এ বছর দেশে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পাঁচ মাস গত হয়ে গেল। শুরুতেই রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক সংক্রমণ ও মৃত্যু এখন সারা দেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। অক্টোবর ২১ তারিখে মৃত্যুসংখ্যা ১ হাজার ২৪৬ জন অতিক্রম করেছে, আক্রান্ত হয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার ৯৯০ জন। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর এই পরিসংখ্যান গত ২৪ বছরের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
মানুষের দৃষ্টির বাইরে জন্ম নিচ্ছে এডিসের ছানা। অজান্তেই কামড়ে দিচ্ছে সুস্থ মানুষকে। সৃষ্টি হচ্ছে ভয়ংকর ডেঙ্গু রোগের। করোনার মতো ডেঙ্গুকে কেউ আর ‘বড় লোকের অসুখ’ বলে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার ফুরসত পাচ্ছেন না। শহর-নগর, বন্দর ও গ্রামগঞ্জের সবাই এখন ডেঙ্গুর ভয়ে ভীত হয়ে জীবনযাপন করছেন। গ্রামীণ সংক্রমণের গতি এখন শহরের তুলনায় বেশি বলে প্রতীয়মান হওয়ায় রিমোট এলাকার মানুষ অজানা ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
বিশেষ করে মফস্সলের ডেঙ্গু রোগীদের রাজধানী ঢাকার হাসপাতালে চিকিৎসা করতে আসার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় ডেঙ্গুমৃত্যুর ভীতি আরো জেঁকে বসেছে। সাধারণত গ্রামীণ জনজীবনে রোগবালাই হলে দরিদ্র মানুষ ওঝা-কবিরাজের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। কিন্তু অপেক্ষাকৃত নতুন রোগ হওয়ায় এবং দ্রুত স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে থাকায় ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় ওঝা-কবিরাজের কাছে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই তো জ্বর কয়েক দিন স্থায়ী হলে ডেঙ্গু মনে করে সবাই ছুটছেন স্থানীয় হাসপাতালে। কিন্তু স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবায় ডেঙ্গুর চিকিৎসা অপ্রতুল হওয়ায় কারো রক্তের প্রয়োজন হলেই আঁতকে উঠছেন রোগীর স্বজনেরা। কারো প্লাটিলেট কমে গেলে স্থানীয় হাসপাতাল থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে নিকটস্থ মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও রোগীর চাপ বেশি থাকায় এবং পর্যাপ্ত সুচিকিৎসা না থাকায় সংকটাপন্ন ডেঙ্গু রোগীর জীবন বাঁচাতে হন্যে হয়ে ছুটে যাচ্ছেন ঢাকা শহরের দিকে। গ্রামের কোনো রোগী যখন বেশি মুমূর্ষু হয়ে পড়ে অথবা স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যখন বেশি বিপদ আঁচ করেন, ঠিক তখনি রোগীকে ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেন। অনেকের সেই সামর্থ্য নেই বিধায় তাদের রোগীরা উন্নত চিকিৎসাসেবা ব্যতিরেকে মারা যাচ্ছেন। মুমূর্ষু যাদের ঢাকার হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই অতি বেশি দেরি করে ঢাকায় আসায় চিকিৎসাসেবা নিয়েও প্রাণ হারাচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এসব রোগীর ৬৩ শতাংশের মৃত্যু ঘটে হাসপাতালে ভর্তির চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে।
এছাড়া গ্রামীণ রোগীরা অনেকই দরিদ্র। তারা খরচের ভয়ে হাসপাতালে যেতে চান না। এছাড়া গ্রামীণ সচ্ছল রোগীরা অসচেতন হওয়ায় অনেকটা অবহেলা করে ডেঙ্গু টেস্ট করতে চান না। এভাবে সেখানকার ৭০-৭৫ শতাংশ মানুষ ডেঙ্গু টেস্ট করাতে চান না বলে এক হিসেবে বলা হয়েছে। স্থানীয় কোনো কোনো ক্লিনিকে অতিরিক্ত ফি আদায় করা হচ্ছে। গত ১০০ দিনে দৈনিক ১০-১২ জন করে ডেঙ্গুরোগী মারা গেছেন। মৃত্যুর এই গতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা বলা মুশকিল। এভাবে গ্রামীণ ডেঙ্গু সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ও চিকিৎসাব্যবস্থায় সমন্বয় না থাকায় নিয়ন্ত্রণে আসছে না গোটা দেশের ডেঙ্গুমৃত্যু ও সংক্রমণের হার। ফলে এক মাসের রেকর্ড ভেঙে যাচ্ছে পরের মাসেই। এ মৃত্যুতে কর্তৃপক্ষের কোনো গরজ নেই বলে মনে হওয়ায় মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে এ বছর সংক্রমণের শুরু থেকে ডেঙ্গুতে শিশু মৃত্যুহার বেশি হওয়ায় মানুষের মধ্যে বেশি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এদিকে গ্রাম এলাকায় দৃষ্টির বাইরে ডেঙ্গুর সৃষ্টি ও ভয়ানক সংক্রমণের প্রবণতা যখন ঊর্ধ্বমুখী তখন শহরাঞ্চলের বড় বড় ৭৭টি হাসপাতালের ভর্তিকৃত রোগীদের মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করে এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে আরেক অশনিসংকেতের কথা।
