সমরখন্দ, মধ্য এশিয়ার একসময়কার সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগরী। আমির তিমুর বা তৈমুর লংয়ের রাজধানী। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রভূমি এবং ইউরোপ থেকে পারস্য হয়ে চীন অবধি বাণিজ্যপথের কেন্দ্রের উল্লেখযোগ্য নগরী। পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে বাণিজ্য করতে হলে এ সমরখন্দ হয়েই যেতে হতো। যে পথ দিয়ে ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ের জন্য বেরিয়ে বাণিজ্য করে ফিরে আসতেন সে পথকে বলা হতো সিল্ক রোড বা রেশম পথ।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে এ নগরীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ৩২৯ খ্রিস্টাব্দে সমরখন্দ জয় করেন। কিছুদিন গ্রিক সাম্রাজ্যের অধীনে থাকার পর সমরখন্দ চলে যায় পারস্যের সাসানি সম্রাটদের হাতে। উমাইয়া খিলাফতের সময় মানে সপ্তম শতকে আরবের মুসলমানদের হাতে চলে যায় সমরখন্দের দখল। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এ সময়ে সমরখন্দের সাধারণ জনগণের মাঝে মিলেমিশে ছড়িয়ে পড়ে। ১২২০ সালে চেঙ্গিস খান এসে ল-ভ- করে দেয় সমরখন্দসহ মধ্য এশিয়ার বেশ কয়েকটি সমৃদ্ধ নগরী।
সমরখন্দের রক্ষাকর্তা হয়ে ১৩৭০ খ্রিস্টাব্দে আসেন তৈমুর লং। নিজের রাজধানী সাজিয়ে নেন এ নগরে। ধীরে ধীরে সাজিয়ে গুছিয়ে তোলেন ভেঙে যাওয়া, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নগরের সৌন্দর্য আর অর্থনীতি। নগরে তখন শিল্প-সাহিত্যের যে কদর শুরু হয়েছিল তা আজও বিদ্যমান। আমির তিমুর যুদ্ধক্ষেত্রে ও শত্রুর প্রতি ভয়াবহ নিষ্ঠুর হলেও রাজ্য পরিচালনা বা শিল্প-সাহিত্যের প্রসারে তার অবদান ছিল পুরোটাই। সে সময়টা ছিল মধ্য এশিয়ায় অর্থনীতি আর সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ। তার সময়ে নির্মিত স্থাপনা এখনো মাথা উঁচু করে সারা বিশ্বের বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তৈমুর বংশকে হটিয়ে ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে উজবেকরা সমরখন্দ দখল করে নেয়। এরপর রাশিয়া ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে নেয় এ নগরীর অধিকার।
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে উজবেকিস্তান স্বাধীন হলে সমরখন্দ উজবেকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ নগর হিসেবে পরিচিতি পায়। সমরখন্দ পৃথিবীর কাছে বর্তমানে পরিচিত এর অনন্য স্থাপত্য শিল্পের জন্য।
