম পরিচয়। ঐতিহাসিকরা এখন নতুন করে বলতে বাধ্য হচ্ছেন, ‘একজন ভারতীয় মানে একজন হিন্দু’।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আদর্শিক ভাবে সত্যিকার অর্থে যেমন ধর্ম নিরপেক্ষ নয়, তেমনি তার দার্শনিক ভিত্তিও সুদৃঢ় নয়। এই জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সহমত পোষণ করে যে, ভারতীয় সমাজের গোড়াতে রয়েছে ধর্মীয় ভাবে সংজ্ঞায়িত সম্প্রদায়। তাদের ধর্ম নিরপে জাতীয়তাবাদী আদর্শ হোল ‘সর্বধর্ম সম্ভবা’ অর্থাৎ সব সম্প্রদায়ের সমান অধিকার ও তাদের মধ্যে সমন্বয় বিধানের চেতনা। তবু অধিকাংশ জাতীয়তাবাদী চিন্তাবিদ জাতীয় পরিচিতির বর্ণনাকালে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করেছেন — যে দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন ভারতীয় মানে একজন হিন্দু। এ বিষয়টি বাংলা প্রদেশে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ ও স্বামী বিবেকানন্দের রচনায় এবং তাদের অনুপ্রাণিত চরম জাতীয়তাবাদে বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়; (চক্রবর্তী, ২০০৩, পৃষ্ঠা ২)।
ভূগোলকে আত্মপরিচয়ের ভিত্তি অনুমান করি বলে আমরা সাতচল্লিশের রাজনীতিকে এখনও বলি ‘দেশ ভাগ’ —সীমান্ত দ্বিখ-িত করা। আর এটা নাকি করা হয়েছে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। এই অপরাধের জন্য সবসময় মুসলানদেরই দায়ী করা হয়েছে। এটাই রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক গবেষণা এই সকল স্থূল অনুমান নাকচ করে দিয়েছে নজরুল কাব্যে, সাহিত্যে ও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তায় যে ‘বাঙালি’ চেতনাকে ধারণ করতেন তা রাজনৈতিক ভাবে পরাজিত হয়েছে। পরাজয়ের কারণ নতুন করে আমাদের বোঝার দরকার আছে।
;সাধারণ ভাবে বিশ্বাস করা হয় যে দেশ-বিভাগ হল সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির ফল, কিন্তু বাঙলার ক্ষেত্রে দেখা যায়, হিন্দুরা তাদের একটা স্বতন্ত্র সমান্তরাল বিচ্ছিন্নতাবাদী ধারা সৃষ্টি করেছে। ব্যাপকভাবে (কিন্তু ভুলভাবে) বিশ্বাস করা হয় যে, কংগ্রেস হাই কমান্ড অনিচ্ছাকৃতভাবে নীরবে বিভক্তিকে মেনে নেয়। কিন্তু ঘটনাটি ঠিক উলটো। এই গবেষণায় দেখা যায় যে, একক ভারতের ওপর কর্তৃত্বকে জোরদার করবার লক্ষ্যে কংগ্রেস হাই কমা- শুধু দেশ-বিভাগের মূল্য দিতেই প্রস্তুত ছিল না, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নিজের প্রদেশকে বিচ্ছিন্ন করতে বেঙ্গল কংগ্রেস সফল ভাবে তাদের আন্দোলনও পরিচালনা করেছে; (চক্রবর্তী, ২০০৩, পৃষ্ঠা ৩১১)। ১৯৪১ ইসায়ী সালের ৫ ও ৬ এপ্রিল কলকাতার মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে মুসলমান সাহিত্য-সমতির রজত জুবিলি উৎসব নুষ্ঠিত হয় সেই অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসাবে তাঁর জীবনের শেষ বক্তৃতা দিয়েছিলেন নজরুল। বললেন,;হিন্দু মুসলমানে দিন রাতে হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংক কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মত জমা হয়ে আছে; এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম;। (ইসলাম, কাজী নজরুল, ১৯৮৪, পৃষ্ঠা ১২৭) নজরুল সফল হয়েছেন, সেটা দাবি করা যাবে না। কিন্তু সাহিত্যে, সমাজে ও ইতিহাসে নিজের ভূমিকাকে কিভাবে ভেবেছেন সেটা বুঝতে পারলে তার ধর্ম, ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস মোকাবেলার ধরণ ও সুনির্দিষ্ট চর্চার তাৎপর্য আমরা আরও ভালো বুঝতে পারব। তাতে সন্দেহ নাই।
