শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৬:১৪ পূর্বাহ্ন

সুখ-শান্তি কল্যাণ স্থাপন ও সংরক্ষণ

মাওলানা এম এ হালিম গজনবী এফসিএ
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৩

সুখ-শান্তি কে না চায়? প্রত্যেকেই চায়, কিন্তু পায় না কেন? সুখ-শান্তি দ্রুতগতিতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কেন? উন্নয়নের কাজ চলছে বিশ^ময়, উন্নয়নও হচ্ছে, প্রযুক্তি বাড়ছে। সাথে সাথে বাড়ছে অশান্তি-অসুখ, কিন্তু কেন? আমি মনে করি, আলোচ্য প্রশ্নগুলোর উত্তর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর আদেশ-নিষেধাজ্ঞা পালন দ্রুতগতিতে কমে যাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে বা অভাব হচ্ছে সৎ মানুষের ও সৎকর্মের। সত্যিকার অর্থে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর আদেশ ও নিষেধাজ্ঞাসমূহ পালনে নিঃসন্দেহে মানুষ রূপান্তরিত হতে থাকবে সৎ বা ভালো মানুষে এবং দূর হতে থাকবে অশান্তির দৃশ্য ও অদৃশ্য উপকরণগুলো। তাই ধর্মীয় বিধান পালন করা অপরিহার্য আমাদের উভয় জগতের সুখ-শান্তি ও কল্যাণের স্বার্থে।
আমাদের সর্বপ্রথম প্রয়োজন ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন এবং সেই জ্ঞান বিস্তার বা প্রসার, তৎপর ধর্মীয় বাণী প্রচার যথাসাধ্য সচেষ্ট হয়ে। ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকবে আল্লাহভীরুতা, ঈমানের শক্তি, সৎকাজ পালন, নিষিদ্ধ কাজ বর্জন। ফলে বৃদ্ধি পেতে থাকবে আমাদের জীবনের সুখ, শান্তি, স্বস্তি এবং কমতে থাকবে অশান্তি, অসুখ ও অস্বস্তি। এ কথার চূড়ান্ত প্রমাণ- ৬১০ সালে আরববাসীর জীবনপ্রবাহ, যারা জীবন্ত কবর দিত কন্যা সন্তানদেরকে। নারী-পুরুষ উলঙ্গ হয়ে কাবাঘর প্রদক্ষিণ করত। মূর্তি দিয়ে কাবাঘর সাজিয়েছিল, অরাজকতা বিরাজমান ছিল তুলনাহীন। ফলে ওই সময়টি চিহ্নিত হয়েছিল অন্ধকার যুগ বা আইয়ামে জাহেলিয়াত হিসেবে। এ অন্ধকার ও অশান্তি ভরা যুগ রূপান্তরিত হতে থাকল আলোকিত ও শান্তি ভরা যুগ হিসেবে। প্রায় ১৪০০ বছরাধিক ব্যবধানে মনে হচ্ছে আমরা দিনে দিনে সেই অন্ধকার যুগের দিকে ফিরে যাচ্ছি। রাসূল সা:-এর ভবিষ্যদ্বাণীগুলো বাস্তবায়িত হতে শুরু করেছে। উদাহরণস্বরূপ, রাসূল সা:-এর বাণী- ‘হত্যাকারী বুঝতে পারবে না যে, সে কী কারণে অন্যকে হত্যা করল; তেমনি করে নিহত ব্যক্তিও বুঝতে পারবে না যে, সে কেন নিহত হলো!’ বিশে^ এ সত্য এখন বিরাজমান যা আমাদের সবার জানা।
সুখে থাকি আর দুঃখে থাকি, শান্তিতে থাকি আর অশান্তিতে থাকি দিন কেটে যাচ্ছে। কিন্তু এর পরিণতি ইহজগতে অবাঞ্ছিত এবং পরজগতে ভয়াবহ যখন হবে জাহান্নাম বাস আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার কারণে। আল্লাহ যেমনি সীমাহীন রহমান বা দয়ালু তেমনি হবেন কঠোরমনা, কঠোর শাস্তিদাতা। প্রবাদ আছে- ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’। অনুরূপ আরো একটি প্রবাদ হলো- ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। সৎকর্ম, সৎচিন্তার ফল বিশাল তেমনি অসৎ চিন্তা, অসৎ কর্মের কুফল বা শাস্তি ভয়াবহ। ধর্মীয় অনেক নিষিদ্ধ কাজ প্রবাদ বাক্য দিয়ে আমাদের হুঁশিয়ারি করেছেন। যথা- ‘হারামে আরাম নাই’। অর্থাৎ অবৈধ অর্জন তা হোক সম্পদ, নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব, রাজত্বসহ যাই হোক না কেন তাতে শান্তি নেই, থাকবে অশান্তি, অস্বস্তি, অস্বাচ্ছন্দ্য, বিবেকের দংশন, সমালোচনা, ধিক্কার এমনকি লেখা হবে নাম অত্যাচারীর খাতায় এবং অবৈধ আয়ের সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা হবেন অত্যাচারিত। যথা ঘুষ দিতে বাধ্য করা, জমি-জমা দখল করা, চুরি-ডাকাতি করা ইত্যাদি। তেমনিভাবে প্রবাদ বাক্য ‘অহঙ্কার পতনের মূল’ ইংরেজিতে বলে ‘সিন লিডস অ্যা ম্যান টু ডেথ’ অর্থাৎ, ‘পাপ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে হুঁশিয়ারি বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন ‘আল্লাহ অহঙ্কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আন-নাহাল-২৩) আল্লাহ যাকে পছন্দ করেন না, সে নিশ্চয়ই হতভাগা এবং অসহায়। তা ছাড়া আল্লাহ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন অহঙ্কারের ব্যাপারে, আল্লাহর বাণী- ‘(হে গোলামগণ!) জমিনে দম্ভ ভরে (গর্বভরে) চলাফেরা করো না, তুমি কখনো জমিনকে বিদীর্ণ করতে পারবে না বা ফাটল ধরাতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনোই পর্বত সমান হতে পারবে না।’ (সূরা বনি-ইসরাইল-৩৭)
দুনিয়াতে যেমন অপরাধের শাস্তি হয়, যথা মৃত্যুদ-, জেল, জরিমানা ইত্যাদি। তেমনি পরকালে অপরাধের শাস্তি হবে জাহান্নাম বাস, যদি আল্লাহ ক্ষমা না করেন। যা হতে পারে চিরস্থায়ী বা যথাযথ নির্ধারিত সময়ের জন্য অপরিমার্জিত পাপের পরিমাণগত তারতম্যের কারণে। তবে আল্লাহকে অস্বীকার করা, তার সাথে কাউকে শরিক করা অর্থাৎ কাফের-মুশরিক নামক অপরাধীদের শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নাম বাস। তবে আল্লাহর ঘোষণা মতে, অধিকাংশ বিশ^বাসীর স্থান হবে জাহান্নামে। মুমিনদের সৎ কাজের পাল্লা ভারী হলে জান্নাত অন্যথায় হালকা হলে জাহান্নামবাস হাবিয়াহ নামক স্থানে। প্রমাণ মহান আল্লাহর বাণী- “যার পাল্লা (নেকের পাল্লা) হালকা হবে, তার ঠিকানা হবে ‘হাবিয়াহ্’ নামক জাহান্নামে।” (সূরা আল-ক্বারিআহ : ৮-৯)
পরোপকারে বা গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করার জন্য আল্লাহ আমাদের আদেশ করেছেন দান-সাদকাহ করতে। প্রমাণ আল্লাহর বাণী-(হে গোলামগণ!) আমি তোমাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করো (আল্লাহর রাস্তায়)। কেননা, তখন (মৃত্যুর সময়) সে বলবে, হে আমার রব, ‘যদি আপনি আমাকে আরো কিছুকাল পর্যন্ত অবকাশ দিতেন (অর্থাৎ আমাকে আরো কিছু দিন হায়াত দিতেন) তাহলে আমি দান-সাদাকাহ করতাম। আর সৎ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হতাম (কিন্তু মৃত্যু আসার পর আল্লাহ তা বিলম্ব করবেন না)।’ (সূরা আল-মুনাফিকুন-১০)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়, পার্থিব জীবনে ও পারলৌকিক জীবনে যথাক্রমে শান্তি এবং চিরশান্তি পেতে হলে মহান আল্লাহ ও তার রাসূল সা:-এর আদেশ ও নিষেধাজ্ঞাগুলো পালন করে সৎকর্মশীল মুমিন অবশ্যই হতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।
জাকাত, দান-সাদাকা, পরোপকার ইত্যাদি শান্তিময় পরিবেশবান্ধব। তাই আল্লাহ আলোচ্য বিষয়াদি অনুশীলন করার জন্য বিশেষভাবে কুরআনে আদেশ করেছেন যথা- ‘তোমরা সালাত আদায় করো, জাকাত প্রদান করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পারো।’ (সূরা আন-নূর-৫৬)