গোর-এ-আমির : সমরখন্দের নগরীর পিতা তৈমুর লংয়ের সমাধি নগরীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। তৈমুর লং বা জনসাধারণের ভাষায় আমির তিমুর জীবিত থাকা অবস্থায় নাতি সুলতান মাহমুদের জন্য নির্মাণ করেন এ সৌধ, প্রথমে এটি সুলতান মাহমুদের মাদ্রাসা ছিল। অকালে সুলতান মাহমুদের মৃত্যু হলে আমির তিমুর মাদ্রাসাকে তার সমাধিসৌধে রূপান্তরিত করেন। পরে আমির তিমুর, তিমুরের শিক্ষক সৈয়দ বারাকা, তিমুরের সন্তান শাহরুখ, নাতি উলুঘ বেগ, সুলতান মাহমুদ ও পরিবারের আরো কয়েকজন পুরুষ সদস্যকে এখানে সমাহিত করা হয়। সমাধিসৌধটি প্রাক-ইসলামিক, ইসলামিক ও পারস্য স্থাপত্যকলা অনুসরণ করে ১৪০৩ খ্রিস্টাব্দে নকশা করা হয়েছে। ইস্পাহানের বিখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ ইবনে মাহমুদ ভবনটির নকশা করেন।
গোর-এ-আমির বা আমির তিমুরের সমাধি নির্মিত হয়েছে ইট, পাথর, মোজাইক, টাইলসের সমন্বয়ে। অন্যান্য পারস্য স্থাপত্যকলার মতো উঁচু প্রবেশদ্বারের পুরোটাই নীল, ফিরোজা, গাঢ় নীল, আকাশি নীল রঙের মোজাইক দিয়ে জ্যামিতিক নকশা কাটা। এ নকশার খাঁজে খাঁজে ফুল, লতাপাতাও জায়গা করে নিয়েছে। মোজাইকের উপরাংশ মসৃণ ও টেকসই রাখার জন্য এর ওপর মায়োলিক টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ পদ্ধতিতে মোজাইকের ওপরে আগুন গড়িয়ে রঙিন মোজাইকের স্থায়িত্ব ও সৌন্দর্য বাড়ানোর পদ্ধতির নাম মায়োলিক। এটা টাইলসের মতো মসৃণ।
আয়তাকার ৩০ মিটার উঁচু প্রবেশদ্বারের মাঝখানে প্রবেশমুখ মিহরাব আকারের। ভেতরে খানিকটা জায়গাজুড়ে বাগান করা আছে, যা পারস্য স্থাপত্যকলার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আমির তিমুরের সমাধিসৌধের দুপাশে দুটি মিনার, মূল ভবনটি চারকোনা আর এর ওপরের গম্বুজটি টারকোয়েজ বা নীলকান্তমণি রঙের। গম্বুজেও টারকোয়েজের ওপর নীল রঙের মোজাইকের সূক্ষ্ম কারুকাজ। গম্বুজের নিচের অংশ মিহরাব আকারের এবং এ অংশে নীল মোজাইকের কারুকাজ আছে। সাধারণ ইটপাথরের ভবনের ওপরের বর্ডারে নীল মোজাইকের নকশা করা? সমরখন্দের যেকোনো ঐতিহাসিক স্থাপনার বিশেষত্ব হলো বিভিন্ন নীল রঙের শেডের মোজাইকের ব্যবহার আর আকর্ষণীয় প্রবেশদ্বার।
গোর-এ-আমিরের ভেতরে বেশ কয়েকটি সমাধি। তবে সমাধির চেয়ে বেশি মনোমুগ্ধকর এর ভেতরের দেয়াল ও ছাদের নকশা। চারদিকের দেয়াল ও ছাদে সাদার ওপর নীল, সোনালি রঙে তুলির আঁচড়ে সূক্ষ্ম কারুকাজে ফুল, লতাপাতা, আরবি-ফারসিতে পবিত্র কোরানের আয়াত ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দেয়ালের চিত্রকর্ম এতই সূক্ষ্ম যে খালি চোখে দেখলে এর সৌন্দর্য ধরা পড়ে না। সমাধিগুলোর একদম মাঝখানের সমাধি আমির তিমুরের। গাঢ় সবুজ রঙের দুর্লভ আস্ত জেড পাথরের তৈরি এ সমাধি। পাথরের ওপর হালকা কারুকাজ। এ সমাধিসৌধে একমাত্র এ সমাধিই জেড পাথরে নির্মিত আর এখন অবধি জেড পাথরটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় জেড পাথর হিসেবে চিহ্নিত। বাকি আটটি সমাধি শ্বেতপাথরে নির্মিত। আমির তিমুরের চারপাশে তার পুত্র শাহরুখ, মিরান শাহ, আব্দুল মির্জা; পৌত্র সুলতান মাহমুদ, আব্দুর রহমান মির্জা ও উলুঘ বেগ; আমির তিমুরের শিক্ষক সৈয়দ বারাকার সমাধি। শ্বেতপাথরের সমাধিগুলোর খোদাই চিত্তাকর্ষক। স্থানীয় দর্শনার্থীরা সমাধির চারদিকে রাখা বেঞ্চে বসে দোয়া খায়ের করে চলে যান।