নজরুল সাম্যের কথা বলেছেন, সাম্যের গান গেয়েছেন। কিন্তু সেটা পুরাপুরি বুর্জোয়া সাম্যবাদ ছিল কি? সে তর্ক হতে পারে। তার সমাজে ইউরোপীয় অর্থে ‘বুর্জোয়া’ শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে নি। তিনি জমিদার তনয়,কিম্বা উচ্চ বর্ণের হিন্দু ছিলেন না। ছিলেন গরিব মুসলমান পরিবারের সন্তান। তার মধ্যে ততোটুকুই বুর্জোয়া সাম্যবাদ বিকশিত হয়েছিল যতোটুকু জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কৃষকদের লড়াই-সংগ্রামের জন্য দরকার। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কলকাতা শহরের ছিন্নমূল গরিব ও নতুন গড়ে ওঠা কলকারখানায় শ্রমিকদের সংগ্রাম। তার সাম্যবাদ ইউরোপীয় এনলাইটমেন্টথেকে উৎপন্ন কমিউনিজম হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। জাতপাত, জমিদারতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটা বুর্জোয়া সাম্যবাদের অধিক বা অতিরিক্ত হবার পরিস্থিতিও ছিল না। দার্শনিক ছিলেন না যে চিন্তার পরিম-লে বাস্তবতার সীমা অতিক্রম করে যাবেন।
ভারতে ততোদিনে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছে, তিনি ঘনিষ্ঠ ভাবে কমিউনিস্টদের সংস্পর্শ পেয়েছেন । তবে তত্ত্ব বা আদর্শ হিসাবে কমিউনিজমের সঙ্গে তার বাহ্যিক পরিচিতি ঘটেছে, আন্তরিক পরিচিতির জন্য সমাজে যে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের প্রয়োজন ছিল সেটা তখন দানা বেঁধেছিল প্রমাণ করা মুশকিল। যদিও ইউরোপীয় রেনেসাঁর অনুকরণে ‘বাঙালি’র সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিগঠনকে ‘বাঙলার নবজাগরণ’ বলার চল শুরু হয়েছে। কিন্তু সেই নবজাগরণের দরজা কৃষিপ্রধান বাংলার কৃষক সমাজের জন্য প্রশস্ত ছিল না। ইতিহাসের এইসকল বাস্তবতা আমরা যেন না ভুলি।
অন্যেরা যেভাবেই মূল্যায়ন করুক, সাহিত্য ও গানের ক্ষেত্রে নিজের সম্পর্কে নজরুলের নিজের মূল্যায়ন আমার কাছে সবসময়ই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। নজরুল বলছেন
কাব্যে ও সাহিত্যে আমি কি দিয়েছি, জানি না। আমার আবেগে যা এসেছিল , তাই আমি সহজ ভাবে বলেছি, আমি যা অনুভব করেছি, তাই আমি বলেছি। ওতে আমার কৃত্রিমতা ছিল না। কিন্তু সঙ্গীতে যা দিয়েছি, সে সম্বন্ধে আজ কোনও আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে, ইতিহাস লেখা হবে তখন আমার কথা সবাই স্মরণ করবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে। সাহিত্যে দান আমার কতোটুকু তা আমার জানা নাই। তবে এইটুকু মনে আছে সঙ্গীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি;। (ইসলাম, কাজী নজরুল, ১৯৮৪, পৃষ্ঠা ১১০) কথাগুলো ১৯৩৮ সালের দিকে বলা। কলকাতায় ‘কৃষক’ পত্রিকার অফিসে, ‘জন-সাহিত্য সংসদের শুভ-উদ্বোধনে নজরুল ছিলেন সভাপতি। কথাগুলো তাঁর সভাপতির ভাষণের অংশ। নজরুল নিজের সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করেছেন তাকে অনেকে আক্ষরিক অর্থে বুঝতে ও মেনে নিতে পারেন। আমরা সেভাবে বোঝা বা মানার জন্য তাঁর পক্ষে বা বিপক্ষে তাঁর নিজের কথা সাক্ষ্য হিসাবে এখানে খাড়া করছি না। যদি নিজের সম্পর্কে নজরুলের নিজের কথাই আমরা মানি তাহলে তো নজরুল নিয়ে বিচারবিবেচনার বিশেষ আর দরকার পড়ে না। বড় জোর তাঁর কথা প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা আরও তথ্য ও সাক্ষীসাবুদ নিয়ে প্রমাণ করে দিতে পারি যে,
