দেশের অর্থনীতি অনেকদিন ধরেই ইতিবাচক অবস্থানে নেই। অর্থনীতির সূচকগুলো নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে। এই নিম্নমুখিতা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। অন্তত দু’বছর ধরে এটা নিম্নমুখী রয়েছে। সরকার এ দিকে নজর দেয়নি। আর এখন তো নজর দেয়ার সময়ও তার নেই। অতএব, অর্থনীতির উদ্ধার অনিশ্চয়তার মধ্যেই রয়ে যাচ্ছে। পণ্যমূল্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে। খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এমন কোনো নিত্যপণ্য নেই, যার দাম হু হু করে না বাড়ছে। চাল, ডাল, আটা, তেল, চিনি, লবণ থেকে শুরু করে শাক-সবজি পর্যন্ত সব কিছুই নিম্নবিত্তের এমন কি, মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে চলে গেছে। এর বিপরীতে তাদের আয় বাড়েনি, বাড়েনি ক্রয়ক্ষমতা। বরং অনেকের আয় কমেছে কিংবা বন্ধ হয়ে গেছে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের পরিবারে রীতিমত অমানবিক অবস্থা বিরাজ করছে। সামষ্টিক অর্থনীতি নিক্ষিপ্ত হয়েছে গভীর খাদে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে এবং এক নাগাড়ে কমছে। গত বুধবার রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। আমদানি, ঋণ পরিশোধ, পাচার ইত্যাদি কারণে ডলার সংকট প্রকট। জরুরি আমদানির জন্য এলসি খোলাও সম্ভব হচ্ছে না। ওদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান দফায় দফায় কমছে। ডলার আসার সবগুলো উৎসধারাই নিম্নমুখী। রফতানি ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। রফতানি আয় কমছে। চলতি বছরে প্রথম ৩ মাসে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৩৯৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এসেছে ১ হাজার ৩৯৮ কোটি ৫৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বৈদেশিক মুদ্রার আরেকটি বড় উৎস। এখাতেও আয় কমছে। গত মাসে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১৩৪ কোটি ডলার, যা ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। চলতি বছরের ৩ মাসে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। বৈদেশিক ঋণ সহায়তা বৈদেশিক মুদ্রার আরেকটি উৎস। চলতি বছরের প্রথম দু’মাসে নিট ঋণ সহায়তা এসেছে মাত্র ৪৫ কোটি ডলার। গত বছর দু’মাসে এসেছিল ৬৫ কোটি ডলার। বিদেশি বিনিয়োগ তো বলতে গেলে নেই-ই। এটাও বৈদেশিক মুদ্রার একটি উৎস। চলতি বছরের প্রথম দু’মাসে নিট এফডিআই এসেছে মাত্র ৩৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এটি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সামান্য বেশি। বিদেশি বিনিয়োগের খরা যে কাটছে না, এ থেকে তার প্রমাণ মেলে।
আমদানি-রফতানির ব্যবধান ক্রমবর্ধমান। বরাবরই এই ব্যবধান বিদ্যমান। ভারসাম্য আসবে কিংবা আমদানির তুলনায় রফতানি বাড়বে, এমন লক্ষণ নেই। রফতানি যাই হোক, প্রয়োজনীয় পণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল তো আমদানি করতেই হবে। এজন্য বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলারের বেশি বেশি আগম ও মজুদ দরকার। বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজমান তাতে বৈদেশিক মুদ্রা বাড়ানোর সুযোগ খুবই কম। সবচেয়ে বড় কথা, যে রিজার্ভ এখন আছে, তাও দ্রুত কমে যাচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম দু’ মাসে ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি। আগামীতে বেশি অংকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে বাড়তি ডলার। অর্থনীতির এই নাজুক পরিস্থিতিতে কী করণীয় অর্থনীতিবিদরা সে বিষয়ে বিভিন্ন রকম পরামর্শ দিচ্ছেন। তাদের সকলেই একমত, বেশি করে ডলার আনতে হবে। ডলার আসার উৎসগুলোর প্রতি নজর দিতে হবে। রফতানি বাড়াতে হবে। অধিকহারে রেমিট্যান্স আনতে হবে। হুন্ডি রুখতে হবে। বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অপব্যয় ও অপচয় রোধ করতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নে বাহুল্য বর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়ন না ঘটলে যে কোনো মুর্হূতে গণবিস্ফোরণ ঘটতে পারে। রাজনৈতিক কারণে গণক্ষোভ যে স্তরে পৌঁছেছে, অর্থনৈতিক কারণ তার সঙ্গে শামিল হলে প্রচ- গণবিস্ফোরণ কেউ ঠেকাতে পারবে না। এতে দেশে এক ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এই সমূহ আশংকার প্রেক্ষাপটে সরকারকেই দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার বিকল্প নেই।
আমাদের গার্মেন্ট শিল্পে মার্কিন ভিসানীতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে শুরু করেছে। ক্রয় অর্ডার কমে যাওয়ার কারণে গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটি জাতায় দৈনিকে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, গত শনিবার সাভারের ফুলবাড়িয়ার ডার্ড ওয়াশিং প্ল্যান্ট লিমিটেড লে-অফ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সেখানে কর্মরত ৩শ’ কর্মী কাজ হারিয়েছে। তারা জানিয়েছে, মিড লেভেলের কর্মীদের ৫ থেকে ১১ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। শ্রমিকদের বেতন বকেয়া রয়েছে ১ মাস। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, এর আগে বকেয়া পাওনাকে কেন্দ্র করে একই মালিক-কর্তৃপক্ষের ডার্ড গার্মেন্টস লিমিটেড ও দীপ্ত গার্মেন্টস লিমিটেড বন্ধ করে দেয়া হয়। ডার্ড গ্রুপের প্রধান জানিয়েছেন, অর্ডার শূন্যের কোটায় নেমে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা হয়েছে। অনেক দিন ধরেই অর্ডার নেই। স্মরণ করা যেতে পারে, আমাদের গার্মেন্ট পণ্যের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ওই দুই বাজারে আমাদের রফতানি ক্রমাগত কমে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য বিশেষ ভিসানীতি ঘোষণা করে। এর প্রভাবও এ অবস্থার ওপর পড়ে। ভিসানীতি ঘোষণার পর বাংলাদেশের গার্মেন্ট রফতানিকারকদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ও শংকা দেখা দেয়। আশংকা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র আমদানি আরো কমিয়ে দিতে পারে, ইউরোপীয় ইউনিয়নও যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করতে পারে। ফলে, গার্মেন্ট রফতানিতে একটা বড় রকমের ধস নেমে আসতে পারে। অর্ডার কমে যাওয়া কিংবা অর্ডার একেবারেই না পাওয়ায় গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা দুর্ঘট পরিস্থিতি সৃষ্টির বার্তা দেয়। কিছুদিন আগে বিজিএমইএ’র সভাপতি একটি দৈনিকের অনলাইনে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, দেশের পরিস্থিতিতে তারা ভালো নেই, নানারকম চাপে আছেন। গার্মেন্ট খাতে মার্কিন ভিসানীতির প্রভাব না পড়লেও আরো নিষেধাজ্ঞা আসলে রফতানিতে সমস্যা হবে। নিষেধাজ্ঞা আসছে, এই খবরে মালিকদের মধ্যে আতংক দেখা দিয়েছে। এখন তো দেখা যাচ্ছে, রফতানি হ্রাস ও মার্কিন ভিসানীতির প্রভাব ভালোভাবেই পড়তে শুরু করেছে।
আমরা মনে করি, দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া এবং মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। আশা করি সরকার বিষয়টি গুরুত্বে সাথে বিবেচনা করবে।