বিবি খানুম মসজিদ: ভারত আক্রমণের পর ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে আমির তিমুর সমরখন্দে একটি মসজিদ নির্মাণ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। মসজিদের নামকরণ হয় তার প্রিয়তমা স্ত্রীর নামে বিবি খানুম বা স্থানীয় ভাষায় বিবি হানুম মসজিদ। ১৪০৪ খ্রিস্টাব্দে মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হয়। আমির তিমুরের মৃত্যুও ঘটে পরের বছরই। আজ অবধি মসজিদটি সমরখন্দের সবচেয়ে বড় মসজিদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। মসজিদের প্রথম প্রবেশদ্বার উজবেকিস্তানের সবচেয়ে উঁচু দ্বার, উচ্চতা ৪০ মিটার। এ প্রবেশদ্বার এতখানিই বড় যে বহু দূর থেকে নজরে আসে। ইসলামিক এবং পারস্য স্থাপত্যকলায় নির্মিত এ প্রবেশদ্বারে ইট পাথরের গাঁথুনির ওপর নীল, আকাশি, ফিরোজা, পান্না ইত্যাদি রঙের মোজাইকের সঙ্গে বাদামি রঙের মোজাইকের আধিক্য দেখা যায়। জ্যামিতিক নকশা, ফুল, লতাপাতা ও আরবিতে লেখা কোরআনের আয়াতের ওপর মায়োলিক বা মাজোলিক পদ্ধতিতে দেয়ালের উপরিভাগ মসৃণ করা হয়েছে। প্রবেশদ্বার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে বিশালাকৃতির, দুপাশে দুটি মিনার। প্রথম প্রবেশদ্বার পার হলে বিশাল এক বাগান, বাগান পার হলে দ্বিতীয় প্রবেশদ্বার। একসময় এ বাগানের বিশাল আঙিনায় নামাজ পড়া হতো। এখন মসজিদটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। কেউ ইচ্ছে করলে এখানে বসে দোয়া খায়ের করতে পারেন। তবে এখানে এখন জামাতে নামাজ পড়া হয় না।
দ্বিতীয় প্রবেশদ্বারটি আকারে প্রথম প্রবেশদ্বারের চেয়ে সামান্য ছোট। তবে দেয়ালের কারুকাজ অভিন্ন। এ কারুকাজ গোর-এ-আমিরের কারুকাজ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং উজবেকিস্তানের নিজস্ব নকশা এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। উজবেকিস্তানের বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী ব্রোকেড কাপড়ের ওপর বোনা সূক্ষ্ম নকশা প্রবেশদ্বারগুলোর গায়ে খোদাই করে এক অনন্য রূপ দিয়েছে। বিবি খানুম মসজিদে উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব পাশের দ্বারে তিনটি ফিরোজা রঙের গম্বুজ আছে। কয়েক ধরনের নীল রঙের মোজাইকের সমন্বয়ে নকশা আঁকা গম্বুজজুড়ে? মসজিদের এলাকার আয়তন দৈর্ঘ্যে ১৬৭ মিটার ও প্রস্থে ১০৯ মিটার। বিবি খানুম মসজিদ শুধু উজবেকিস্তানই নয়, সারা মুসলিম জাহানে তখন অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। বিবি খানুম মসজিদের উল্টো পাশে রয়েছে বিবি খানুমের সমাধি। ফিরোজা রঙের গম্বুজ ও ইট-পাথরের দেয়াল সমাধিসৌধের। এ সমাধিসৌধে বিবি খানুমের পাশে সমাহিত করা হয়েছে তার পরিবারের কয়েকজন নারী সদস্যকে।