প্রবাদ আছে- ‘নিজে ভালো তো জগৎ ভালো’ অর্থাৎ, আমি যদি ভালো হই তাহলে গোটা পৃথিবী ভালো। এর অর্থ : বিশ^বাসী ভালো হয়ে গেলে বিশ^ ভালো হয়ে যাবে অর্থাৎ শান্তি ও সুখময় হয়ে যাবে। উদাহরণ- যে পরিবারের সদস্যরা সত্যিকার অর্থে আদর্শবান সে পরিবার শান্তিময়। তেমনি করে বিশ^ সদস্য ভালো হয়ে গেলে বিশ^ নামক পরিবারটি শান্তিময় হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার, শিক্ষা, নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন ইত্যাদির অবদান সর্বজনবিদিত। ধর্মীয় দিক থেকে সত্যিকার সৎ মানুষ অশান্ত পরিবেশেও মোটামুটি প্রশান্ত মন নিয়ে দিনাতিপাত করতে পারে, ধর্মীয় জ্ঞানের আলো সংগ্রহ ও তা বাস্তবায়ন করে আল্লাহর রহমত ও বরকত প্রাপ্তির মাধ্যমে। আল্লাহর বাণী-‘আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে তার রহমত দিয়ে বিশেষভাবে ভূষিত করেন এবং আল্লাহ মহান অনুগ্রহের অধিকারী।’ (সূরা আল-বাকারা-১০৫) ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ প্রবাদটি মনে পড়ে গেল। আল্লাহ কাউকে শান্তিতে রাখলে কেউ তার অশান্তির কারণ হতে পারে না। যেকোনো অশান্ত বা অরাজকতাময় পরিবেশে আল্লাহর ওপর সত্যিকার অর্থে নির্ভরশীলতা ব্যক্তি বিশেষদের শান্তির অবলম্বন হয়ে যায়।
মানবজাতিকে সৃষ্টিতে আল্লাহর উদ্দেশ্য সামগ্রিক মানবকল্যাণ সাধন করে শান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি করা। প্রমাণ আল্লাহর বাণী-‘তোমরাই সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির (সর্বাত্মক কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভূত করা হয়েছে, তোমরা সৎ কাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করো ও আল্লাহর প্রতি ঈমান রক্ষা করে চলো।’ (সূরা আলে ইমরান-১১০)
আলোচ্য শান্তি ও চিরস্থায়ী শান্তি ভোগ করতে হলে আমাদেরকে চারটি মৌলিক গুণে গুণান্বিত হতে হবে- ১. ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন (ইলম); ২. আল্লাহকে ভয় করা (তাকওয়া); ৩. আল্লাহ এবং নবী-রাসূলদেরকে অপর পাঁচটি বিষয়সহ দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করা (ঈমান)। (আলোচ্য পাঁচটি বিষয় যথা- ক. ফেরেশতারা; খ. আসমানি কিতাবসমূহ; গ. পরকাল; ঘ. তাকদির ও ঙ. মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন)। ৪. আল্লাহ ও তার রাসূল সা:-এর আদেশ ও নিষেধাজ্ঞাসমূহ যথাসাধ্য যথাযথভাবে পালন করা (ইসলাম)। প্রসঙ্গক্রমে কিছু বাস্তবধর্মী বা জনশ্রুতি কথা বলছি : একজন জ্ঞানী লোকের উক্তি ‘সুখ সুখ করে কেঁদো না আর, যতই কাঁদিবে ততই বাড়িবে হৃদয় ভার। পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি এ জীবন মন সকলই দাও তার মতো সুখ কোথাও কি আছে আপনার কথা ভুলিয়া যাও।’ ত্যাগের শিক্ষা গ্রহণ প্রাকৃতিক বস্তুর ত্যাগ থেকে যথা- আগুন, পানি, গাছ, মাটি, সাগর, মহাসাগর, বায়ু, আলো, অন্ধকার ইত্যাদি ত্যাগ আমাদের উপকার ও কল্যাণের স্বার্থে। সত্যিকার অর্থে প্রকৃত শান্তি ভোগে নয়; বরং ত্যাগে। প্রসঙ্গত রাসূল সা:-এর বাণী অর্থ- ‘আল্লাহ সে বান্দার সাহায্যে আছেন, যে বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে আছে।’ অহঙ্কার অহঙ্কারীদের ক্ষতির কারণ যা তারা টের পায় না। অহঙ্কার পতনের মূল। উদাহরণ- ইবলিশ ফেরেশতা শয়তানে পরিণত হলো অহঙ্কারের কারণে আল্লাহর আদেশ অমান্য করে অর্থাৎ আদম আ:-কে সিজদা না করে। আসুন আমরা আল্লাহর আদেশ ও নিষেধাজ্ঞাগুলো যথাযথভাবে পালন করে শান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি করে প্রমাণ করি, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ এবং রাসূল সা:-কে প্রেরণ করা হয়েছে বিশ্ব শান্তির দূত হিসেবে। প্রমণ আল্লাহর বাণী-‘হে রাসূল! আমি (আল্লাহ) আপনাকে বিশ্বাবাসীর জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আম্বিয়া-১০৭)। লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশ




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com