১. নজরুল আবেগী ছিলেন, তাঁর কবিতা ও সাহিত্য কর্ম আবেগ নির্ভর এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে আবেগসর্বস্ব। ফলে কবি বা সাহিত্যিক হিসাবে তাঁকে খুব বড় মাপের কিছু বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথের যে পরিশীলিত রূপ তা নজরুলে নাই, অন্যদিকে রবীন্দ্রোত্তর ‘আধুনিক’ বাংলা কবিতার আধুনিকতাও তাঁর মধ্যে অনুপস্থিত। জীবানানন্দ কবিতা লেখার শুরুর দিকে তাঁর দ্বারা কিছুটা সংক্রামিত হলেও দ্রুতই তিনি তা কাটিয়ে নিজের কন্ঠস্বর তৈয়ার করে নেন। নজরুল নিজেও কাব্য ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। ২. নজরুলের মূল অবদান সঙ্গীতে। নিজের সম্পর্কে তাঁর এই মূল্যায়ন সঠিক। এখন ২০১৩ সালে নজরুলকে আমরা প্রধানত সঙ্গীতকার হিসাবেই চিনি। কিন্তু সঙ্গীতে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা বহাল রয়েছে। এতেই বোঝা যায় নিজের সম্পর্কে তাঁর নিজের মূল্যায়ন খুবই সঠিক ছিল। যেহেতু তাঁর অবদান প্রধানত সঙ্গীতে অতএব এখনকার বাংলা কাব্যে ও সাহিত্যে তিনি আর আগের মতো প্রভাবশালী নন, প্রাসঙ্গিকও নন। নজরুলের নিজের এই মূল্যায়নকে যদি আমরা অতিরিক্ত গুরুত্ব দেই তো এই ধরণের সিদ্ধান্তেই আসতে হয়। কিন্তু নজরুলের নিজের কথার তাৎপর্য আমরা এই প্রকার আক্ষরিক অর্থে বুঝতে চাই না। তিনি নিজেকে যেভাবে মূল্যায়ন করছেন সেই মূল্যায়ন সে সময়ের সাহিত্যের একটা লক্ষণ হিসাবে আমরা পড়ব। তার আক্ষরিক মানে গৌন, এই ক্ষেত্রে তার লাক্ষণিক অর্থ অনুধাবনই ছহি পথ। ওতে আক্ষরিকতার একটা আলাদা মানে দাঁড়াতে পারে— আমরা সেই বিশেষ মানের মধ্যেই তাঁর নিজের সম্পর্কে নিজের মূল্যায়নের তাৎপর্য খোঁজার পক্ষপাতী। ভবিষ্যতে সেই তাৎপর্য বিচারের জন্য কিছু বাড়তি প্রশ্ন এখানে তুলে রাখব। প্রশ্নগুলো এরকম হতে পারে :
১. আবেগ বা স্বতঃস্ফূর্ততা ছাড়া কাব্য বা সাহিত্য আদৌ সম্ভব কি? কবিতা বা অপরাপর সাহিত্যের সঙ্গে আবেগের সম্পর্ক বিচার আসলে নন্দন তত্ত্বের বিষয়। নান্দনিকতার বিচার ছাড়া নজরুলের এই আত্ম-মূল্যায়নের বিচার সম্ভব না। সাহিত্য শুধু যুক্তি বা কল্পনার চাহিদা মেটায় না, আবেগের চাহিদাও মেটায়। ২. ‘আবেগ’ বা ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’কে নজরুল নেতিবাচক গণ্য করছেন কেন? তাঁর সময়ে কবিতার নন্দনতাত্ত্বিক দিক সম্পর্কে যে ‘আধুনিক’ রুচি গড়ে উঠেছিল তাকে কি কোন নন্দনতাত্ত্বিক তত্ত্ব দিয়ে তিনি মোকাবিলা করতে পারছিলেন না? সেই সময়ে দ্রুত গড়ে ওঠা ‘আধুনিক’ কাব্য রুচিকেই কি মেনে নিচ্ছেন নজরুল?
৩. কিন্তু বিমূর্ত নন্দনতত্ত্ব; অর্থাৎ ভাল কবিতা বলতে কী বোঝায়, তার মধ্যে আবেগ কিভাবে কি পরিমান কি মাত্রায় থাকবে? তার কোন সার্বজনীন পরিমাপদ- খাড়া করা কি সম্ভব? কারণ দেশকালপাত্রভেদে আবেগ সম্পর্কে ধারণারও বদল ঘটেছে, কবিতা লেখা ও তার মূল্যায়নের মানদ-েও পরিবর্তন এসেছে। নজরুল তাহলে ‘আবেগ’ বলে যাকে মন্দ জ্ঞান করছেন সেই জিনিসটা আসলে কী? হয়তো রবীন্দ্রোত্তর সময়ে গড়ে ওঠা কাব্যরুচি সংক্রান্ত যে তত্ত্ব গড়ে উঠেছিল সেই পরিপ্রেক্ষিতেই নজরুল তার আবেগী উৎক্ষেপকে দোষ ধরে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রবলয় থেকে বাংলা কবিতার বেরিয়ে আসার যে সন্ধিক্ষণ তার বিচার তাহলে এই ক্ষেত্রে জরুরী হয়ে পড়ে।
৪. রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বিজেন্দ্র বা রজনীকান্ত কেউই বিশুদ্ধ সঙ্গীতকার নন। অর্থাৎ তাঁদের অবদান বিশুদ্ধ সঙ্গীতে নয়, বরং কথাসম্পন্ন গানে। তারা নতুন রাগরাগিনীর আবিষ্কার করেছেন, কাব্যগীতিতে রাগরাগিনীর ব্যবহারে অনেক মুন্সিয়ানাও দেখিয়েছেন; এই প্রতিভার তুলনামূলক আলোচনা হতে পারে। সঙ্গীতে নজরুল কিছু দিতে পেরেছেন বলে মনে করতেন কেন? এ কারণে কি যে তিনি গানের বাণীর চেয়েও সুরের ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় বেশী মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন?
