এত বড় একটা কাজের দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়তে পারে, দু’দিন আগেও ভাবতে পারেননি। দিল্লিতে বাড়ি। মাটির নিচে বিশেষ ধরনের গর্ত খোঁড়ার কাজ করেন। দলের সাথে কাজের সূত্রেই চলে যেতে হয় এদিক সেদিক। রোববারও যখন ফোনটা এসেছিল তখন তিনি গাজিয়াবাদে। কিন্তু কাজের কথা শোনার পর আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেননি ৩৪ বছরের ফিরোজ কুরেশি। ‘যে অবস্থায় ছিলাম সেই অবস্থাতেই বেরিয়ে পড়েছিলাম’— আনন্দবাজার অনলাইনকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানালেন ফিরোজ। তখনো তিনি জানেন না, গত ১৭ দিন ধরে উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে আটকে থাকা মানুষগুলো প্রথম যে মুখটি দেখবেন, সেটি তারই।
গত মঙ্গলবার রাতে উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গ থেকে বের করে আনা হয় গত ১৭ দিন ধরে ধসে আটকে পড়া ৪১ জন শ্রমিককে। ধ্বংসস্তূপের বাধা সরাতে ইঁদুরের গর্ত খোঁড়ার পদ্ধতি অবলম্বন করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। আর ওই দায়িত্ব দেয়া হয় এই কাজে অভিজ্ঞ ১২ জনের একটি দলকে। র্যাট হোল মাইনিংয়ের মাধ্যমে সুড়ঙ্গের ভিতরে প্রবেশ করেন তারা। আর যে মানুষটি প্রথম ভিতরে প্রবেশ করেন তিনি হলেন ফিরোজ। আটকে থাকা শ্রমিকদের সাথে প্রথম তারই দেখা হয় সুড়ঙ্গের ভিতরে। ঠিক কেমন ছিল সেই মুহূর্তের অভিজ্ঞতা? ফিরোজকে প্রশ্ন করেছিল। দিল্লির যুবকের স্বর কয়েক ঘণ্টা আগের স্মৃতিতে গমগম করছিল। বললেন, ‘যব অন্দর গয়ে মুঝে দেখকর তো খুশ হো গয়ে উওলোগ! নারে লাগা রহে থে সব। ফির গলে লাগা লিয়া।’ অর্থাৎ ফিরোজকে দেখে খুশিতে ঝলমল করে উঠেছিলেন ১৭ দিন ধরে বদ্ধ সুড়ঙ্গে বন্দি মানুষগুলো। জয়ধ্বনি দিতে শুরু করেছিলেন তারা। তার পর এসে জড়িয়ে ধরেছিলেন ফিরোজকে।
কেমন ছিল সেই মুহূর্তের অনুভূতি? ফিরোজ বললেন, ‘ওই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, তাদের থেকেও আমার আনন্দ হচ্ছে বেশি। তবে তাদের দেখে মনে হচ্ছিল, তাদের দ্বিতীয় জন্ম হয়েছে। নতুন করে প্রাণ পেয়েছেন তারা। আমাকে আমাকে ওরা জড়িয়ে ধরে বলছিলেন, ‘আপনাকে কী বলব আমরা? আপনাকে কি আমাদের ভগবান মানব? কী প্রতিদান দেব আপনাকে?’ শুনে তিনি কী বললেন? ফিরোজের স্বর সামান্য কাঁপল আবেগে। বললেন, ‘আমি তাদের বললাম, কিচ্ছু চাই না। শুধু আপনারা নিরাপদে বাইরে বেরিয়ে আসুন।’
আসলে সোমবার থেকে খোঁড়ার কাজ শুরু করার পর থেকে একটাই লক্ষ্য ছিল ফিরোজদের, কী ভাবে ওই আটকে পড়া মানুষগুলোকে বাইরে নিরাপদে বের করে আনা যায়। আর কিচ্ছু ভাবেননি ওই ১২ জন। নাওয়াখাওয়া ভুলেছিলেন। ফিরোজ জানিয়েছেন, মঙ্গলবার তিনি নিজে সকাল ১১টায় ঢুকেছিলেন সুড়ঙ্গের ভিতরে। বার হন সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ। এই সাত ঘণ্টা তিনি মুখে দানা কাটেননি। ‘ইচ্ছেই করেনি। ঠিক করে নিয়েছিলাম, ওঁদের বার করে আনার পরই খাব।’
বাড়িতে কিছু না জানিয়েই চলে এসেছিলেন সিল্কিয়ারায়। বাড়িতে স্ত্রী রয়েছেন। রয়েছে ১৩ বছরের সন্তানও। তারা বাধা দেননি। এ কাজে তো ঝুঁকিও আছে। ফিরোজ কিছুটা গর্বের সাথেই বললেন, ‘না, ওরা জানত না। তবে যখন জানল, তখন আমাকে স্ত্রী বলেছিল, সাবধানে কাজ কোরো, তাদের সবাইকে বাঁচিয়ে ফিরো। এমনকি, আমার ছেলেও বলেছিল, বাবা তুমি তাদের তাড়াতাড়ি উদ্ধার করে তার পর বাড়ি চলে এসো।’ তবে বাড়ি ফেরা এখনও হয়নি ফিরোজের। বুধবারও তিনি উত্তরকাশীতেই। ফিরবেন কী করে! এলাকার লোকজন তাদের নিয়ে মেতে আছেন। তাদের অভিজ্ঞতা শোনার জন্য ঘিরে ধরছেন প্রতি মুহূর্তে। আরো একটা কারণে এখনো ফিরতে পারেননি। যদি কোনো কাজ বাকি থাকে। যদি কোনো কাজে তাদের প্রয়োজন পড়ে। কারণ তার কানে এখনো বাজছে সেই প্রথম মুহূর্তের চারটি শব্দ। তাঁকে দেখে যে জয়ধ্বনি দিয়েছিলেন বন্দি মানুষগুলো। দেশের জন্য বড় কিছু করার আনন্দ এখনো ভুলতে পারছেন না ফিরোজেরা। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা