মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৬ পূর্বাহ্ন

বাইডেনের অপমান

মুজতাহিদ ফারুকী
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৩

ছেলেবেলা থেকেই হিটলারের ইহুদি নিধনের নিন্দামন্দ শুনে বড় হয়েছি। মনে হতো, লোকটা সত্যি জঘন্য ছিল। মহত্তম কবি ও নাট্যকার শেকসপিয়রের মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকে ইহুদিদের অমানবিক চরিত্রের অবিশ্বাস্য দৃষ্টান্তও ভুলে থাকতাম আধুনিক কালের তথাকথিত হলোকাস্টের নাটকীয় উপস্থাপনায়। এতে আরো সহায়ক হয়েছে প্রচারণার জোয়ারে প্রায় অতিমানবে পরিণত এক ইহুদি বালিকার অশ্রুভাসানো ডায়েরির করুণ ভাষ্য। ভুলে থাকতাম অ্যানা ফ্রাঙ্কের মতো কত হাজার হাজার অথবা লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বালিকা, শিশু, বৃদ্ধ, নারী ও পুরুষ নিজ দেশে, নিজ ঘরে প্রতিদিন হলোকাস্টের শিকার হচ্ছে। তারা পালিয়ে বাঁচতে পারছে না। তাদের যাবার জায়গা নেই। আশ্রয়দাতা নেই। দুঃখ দূরের কথা, তাদের গণহারে মৃত্যুতেও ন্যূনতম ‘উহ্’ শব্দটি উচ্চারণ করার মতো দরদি এত বড় পৃথিবীর কোথাও একজনও নেই। উৎখাত, বিতাড়ন, নিপীড়ন, নিষ্পেষণ, অপমান আর মৃত্যুই তাদের একমাত্র নিয়তি। এর জন্য দায়ী কে? সেই ইহুদিরা, যারা ছিল হিটলারের কথিত হলোকাস্টের অসহায় শিকার। জার্মানি ইহুদিদের দেশ ছিল না। সেই ভূখ-ের ওপর তাদের কোনো দাবি ছিল না। কিন্তু ফিলিস্তিন হাজার হাজার বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের আবাসভূমি। আজকের ইহুদিরা সেখানে বহিরাগত (যে ইহুদিরা হাজার বছর ধরে ফিলিস্তিনে বসবাস করছেন তাদের কথা বলছি না)।
ইহুদিরা তাদের উগ্রতা ও নিষ্ঠুরতার জন্য যুগ যুগ ধরে গোটা বিশ্বেই ঘৃণিত, নিন্দিত ছিল। এন্টিসেমেটিক (ইহুদিবিদ্বেষ) কথাটার উৎপত্তি এই ঘৃণা থেকেই। ঘৃণিতদের সংস্পর্শ থেকে বাঁচতেই ব্রিটিশরা এই বিষফোঁড়া উপড়ে ফেলে ফিলিস্তিনে রয়েছিল, এমন ভাবা অযৌক্তিক নয়। কিন্তু সব দেশ পারেনি। জার্মানিতে বসেই এক বিখ্যাত ইহুদি দার্শনিক গোটা বিশ^ব্যবস্থা পাল্টে দেয়ার মতো রাজনৈতিক তত্ত্ব, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র হাজির করেন। তিনি কার্ল মার্কস। আর রাশিয়ায় বসে আরেক মহান (!) ইহুদি ঘোষণা করেন, যদি প্রতি ১০ জন মানুষের মধ্যে ৯ জনকেও হত্যা করতে হয়, তাই করব, তবু সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ছাড়ব। চরিত্রের গভীরে কতটা বীভৎস অন্ধকার, বুঝতে অসুবিধা হয়? হিটলারের হলোকাস্টে ৬০ লাখ ইহুদি হত্যার গল্প জড়ানো। আর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে অর্থাৎ দুনিয়া কাঁপানো অক্টোবর বিপ্লব এবং তারপর লাখ লাখ (কেউ বলেন ৬৬ লাখ; নিশ্চিত পরিসংখ্যান কেউ প্রকাশ করে না; অদ্ভুত!), অর্থোডক্স খ্রিষ্টানকে হত্যা করা হয়। মজার ব্যাপার হলো লেনিন, ট্রটস্কিরা চতুর ও চালাক। তারা হিটলারের মতো প্রকাশ্য ঘোষণা দেননি। রাজনৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার নামে, বিশে^র সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে সুচারুভাবে কাজটি সম্পন্ন করেন। চালটা এতই সূক্ষ্ম যে, প্রশ্ন তোলারও সুযোগ নেই। কেউ প্রশ্ন তুললে বরং হেসে উড়িয়ে দেয়াই হবে যথার্থ প্রতিক্রিয়া। ইউরোপ আমেরিকা তো প্রশ্ন তোলা সরাসরি নিষিদ্ধ করে রেখেছে। এখানেই কিন্তু মজার শেষ না। ইহুদিরা আমেরিকাকেও নিজের গোলামে পরিণত করেছে। আমেরিকাবাসী প্রধানত রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। তারা নিজেদের পৃথিবীর হর্তাকর্তা বিধাতা মনে করে। আসলে তারা যে ইহুদিদের চিলমচিবরদার, বুঝতেই পারে না (মার্কিন রাজনীতি, অর্থনীতিতে ইহুদি প্রভাব সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন)।
একটি ছবির কথা বলি। হামাসের মার খেয়ে নেতানিয়াহু যখন বাইডেনের বুকে মাথা ঠেকিয়ে ভেউ ভেউ করছিলেন (বুধবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৩), সেই দৃশ্যটি স্মরণীয়। যেন পাঁচ বছরের বাচ্চাটা ভালুকের তাড়া খেয়ে ছুটে এসে বাবার বুকে মুখ লুকিয়েছে। বাবা সান্ত¡না দিয়ে বলছে, ভয় নেই, আমি আছি তো! সাহস রাখো বেটা, তোমার জন্য বন্দুক নিয়ে আসব! দৃশ্যটা বাইরে থেকে ঠিক আছে। কিন্তু ভেতরে চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। নেতানিয়াহুই আসলে বাবা এবং বাইডেন পুত্রও নয়, গোলাম। কীভাবে?
দেখুন, ৭ অক্টোবর ভোরে হামাস যখন গাজা থেকে বিপুল বিক্রমে ইসরাইলে আকস্মিক হামলা চালায় তখন আমেরিকার প্রথম প্রতিক্রিয়া কী ছিল? ইসরাইলকে মদদ দিতে বিশাল বিমানবাহী রণতরী পাঠানো। আর বাইডেন কী করলেন? তিনি স্বপ্নে দেখলেন, ফিলিস্তিনিরা, মানে হামাস সদস্যরা ছুরি দিয়ে ছোট ছোট ইসরাইলি মেয়েদের গলা কেটে হত্যা করছে। পরে হোয়াইট হাউজ বলেছে, না, ওইরকম কোনো ছবি প্রেসিডেন্ট বাইডেন দেখেননি। তাহলে ঘটনাটা কী? বড় বড় আদর্শের বুলি বাদ দিই, বাইডেন নিছক ভদ্রতার মুখোশটুকুও ছুড়ে ফেললেন কেন? ইসরাইলকে খুশি করতে তো! এটা মোসাহেবি নয়! ধারণা ছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্পই যুক্তরাষ্ট্রের এ যাবৎকালের সবচেয়ে মিথ্যাবাদী, সবচেয়ে অনৈতিক, সবচেয়ে স্বৈরাচারী এবং সবচেয়ে অভদ্র প্রেসিডেন্ট। ভুল ভাঙল। বাইডেন আরো এককাঠি সরেস। আমেরিকার পচন ধরেছে মাথাতেই। শুধু তো এটুকু নয়। ১৮ অক্টোবর যে দিন বাইডেন ইসরাইলে গিয়ে নেতানিয়াহুকে বুকে ধরেন, সে দিনই যেন বাবার উপস্থিতিতে সাহস পেয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গাজার হাসপাতালে বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। ৫০০ বেসামরিক নাগরিক, যাদের মধ্যে রোগী, আহত মানুষ, নারী, শিশুসহ সব ধরনের মানুষই ছিল। এটি স্পষ্টই গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, নিশ্চিতভাবে মানবতাবিরোধী কাজ। এর পরই ঘটে অবিশ্বাস্য দুটি ঘটনা। প্রথমটি অপ্রত্যাশিত ছিল না। বাইডেন বললেন, হাসপাতালে হামলা ইসরাইল নয়, চালিয়েছে ফিলিস্তিনিদেরই আরেক গ্রুপ ইসলামিক জিহাদ। তিনি ইসরাইলকে গণহত্যার দায়মুক্তি দিলেন। মুসলিমদের ক্ষেত্রে এভাবেই তারা সত্যের প্রতি তাদের কথিত অঙ্গীকার ভুলে যান। এভাবেই ৯/১১-এ ইহুদিদের মার খেয়ে (টুইন টাওয়ার ধ্বংসে একজনও ইহুদির মৃত্যু হয়নি, এই তথ্য কেউ উড়িয়ে দেয়নি), তার বদলা নিতে মিথ্যা অভিযোগ চাপিয়ে বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু করেন। যুদ্ধ ও প্রেমে নয়, স্বার্থের জন্য ওরা কোনো কিছুতেই ন্যায়-অন্যায় মানেন না।
দ্বিতীয় যে অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটে সেটি অভাবিতই। বাইডেনের সাথে বৈঠক করতে অস্বীকৃতি জানান তিন আরব নেতা, জর্দানের বাদশাহ, মিসরের প্রেসিডেন্ট এবং ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাস।
যুগের পর যুগ ধরে যারা যুক্তরাষ্ট্রকেই একমাত্র মিত্র হিসাবে জেনেছে, নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা ও নিরাপত্তার গ্যারান্টর হিসাবে মেনেছে, তারাই বাইডেনের সাথে বৈঠক বাতিল করছেন, বিশে^র অষ্টম আশ্চর্য যেন। এতে ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতিশীলদের খুশির কিছু আছে কি? না, নেই। আরব নেতারা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এক হয়েছেন, এমন নয়। বরং তারা বাইডেনের সঙ্গে এই মুহূর্তে দেখা করতে চাননি ক্ষমতা হারানোর ভয়ে। গোটা আরব বিশে^ এখন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অভূতপূর্ব গণজাগরণ চলছে। প্রতিদিন লাখো মানুষ বিক্ষোভ করছেন ফিলিস্তিন ইস্যুতে নেতাদের জোরালো ভূমিকার