ধুলার অত্যাচার। বাতাসে দুর্ভোগের বিস্তার। দূষণের তীব্রতায় নাকাল ঢাকার পরিবেশ। চারদিকে ধুলা আর ধুলা। কোথাও বের হলেন। ঘরে ফিরে মুখ ধোবেন। মুখ থেকে ঝরে পড়া পানি দেখবেন অনেকটা কালো। পোশাকে ধুলা, শরীরে ধুলা। ঘরের ভেতরেও আসবাবপত্রে ধুলার স্বেচ্ছাচার। ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতিতেও ধুলা, সেগুলো নষ্ট হচ্ছে দ্রুত। নানা রকম খাবারের সাথে থাকছে ধুলা। শ্বাস গ্রহণে ধুলা। সে নিয়ে আসছে বহু রোগ, বহু জটিলতা।
জীবন ও শক্তির কোলাহলে স্পন্দিত শহরের ভেতরে-বাইরে নানা হুমকি। তার মুখের বাহ্যিক ছবির আড়ালে লুকিয়ে থাকা জখম ও প্রাণঘাতী অসুখ কম নয়। ঢাকা মহানগরী অনেক পীড়ায় ভুগছে। কিন্তু ধুলা পরিণত হয়েছে তার শ্বাসকষ্টে। দ্রুত নগরায়ণ, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ এবং ভারী যানবাহন একটি ভয়ঙ্কর ধুলাদূষণের আবর্তন তৈরি করেছে। যা কেবল শহরের সৌন্দর্যকে লাঞ্ছিত করে না; বরং এর বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তা, জীবনের প্রতিশ্রুতি ও স্বাভাবিক মঙ্গলের বিরুদ্ধে অব্যাহত হুমকি হয়ে উঠেছে। ধুলার ঘোমটায় ঢাকা পড়া এই শহর ভেতরে বিশৃঙ্খল। সে প্রায়ই আচ্ছন্ন থাকে এক পরাবাস্তব কুয়াশায়। এটি কোনো প্রাকৃতিক কুয়াশা নয়; এ হচ্ছে ভেতরের বিশৃঙ্খলা থেকে জন্ম নেয়া বিশাল ধূলি-মেঘের অভিশাপ, যা ঢাকাকে ঢেকে রেখেছে।
দায়িত্বহীন হাত দিয়ে মাটি খোঁড়া হয় এখানে, পাথর চূর্ণ করা হয় এবং সিমেন্ট মিশিয়ে বাতাসে সূক্ষ্ম ধুলার মেঘ পাঠানো হয়। এসব করা হয় সড়ক উন্নয়ন, স্থাপনা তৈরি, হাইরাইজ বিল্ডিং বানানো ইত্যাদির লাগামহীন অব্যস্থাপনার মধ্য দিয়ে। দিনে আপনি ছিলেন যানজটে নাকাল। সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে আপনার আরেকটি লড়াই বাকি। নিজেদের শ্বাস-প্রশ্বাসের ধুলা-বোঝাই বাতাসের সাথে ঢাকার বাসিন্দাদের যুদ্ধ করতে হবে। এখানে তারা জিতছেন কম। ফলে হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস ও অন্যান্য ফুসফুসের ব্যাধিগুলোর সাথে শ্বাসকষ্টের অসুখগুলো ক্রমবর্ধমান হয়ে উঠেছে। এ যুদ্ধের সবচেয়ে অসহায় শিকার বয়স্ক এবং শিশুরা। তাদের দুর্বল প্রতিরোধব্যবস্থা এবং শ্বাসযন্ত্রের সিস্টেমগুলো অদৃশ্য হুমকিতে জেরবার। ধুলাদূষণের আক্রমণ মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতিই চোখ রাঙাচ্ছে না; বরং এর ফলে ঢাকার পরিবেশের গোটা ফুসফুস এখন অবরুদ্ধ। সূক্ষ্ম ধূলিকণা গাছের পাতার উপর বসতি স্থাপন করছে। সালোকসংশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত করছে এবং শহরের সবুজ আত্মাকে পদাঘাত করছে। জলাশয়গুলো এই সঙ্কটের ধাক্কা বহন করতে পারছে না। কেননা, ধুলা-বোঝাই বৃষ্টির পানি নদী ও হ্রদে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সম্ভাব্য জলজ বাস্তুতন্ত্র ও জলের গুণমান ক্ষুণœ করছে। এই সঙ্কট মোকাবেলার জন্য আমরা কিছুই করিনি, তা নয়। অপর্যাপ্ত প্রবিধান আছে আমাদের। যদিও তার প্রয়োগ পর্যাপ্ত। কিছু নির্দেশিকা আছে বটে, সেগুলো উপেক্ষা করা হয় প্রতিনিয়ত। নির্মাণ প্রকল্পগুলো যথাযথ ধূলিকণা প্রশমনের ব্যবস্থা ছাড়াই এগিয়ে চলে। যানবাহনগুলো দক্ষ নির্গমন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছাড়াই রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ায়। ঢাকার ধুলাসমস্যা নিয়ে কান্নাকাটি কম হয়নি। আমাদের দরকার স্পষ্ট করণীয় নির্ধারণ, করণীয় বয়ান। এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের কর্মসূচির প্রস্তাব করব : ১. অস্থায়ী ব্যবস্থা ও ২. স্থায়ী ব্যবস্থা।