শাহ-এ-জিন্দা: সমরখন্দকে প্রাচ্যের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র বলা হলে শাহ-এ-জিন্দাকে বলা হয় তার রতœভা-ার। শাহ-এ-জিন্দা শব্দের অর্থ হলো জীবন্ত বাদশাহ। শৈল্পিক সৃষ্টির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে শাহ-এ-জিন্দা হলো সমরখন্দের সবচেয়ে নান্দনিক এলাকা। একটি এলাকাজুড়ে বেশকিছু সমাধিসৌধ স্থান করে নিয়েছে এই শাহ-এ-জিন্দায়। প্রবেশদ্বার আকারে ও কারুকাজে গোর-এ-আমিরের মতো। ভেতরে লম্বা একটি পথ এবং পথের দুপাশে সারি সারি নীল রঙের সমাধিসৌধ। মোট সমাধিসৌধের সংখ্যা ২০টির বেশি। বলা হয় সপ্তম শতকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (দ.)-এর একজন আত্মীয় সমরখন্দ আসেন ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে। তার মৃত্যু এ শহরে ঘটে এবং সমাহিত করা হয় শাহ-এ-জিন্দায়। সে সময় থেকে এগারো ও পনেরো শতকে বেশ কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির সমাধি এখানে রয়েছে।
শাহ-এ-জিন্দাকে কেন রতœভা-ার বলা হয়? কারণ প্রতিটি সমাধিসৌধ অনন্যসাধারণ, একটির নকশার সঙ্গে অন্যটির মিল নেই। প্রবেশদ্বার পার হয়ে ভেতরে দাঁড়ালে মনে হবে একটি রাজকীয় গলিতে দুপাশে সারি সারি নীল রঙের রাজপ্রাসাদের সারি। আমির তিমুরের বোন ও ভাতিঝির সমাধিসৌধগুলো এখানে উল্লেখযোগ্য। সমাধিসৌধগুলোর বহিরাঙ্গের কারুকাজ যেমন সূক্ষ্ম আর চমকপ্রদ, তেমনি সৌধের ভেতরের কারুকাজ আরো অভিনব। বাইরে গাঢ় নীল, হালকা নীল, আকাশি নীল রঙের মোজাইকে এবং মায়োলিকার মনোহর আবরণে ফুল, লতাপাতা, কোরআনের আয়াত যেমন চোখের সামনে এক অজানা ভুবনের খোঁজ দেয়, তেমনি এ অপার নীল রঙ সারি সারিভাবে সমুদ্রের ঝাপটা চোখে ও মনে দিয়ে যায়। আমির তিমুরের সমাধিসৌধের অন্দরের কারুকাজের মতোই তুলির সূক্ষ্ম আঁচড়ে আঁকা কাজ এ সমাধিসৌধগুলোর, তবে নকশায় ভিন্নতা আছে। একেক সৌধের অন্দরমহলে প্রবেশ করলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায়, এমন সব অতুলনীয় নকশা করা।
রেগিস্তান স্কয়ার: সমরখন্দের বহুল দর্শনীয় ও আলোচিত স্থান হলো রেগিস্তান বা রেগিস্তান স্কয়ার। রেগিস্তান মানে মরুভূমি। যারা সমরখন্দ বেড়াতে আসেন, তারা নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ মাদ্রাসাগুলো সবার আগে দেখে যান। একই প্রাঙ্গণে তিনটি মাদ্রাসার অবস্থানÍউলুঘ বেগ, শের দোর ও তিলিয়া কোরি। মাদ্রাসা তিনটি মুখোমুখি পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দিকে অবস্থিত। মাদ্রাসা তিনটির মাঝে একটি বিশাল প্রাঙ্গণ, আয়তনে দুটো ফুটবল খেলার মাঠের সমান। উলুঘ বেগ মাদ্রাসার নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৪১৭ খ্রিস্টাব্দে, শেষ হয় ১৪২০ খ্রিস্টাব্দে। আমির তিমুরের নাতি উলুঘ বেগ সমরখন্দের জন্য দিতে চেয়েছিলেন একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়। উলুঘ বেগ ছিল তৎকালীন সময়ের শীর্ষস্থানীয় মাদ্রাসা। অভিজ্ঞ অধ্যাপক নিয়োজিত ছিলেন ছাত্রদের পাঠদানের লক্ষ্যে। আয়তাকার মাদ্রাসা ভবনের দুপাশে দুটি মিনার ও বাইরের দেয়ালে নীল ও বাদামি মোজাইক এবং টাইলসের ওপর কারুকাজ করা। কারুকাজ ছাড়াও নীল টাইলসের ফাঁকে ফাঁকে পাথরে খোদাই করা কারুকাজও শোভা বাড়িয়েছে। মাদ্রাসার অন্দরমহলের মাঝখানে এক টুকরো বাগান।