দাবিতে। তাই বাইডেনের চক্রান্তে পা দিলে নিজেদের অস্তিত্বে টান পড়ার শঙ্কা আছে। বৈঠক বাতিল এই কারণে। বাইডেনের চক্রান্তটা কী? গাজাবাসীকে উৎখাত করে মিসর, জর্দান বা অন্য কোথাও ঠেলে দেয়া যেটি ইসরাইলের লক্ষ্য। এতে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার সময় ফিলিস্তিনিদের ওপর যে ‘নকবা’ বা মহাবিপর্যয় নেমে এসেছিল, স্বঘোষিত ইহুদিবাদী বাইডেন সেই মহাবিপর্যয় এবার চাপিয়ে দিতে চান গাজাবাসীর ওপর। নকবায় বিতাড়িত হয়েছিল সাত লাখের বেশি ফিলিস্তিনি। গাজা থেকে এবার বিতাড়িত হবে ২২ লাখ ফিলিস্তিনি (আল্লাহ না করুন)।
তবে আমেরিকা আছে বেশ বেকায়দায়। মাত্র ক’দিন আগে বাইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সারারাত অপেক্ষায় রেখে দেখা না করে বিদায় করেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। এরপর খোদ বাইডেন প্রত্যাখ্যাত হন। আমেরিকার জন্য রীতিমতো অপমানজনক। বিশ^ রাজনীতিতে এর গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। তাকে কেউ ভরসাযোগ্য ভাবতে পারবে না। বিশ^াস করতেও দ্বিধায় ভুগবে। কিন্তু আপাতত কিল হজম না করে উপায় নেই। খোলাখুলি বলে দেয়াই যায়, ইউক্রেনে সম্ভাব্য পরাজয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বাইডেনের পক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধ শুরুর ঝুঁকি নেয়া অসম্ভব। আরব নেতারা যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল তেমনই যুক্তরাষ্ট্রও তাদের ওপর। আর রাশিয়া, চীন, ইরান, তুরস্ক অবশ্যই মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক।
হামাসের হামলায় একটি বড় কাজ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সেই ’৮০-র দশক থেকে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি করে ফিলিস্তিনিদের নিষ্ক্রিয় ও নিরস্ত্র করার কাজটি প্রায় সম্পন্ন করেছে। যেমন পিএলও। এমনকি বিশে^ ফিলিস্তিনি আরব বলে কোনো জাতির অস্তিত্ব আছে, তাদের প্রতিদিন গুলি করে মারা হচ্ছে, তাদের জায়গা জমি কেড়ে নিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, উপাসনালয় অপবিত্র করা হচ্ছে, বন্দী জীবনযাপনে বাধ্য করা হচ্ছে এসব বিশ্ববাসীর চোখের আড়ালে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। ভুলতে বসেছিল সবাই। হামাসের এক হামলায় সেই সত্যটা সামনে চলে এসেছে। ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বের দুর্মর ঘোষণা শোনা গেছে পৃথিবীর সব কোণে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যে কেউ মরিয়া হয়ে পাল্টা আঘাত হানবে, এ তো জানা কথা। ইহুদি বর্বরতার জবাবে হামাস ঠিক সেটাই করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যতই শক্তি দেখাক, ফিলিস্তিন সঙ্কটের ন্যায্য সমাধান তাকে করতে হবে। না হলে তারও বিপদ। চীন বসে নেই।শেষ কথা : মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে, পৃথিবীর বিষফোঁড়া উপড়ে ফেলতে গিয়ে হিটলার কি সত্যি অপরাধ করেছেন? তার চেয়ে বেশি আর কে চিনেছে ইহুদি চরিত্র, শেকসপিয়রের পরে! mujta42@gmail.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com