অস্থায়ী ব্যবস্থা:১. ধুলা নিয়ন্ত্রণ স্প্রে : নির্মাণক্ষেত্রে বালু, ইট, পাথর, অন্যান্য নির্মাণ উপকরণসহ খনন করা মাটি যত্রতত্র রাখা হচ্ছে। ফলে ধুলাবালু বাতাসে উড়ছে। সেখানে ধুলানিয়ন্ত্রণ স্প্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। কাঁচারাস্তা এবং উচ্চ ধূলিকণাকবলিত এলাকায়ও তা প্রয়োগ করা উচিত। স্প্রেগুলো ধূলিকণাকে দমন করে এবং বাতাসে তাদের বিচ্ছুরণ রোধ করে। এটি অবশ্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয় এবং অন্যান্য ব্যবস্থার সাথে তা পরিপূরক হিসেবে ভূমিকা রাখবে।
২. ট্র্যাফিক ম্যানেজমেন্ট : পিক আওয়ারে ভারী যানবাহন সীমাবদ্ধ করুন। যানবাহনের জন্য কঠোর নির্গমন মান প্রয়োগ করুন। এটি যানবাহন চলাচলের ফলে ছড়ানো ধুলার মাত্রা কমাতে সাহায্য করতে পারে। বিজোড়-বিজোড় যানবাহন স্কিম বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ক্লিনার ফুয়েলের ব্যবহার উৎসাহিত করা উচিত। ৩. রাস্তা কার্পেটিং ও পানি দেয়া : নিয়মিত কাঁচারাস্তা ভিজানো, পাকা রাস্তায় পানি দেয়া জরুরি। ধুলা দমন করার জন্য পানির ট্রাক ব্যবহার করা যেতে পারে। রাস্তায় কার্পেটিং প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া দরকার। যে সব রাস্তায় কার্পেটিং উঠে গেছে, নুড়িপাথর সরে গেছে, খানাখন্দ এখানে-ওখানে, সেসব রাস্তা ধুলাবালুর উৎসস্থল। এসবের যথাযথ সংস্কার জরুরি। রাস্তা পাকাকরণ ও টেকসই কার্পেটিং এবং রাস্তায় পানিদান ধূলিকণার বিস্তার কমাতে পারে।
৪. সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান : ধূলিকণার সাথে যুক্ত স্বাস্থ্যঝুঁঁকি সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালান। নিজেদের রক্ষার জন্য মানুষ কী করতে পারে, তা স্পষ্ট করুন। স্বল্পমেয়াদি আচরণগত পরিবর্তনের দিকে উদ্বুদ্ধ করুন। যার মধ্যে মাস্ক ব্যবহার করা, ধূলিবিস্তারের সময় বাইরের কার্যকলাপ এড়ানো এবং জানালা বন্ধ রাখা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। ৫. অস্থায়ী সবুজ বাধা : যেসব এলাকা বেশি ধুলাপ্রবণ, সেখানে দ্রুত বর্ধনশীল গাছপালা লাগান। এটি অস্থায়ী সবুজ বাধা হিসেবে কাজ করবে। বৃক্ষ-তরুলতা ধূলিকণা আটকাতে পারে এবং আশপাশে বাতাসের গুণমান উন্নত করতে পারে।৬. রাস্তার পাশে ঘাস-গাছ : সড়ক-মহাসড়কে কার্পেটিং করা অংশের বাইরে ঘাসহীন যে অংশ আছে, যানবাহন চলাচলজনিত সৃষ্ট বাতাসে সেখান থেকে চারধারে প্রচুর ধুলা ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তার পাশে গাছ লাগান, ঘাস লাগান।
স্থায়ী ব্যবস্থা: ১. নগর পরিকল্পনা ও নকশা : সবুজ স্থান, বাফার জোন ও দক্ষ ভূমি ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য নগর পরিকল্পনা কৌশলগুলো সংশোধন করা উচিত। সঠিক জোনিং ও নকশার মাধ্যমে আবাসিক এলাকাগুলোকে শিল্পাঞ্চল থেকে আলাদা করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে বাসিন্দাদের ওপর দূষণের প্রভাব কমানো সম্ভব।