বাগানের চারদিকে সারি সারি অসংখ্য কক্ষ। দোতলা মাদ্রাসা প্রাঙ্গণের ভেতরে না এলে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে এখানে এতগুলো কক্ষ আছে। প্রতিটি কক্ষের সামনে মিহরাব আকারের দরজা, তাতে মোজাইক ও টাইলসের কারুকাজ। কক্ষের বাইরে বারান্দা, যা বাগান থেকে দেখা যায়। অন্দরমহলেও বাইরের মতোই কারুকাজ। একই রঙ, তবে সমরখন্দের প্রতিটি স্থাপনার নকশা ভিন্ন। তাই একটি স্থাপনা থেকে অন্যটি শুধু নকশা দেখেই আলাদা করা যায়।
১৬১৯ খ্রিস্টাব্দে সমরখন্দের বাদশাহ ইয়ালাংতুশ বাখোদর একটি মাদ্রাসা নির্মাণের আদেশ দেন। মাদ্রাসার নাম শের দোর মাদ্রাসা। শের দোর মাদ্রাসার বহিরাঙ্গের বৈশিষ্ট্য হলো প্রবেশদ্বারের একদম মাথায় দুপাশে দুটি বাঘ এবং বাঘের পিঠে সূর্য ও মানুষের মুখ আঁকা আছে। শাসকের শৌর্য প্রকাশ করার জন্য মাদ্রাসায় এ ছবি আঁকা হয়েছিল। শুধু ধর্মচর্চাই নয়, মাদ্রাসায় বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হতো। শের দোর মাদ্রাসায় উলুঘ বেগ মাদ্রাসার মতো দুপাশে দুটো মিনার ও দুটো গম্বুজ আছে। নীলকান্তমণি বা টারকোয়েজ রঙের এ গম্বুজ দুটির কারুকাজ সমরখন্দের অন্য যেকোনো গম্বুজের চেয়ে আলাদা, সূক্ষ্ম ও দৃষ্টিনন্দন। প্রবেশদ্বারের কারুকাজ অন্য যেকোনো স্থাপনার চেয়ে সূক্ষ্ম ও অনন্য। দোতলা এ মাদ্রাসার ভেতরেও এক টুকরো বাগান এবং চারপাশের দেয়ালজুড়ে শ্রেণীকক্ষ। শের দোর মাদ্রাসার দেয়ালের নকশা অন্য যেকোনো স্থাপনার চেয়ে আরো মনোরম, আরো ঐশ্বর্যম-িত।
শের দোর মাদ্রাসা নির্মাণের ১০ বছর পর নির্মিত হয় সমরখন্দের একমাত্র আবাসিক মাদ্রাসা তিলিয়া কোরি। বহিরাঙ্গের নকশা নীল, বাদামি রঙের মোজাইক ও টাইলসের ওপর কারুকাজে সমৃদ্ধ। ভেতরে অন্য মাদ্রাসার মতো এক টুকরো বাগান। চারদিকে ছাত্রাবাস আর শ্রেণীকক্ষ। অন্দরমহলের দেয়াল, বারান্দা, বারান্দার মিহরাব আকারের দরজায় অতুলনীয় কারুকাজ এবং এ কারুকাজগুলোও অন্য স্থাপনা থেকে ভিন্ন। অন্দরমহলের পূর্ব পাশে একটি মসজিদ। মসজিদের ফিরোজা রঙের গম্বুজ বাইরে থেকেও দেখা যায়। মসজিদের ভেতরের সালংকারা দেয়াল আর ছাদে সাদার ওপর সোনালি, নীল সূক্ষ্ম কারুকাজের নকশা আঁকা। এত মিহি কারুকাজ যে মনে হয় মসজিদের সর্বত্র স্বর্ণ দিয়ে আচ্ছাদিত। যে কেউ এ মসজিদে নামাজ পড়তে পারেন, তবে জামাত হয় না এ মসজিদে। সমরখন্দ ছিল মধ্য এশিয়ার বাণিজ্য, শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র। সে প্রাণকেন্দ্রের প্রাণ এখনো ধরে আছে এ নগরীর বিভিন্ন স্থাপনা। সমরখন্দের তাই এখনো শিল্পের সমঝদার মানুষের আরাধ্য নগরী। লেখক: ফাতিমা জাহান: পুরাকীর্তি ও প্রাচীন সভ্যতা অনুসন্ধানী লেখক