নজরুল তাহলে নানান দিক থেকে একটা সন্ধিক্ষণের লক্ষণ? যার তাৎপর্য তখনকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা, রাজনীতি ও ইতিহাসের মধ্যে নিহিত? সম্প্রদায় হিসাবে বাঙালি মুসলমান সবে ঔপনিবেশিকতার ফলাফল হিসাবে গড়ে ওঠা হিন্দু ভদ্রলোক সমাজের পাশাপাশি দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। নজরুলের আবেগকে সেই সম্প্রদায়ের আবেগ থেকে আলাদা করা কঠিন। নজরুল পুরানা ভদ্রলোক সমাজের বাইরে কৃষি প্রধান বাংলায় যে নতুন সমাজ গড়ে উঠছিল সেই নতুন সমাজের আবেগ বহন করছিলেন। যদি তাই হয় বাঙালি মুসলমান থেকে তাকে আলাদা করে বোঝার চেষ্টা করে লাভ নাই। তিনি ঐতিহাসিক কারনে বিভক্ত বাঙালির অবিভাজ্য সত্তাকে যেভাবে ধরে রাখবার চেষ্টা করেছেন সেটা ব্যর্থ হয়েছে, সন্দেহ নাই। ব্যর্থ হওয়াই তার নিয়তি ছিল। তারপরও এই প্রয়াসের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষণীয় বিষয় আছে প্রচুর।
সমাজে মানুষ নিজেকে নানান স্তরে নানান পরিচয়ে পরিচয় দিতেই পারে। এটাই স্বাভাবিক। মসজিদে বা মন্দিরে যখন কেউ যায় তখন তার ধর্মীয় পরিচয়ই মুখ্য, কিন্তু বাংলা সাহিত্য বা সংস্কৃতির জগতে তার পরিচয় বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসের মধ্যেই। বাংলাদেশের জনগণ সেখানেই তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় অন্বেষন করে। কিন্তু যখনই ধর্ম, ইতিহাস বা ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক বাঙালিত্বের পরিচয়কেই একমাত্র রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পরিচয় হিসাবে স্থির করার দাবি ওঠে তখন বাংলাদেশের জনগণ প্রত্যাখান করে। এর কারন এই নয় যে তারা তাদের ধর্মীয় পরিচয়কেই প্রধান গণ্য করে। না মোটেও তা নয়। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে নিজেদের ঐতিহাসিক গঠন ও পরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্র থেকে ধর্মকে বাদ দেওয়ার অর্থ একই সঙ্গে কৃষক হিসাবে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমি হারানোর বেদনা এবং জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার রক্তক্ষয়ী ইতিহাসকেও খারিজ করে দেওয়া। আজ বেয়াল্লিশ বছর পরেও দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ তা মেনে নেয় নি। বাংলাদেশের জনগণ ইতিহাস সচেতন। ইতিহাস অস্বীকার করবার এই রাজনীতির তারা বিরোধিতা করবে। নজরুল কবি বলে সে সচেতনতাকে ‘প্রাণের সাড়া’ হিসাবে বুঝেছেন। যতোটুকু সাড়া পান নি ততোটুকু রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ ও বিবেকানন্দকেও গ্রহণ করেন নি।
এতোটুকু যদি বুঝি তাহলে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ভাবে সচেতন বাংলাদেশের ‘বাঙালি’; না, ঠিক বলি নি; বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠিকে বোঝা সহজ হবে। ( সূত্র: অন্যদিগন্ত ান লাইন) ২৮ নভেম্বর ২০১৩; ১৪ অগ্রহায়ন ১৪২০। আরশিনগর। বইপত্র: আব্দুল কাদির. (১৯৬৬). নজরুল রচনাবলী. ঢাকা: বাংলা একাডেমী. ইসলাম, কাজী নজরুল. (১৯৮৪). নজরুল রচনাবলী, চতুর্থ খ-. ঢাকা: বাংলা একাডেমী. চক্রবর্তী, জ. (২০০৩). বাঙলা ভাগ হোলঃ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাও দেশবিভাগ ১৯৩২ -১৯৪৭. ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড. নজরুল ইসলাম. (১৯৬৬). নজরুল রচনাবলী, প্রথম খ-. ঢাকা: বাংলা একাডেমী