২. অবকাঠামো উন্নয়ন : ভালো পাকা রাস্তা, দক্ষ নিষ্কাশনব্যবস্থা, উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং এ সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোতে বিনিয়োগ দরকার। এখানে কাজ করলে ধুলার আধিপত্য উল্লেখযোগ্য হারে কমবে। তবে সঠিকভাবে ডিজাইন করতে হবে এবং অবকাঠামোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। যা রাস্তার উপরিভাগ থেকে ধুলার স্বৈরাচার দূর করতে পারে।
৩. নির্মাণ প্রবিধান : বাধ্যতামূলক ধূলিকণা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করুন। নির্মাণকার্যক্রমের জন্য কঠোর প্রবিধান বাস্তবায়ন এবং তার প্রয়োগ জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, পৃষ্ঠ ভেজানো এবং ধুলা সংগ্রাহক যন্ত্রের ব্যবহার।
৪. সবুজ উদ্যোগ : শহরজুড়ে বন বিস্তারের বিকল্প নেই! বৃক্ষ বৃদ্ধিতে সরকার কাজ করবে। জনগণকেও উদ্বুদ্ধ করবে। অধিকমাত্রায় সবুজের উপস্থিতি জীবনের জন্য সুযোগ বৃদ্ধি করে। বৃক্ষ, তরুলতা প্রাকৃতিক ধুলার ফিল্টার হিসেবে কাজ করে এবং সামগ্রিক বায়ুর গুণমান উন্নত করে। ঢাকাকে সবুজের প্রাধান্যে ঢাকতে পারলেই ধুলাসমস্যার মোকাবেলায় এগিয়ে গেলেন।
৫. টেকসই পরিবহন : পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেমে বিনিয়োগ, সাইক্লিং লেনের প্রচার এবং বৈদ্যুতিক যানবাহনকে উৎসাহিত করা জরুরি। এর মাধ্যমে যানবাহনের নির্গমন কমতে পারে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে শহরে ধূলিকণার মাত্রা হ্রাস হতে পারে। ৬. এয়ার কোয়ালিটি মনিটরিং : ধুলার মাত্রা ট্র্যাক করা ও ধুলার উৎসগুলো বোঝার জন্য শহরজুড়ে ব্যাপক বায়ুমান পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক স্থাপন করা উচিত। রিয়েল-টাইম ডাটার সহায়তা নেয়া দরকার। যা নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো জানাতে পারে। সমস্যা সমাধানে কার্যকর হস্তক্ষেপে সেটি কাজে লাগবে।
৭. গবেষণা ও উদ্ভাবন : ধুলা কমানোর জন্য নতুন প্রযুক্তি এবং কৌশল বিকাশের ওপর মনোযোগ বাড়ান। গবেষণা উদ্যোগগুলোকে সহায়তা দিন। টেকসই সমাধানের চিন্তাগুলোকে প্রণোদিত করুন। যা উন্নত ধুলা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, উপকরণ ও নগর পরিকল্পনার কৌশল অধ্যয়নকে অগ্রসর করবে।
ঢাকা মহানগরী ধূলিকণা সমস্যা মোকাবেলায় ব্যর্থ হতে পারে না। ব্যর্থ না হওয়ার জন্য প্রয়োজন বহুমুখী পদ্ধতি। দীর্ঘমেয়াদি টেকসই ও স্থায়ী পদক্ষেপের সাথে অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য অস্থায়ী ব্যবস্থাকেও সমন্বিত করতে হবে। আপাতত ধুলা নিয়ন্ত্রণ ¯েপ্র, পানি দেয়া, নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা ও সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান দ্রুত সমাধানের দিকে এগিয়ে নেবে। নগর পরিকল্পনা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও টেকসই অনুশীলনের যথার্থতা ধুলার অত্যাচারের বিপরীতে বাসযোগ্য, স্বাস্থ্যকর ঢাকা অর্জনের চাবিকাঠি। কঠোর বিধি-বিধান ও তার প্রয়োগ এবং সব স্টেকহোল্ডারের মধ্যে দায়িত্ববোধ জাগানো একান্ত জরুরি। এই ব্যবস্থাগুলোর বাস্তবায়ন কেবল সরকারের কাজ নয়। সরকারি সংস্থা, বেসরকারি খাত, পরিবেশ সংস্থা ও জনগণের সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। এর পেছনে অবশ্য ইতিবাচক সক্রিয়তা দেখাতে হবে সরকারকেই। লেখক : কবি, গবেষক ৭১.alhafij@gmail.com