ব্রিটেনের কেইল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকার বড় বড় হাসপাতালের আশপাশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বিপজ্জনক। গত জানুয়ারী ১ থেকে আগস্ট ১৭ পর্যন্ত শহরের ৭৭টি হাসপাতালের দেওয়া তথ্যের ওপর এই গবেষণা চালানো হয়।
রাজধানীর হাসপাতালের আশপাশের দুই কিলোমিটারের মধ্যে ৮৬ শতাংশ মানুষ বসবাস করে। অনেকেই জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা লাভের প্রত্যাশায় হাসপাতালের আশপাশে বাড়ি বানিয়ে বা ফ্লাট কিনে বসবাস করতে পছন্দ করেন। কিন্তু সমস্যা হলো এই হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী ও তাদের স্বজনেরা নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশে থকেন। কেউ বেড না পেয়ে হাসপাতালের খোলা বারান্দায় মশারিবিহীন শুয়ে রাত কাটান। তাদের অনেকের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ থাকে। গবেষণায় বলা হয়েছে, চার দিন ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১২দিন পর্যন্ত বয়ে নিয়ে বেড়াতে পারে। এসব ভাইরাসযুক্ত এডিস মশা কারো শরীরে হুল ফুটালে তা অসাবধানতাবশত আশপাশের দুই কিলোমিটারের বসতির মানুষের মধ্যে দ্রুত সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এর বিরুদ্ধে খুব দ্রুত সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া অন্যকোনো বিকল্প নেই। ডেঙ্গু নিয়ে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়নি। কারণ, কোনো ভৌগোলিক এলাকার জনগোষ্ঠীর বসবাসের ঘনত্বের বিচারে যদি কোনো সংক্রামক ব্যাধির ২০ শতাংশের বেশি জীবাণু সংক্রমণ লক্ষ্য করা হয়, তাহলে সেটাকে মহামারি হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। ঢাকার জনবসতির কাছে ২৪ শতাংশের বেশি এডিসের লার্ভা পাওয়া গেলেও সেটাকে আমলে নেওয়া হয়নি এবং মহামারি হিসেবে স্বীকার করা হয়নি। আর কোনো সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে তার ওপর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সহজ নয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশের মেগাশহর কলকাতার ভয়ানক ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের শিক্ষাটাও বাংলাদেশ আমলে নেয়নি। মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কঠোর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে তিন থেকে চার স্তরের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কার্যকর থাকায় তারা সফল হয়েছে। প্রথম স্তরে প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা। দ্বিতীয় স্তরে পারিবারিক সচেতনতা সৃষ্টি করা। তৃতীয় স্তরে প্রাতিষ্ঠানিক সচেতনতা (বিদ্যালয়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লাব, অফিস, সভা-সমিতি, হাটবাজার ইত্যাদি) এবং চতুর্থ স্তরে হাসপাতাল-ডাক্তার, নার্স ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত করে সচেতনতা সৃষ্টি ও টিম ওয়ার্ক ফর্মুলেশন করে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাকে সমন্বয় করা।
এই ধরনের টিমওয়ার্ক আমাদের নাগরিক দায়িত্ববোধের মধ্যে জাগ্রত করা সম্ভব হয়নি। এমনকি অদ্যাবধি এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়নি। ইউনিয়ন কম্যুনিটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোকেও ব্যবহার করা হয়নি। এজন্য ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কারো মধ্যে কোনো দায়বোধও লক্ষ করা যাচ্ছে না। সবার মধ্যেই একটা গা-ছাড়া ভাব লক্ষণীয়। অধিকন্তু মফস্সলের হাসপাতালে রক্ত-পরীক্ষা, স্যালাইন, সার্বক্ষণিক ডাক্তার, নার্স, ওষুধ কিছুই নাগালে না থাকা সত্ত্বেও কম্যুনিটি স্বাস্থ্যসেবার প্রশংসা প্রচার করা একটি প্রহসনে পরিণত হয়েছে। দেশীয় ডেঙ্গু টিকার কার্যকরিতার ট্রায়াল শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পর্যাপ্ত উৎপাদনে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেশের সব মানুষকে দ্রুত এই টিকা প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়াটাও খুব জরুরি। এ ব্যাপারে গ্রাম-শহরের অসম চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সমন্বয়ের মাধ্যমে আমাদের সবার ইতিবাচক নজরদারি কাম্য। তা নাহলে এডিসরা সারা দেশের মানুষকে আরো বেশি কামড়ানোর সুযোগ পাবে। ডেঙ্গু জীবাণু আরো বেশি ভয়ংকর হয়ে প্রাণ হরণে লিপ্ত হতে থাকবে বারো মাস, সারা বছর। মানুষ আরো বেশি হতাশ হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে দেরি করবে না। ( উৎস: দৈনিক ইত্তেফাক) লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।