সেকালের কলকাতায় ডাকসাইটে বণিক গোবিন্দরাম গাড়ি হাঁকিয়ে যতটা না আলোচনায় এসেছেন কেবল দাড়ি উঁচিয়ে উমিচাঁদ বণিকদের সবাইকে ডিঙিয়ে গেছেন, রমরমা আলোচনায় এসেছেন, ক্ষমতার জন্য ষড়যন্ত্রের রাজনীতির শীর্ষে থেকেছেন।
অমৃতসর থেকে কলকাতায় এসে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উমিচাঁদ কিংবা আমিনচাঁদ সেকালের পয়ার ছন্দের কবিতায় ঠাঁই পেয়েছেন। কবি জয়ন্তীচন্দ্র সেন দাস লিখেছেন
শ্রী শেখ আমিন চাঁদ কতকাল পরে।
পৌঁছে কলকাতা বাস করিবার তরে।।
ধনাঢ্য প্রকা- দাড়ি জানিত সকলে।
বন্ধুত্ব সেনের সহ হইল কৌশলে।।
দুই কর্মে অদ্যতক দু’জন বিখ্যাত।
মনে কর যেবা শুনিয়াছ অবিরত।।
বিখ্যাত সকলে আমিন চাঁদের দাড়ি।
জানিত বৃহৎ ছিল নন্দরামের বাড়ী।।
(জন কোম্পানির বাঙালি কর্মচারী থেকে উদ্ধৃত)
বাণিজ্যে নয় ষড়যন্ত্রে উমিচাঁদের নাম অধিক প্রচারিত হয়। পুরনো দিনের কলকাতায় লোকমুখে প্রচলিত ছড়াতেও ছিলেন উমিচাঁদ:
১. বনমালী সরকারের বাড়ি,
গোবিন্দরামের ছড়ি।
উমিচাঁদের দাড়ি,
হুজরীমলের কড়ি।
২. নন্দরামের ছড়ি
উমিচাঁদের দাড়ি
হুজরীমলের কড়ি
গোবিন্দরামের গাড়ি।
৩. আমিরচাঁদের দাড়ি
বনমালী সরকারের বাড়ি
হুজরীমলের কড়ি
গোবিন্দরাম মিত্রের ছড়ি।
তীর্থংকর রায় তার ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন: ইউরোপীয় ও ভারতীয়দের মধ্যে পার্টনারশিপ ছিল কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু এ পার্টনারশিপ এমনই যার পেছনে কোনো আইনি চুক্তিও নেই, সামাজিক বন্ধনও নেই, নিছক স্বার্থসিদ্ধির জন্যে সৃষ্ট পার্টনারশিপ। অবিমিশ্র স্বার্থপরতার ওপরে যে সম্পর্ক দাঁড়িয়ে থাকে তার মধ্যে যে পারস্পরিক অবিশ্বাস জড়িয়ে থাকবে তাতে সন্দেহ কি! অ্যাংলো-বানিয়া অর্ডার এমনই একটি সিনিক্যাল নৈরাজ্যবাদী অর্ডার।
কোম্পানির সঙ্গে লেনদেনে পাঁচটি কারবারি শ্রেণীর অভ্যুদয় ঘটে। এ শ্রেণীর শীর্ষে থাকে ব্যাংকার। কোম্পানিকে ব্যাংকারের দ্বারস্থ হতে হতো। জগৎ শেঠের মতো ব্যাংকারের ওপর ভর দিয়েই ভারতবর্ষে কোম্পানি শাসন সুসংহত হয়। পরবর্তী শ্রেণী বণিক। মনে করার সঙ্গত কারণ থাকবে বিদেশী বণিক শ্রেণীর আগমন ঘটলে স্বদেশী বণিকদের ক্ষতি স্বীকার করতে হবে। কিন্তু কার্যত দেশীয় বণিকদের শক্তিশালী অংশ বাণিজ্য ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়ে কোম্পানির দালালির মাধ্যমে সহজে উপার্জন শুরু করে। অন্য তিনটি শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে কোম্পানির এজেন্ট, স্বল্পসংখ্যক নিজস্ব ব্যবসায়ী এবং কোম্পানির কনট্র্যাক্ট বা কোম্পানির চুক্তিভুক্ত ঠিকাদার বণিক ও দালাল গোষ্ঠীতে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মধ্যস্ত ছিলেন আমিরচাঁদ বা উমিচাঁদ। বাংলায় কোম্পানির দালালদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে করিতকর্মা।
তীর্থংকর রায় লিখেছেন: আমিরচাঁদের সাহায্য মূল্যবান হলেও তার ইংরেজ বন্ধুরা লোকটিকে একেবারেই বিশ্বাস করত না। যে রাতে সিরাজের বাহিনী কলকাতা দখল করে, আমিরচাঁদ নিজেও জেলখানায় ছিলেন। সিরাজ তাকে মুক্তি দেওয়ার কথাটি কোনো কারণে ভুলে গিয়েছিলেন। যে কতিপয় ইংরেজ ফোর্ট উইলিয়ামের অন্ধকূপ থেকে বেঁচে বেরিয়ে আসে, তারা পাহারাওয়ালাদের মুখে গুজব শোনে যে বন্দিদের ওই খাঁচাটিতে পোরা হয় আমিরচাঁদের হুকুমে। তা সত্ত্বেও আমিরচাঁদ মুর্শিদাবাদের দরবারে এতটাই প্রভাবশালী যে ইংরেজদের একে ছাড়া চলত না। সিরাজউদদৌলাকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন নাটকে, চিত্রনাট্যে উমিচাঁদকে যেভাবে আমরা দেখতে অভ্যস্ত হয়েছি, তাতে তাকে একজন ধূর্ত বাঙালিই মনে হয়েছে। তিনি বাঙালি নন, হিন্দুও নন। তিনি শিখ ধর্মাবলম্বী অমৃতসরের একজন বণিক। বাণিজ্যের চেয়ে তার অধিক আগ্রহ দেখা গেছে ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে। আফিম ও সোরা বা পটাশিয়াম নাইট্রেটের ব্যবসায় তিনি বেশ অর্থকড়ি করেন। তবে তার প্রাচুর্যের বিস্তার ঘটেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দালালির মাধ্যমে। তিনি যাদের স্বার্থে স্বদেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে কুখ্যাত হয়ে ওঠেন, তাদেরই প্রধান লর্ড ক্লাইভ (১৭২৫-১৭৭৪) তাকে বলেছেন যুগের সেরা বিশ্বাসঘাতক।
উমিচাঁদের পরিচিতি আমিরচাঁদ ও আমিনচাঁদ হিসেবেও। বাংলার এলিটকুলের অনেকের সঙ্গেই তিনি ব্যক্তিগত সম্পর্ক করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের খানিকটা উদ্ধৃত করছি: উমিচাঁদ ও কৃষ্ণদাসকে লইয়া দোস্ত মহম্মদের প্রবেশ ও উভয়ে নবাবের সম্মুখে জানু পাতিয়া অভিবাদন জানাইলেন। সিরাজ: কৃষ্ণদাস, উমিচাঁদ, আসন গ্রহণ করো। এঁদের কোথায় দেখা পেলেন? দোস্ত: জনাব, অন্ধকূপের ন্যায় একটা গৃহে এঁরা বন্দী ছিলেন।
সিরাজ: উমিচাঁদ, নবাবী অধিকার অপেক্ষা কলিকাতা নিতান্ত নিরাপদ স্থান নয়, এতদিনে ধারণা হয়ে থাকবে।
উমিচাঁদ: জনাব, কারবারের সুবিধার নিমিত্ত কলিকাতায় ছিলেম, সমুচিত দ- হয়েছে, আমার সর্বস্ব গিয়েছে।
সিরাজ: কৃষ্ণদাস, নবাব চরিত্র তুমি অবগত ছিলে না, সেই নিমিত্তে কলিকাতায় এসে ইংরাজের স্মরণ নিয়েছিলে। আমরা যৌবনসুলভ অনেক দোষে দোষী স্বীকার করি, কিন্তু কেউ শরণাগত হয়ে আশ্রয় পায়নি বা গুরুতর অপরাধ করে মার্জনা প্রার্থনায় দোষ মাফ হয়নি, বোধ হয় আমাদের শত্রুর মুখেও শুনবে না। বিদেশী আপনার হয়, ইতিহাস পৃষ্ঠায় এর দৃষ্টান্ত নাই। তুমি তোমার পৈত্রিক আশ্রয়দাতা বর্জন করে সমুচিত ফল ভোগ করেছফিরিঙ্গির দুর্বচন সহ্য করেছদোষ অপেক্ষা তোমার দ- অধিক হয়েছে।
কৃষ্ণদাস: জনাব, ফিরিঙ্গির দ্বারা পীড়িত হওয়া অপেক্ষা আত্মগ্লানিতে বান্দার অধিক দ- হয়েছে।
সিরাজ: যাঁর হৃদয়ে ধারণা যে স্বদেশী অপেক্ষা বিদেশী আপনার হয়, তাঁর সে ধারণা যে সম্পূর্ণ ভ্রম, এই উমিচাঁদ আর কৃষ্ণদাসের প্রতি বিদেশীর ব্যবহার তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। চোখের ওপর এ দৃষ্টান্ত দর্শন করে যার ভ্রম দূর না হবে, যে হিন্দুর বা মুসলমান স্বার্থচালিত হয়ে স্বদেশের প্রতি ঈর্ষায় বিদেশীর আশ্রয় গ্রহণ করবে, সে কুলাঙ্গার। মাতৃভূমির কলঙ্ক। তার জীবন ঘৃণিত! এই দৃষ্টান্তে যদি বঙ্গবাসীর মনে প্রতীতী জন্মায় যে শত দোষে দোষী হলেও স্বদেশ আপনার, বিদেশীরা চিরদিনই পর, তাহলে আমাদের যুদ্ধশ্রম ও রণব্যয় সফল।
সকলে তখন জানু পেতে বললেন, জনাব স্বরূপ বলেছেন।
১৭২০-এর দশকে উমিচাঁদ বাংলায় এসে পরবর্তী দুই দশকে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে সোরার বাণিজ্যে প্রতিষ্ঠিত হন। নবাব আলীবর্দি খানের শাসনকালে তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি উপহার, ঘুষ প্রদান করে পরবর্তী সময়ে আফিম ও সোরার বাজারে আধিপত্য করতে থাকেন। তিনি নবাব সিরাজউদদৌলারও বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠেন। নবাব সিরাজউদদৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পলাশি ষড়যন্ত্রে ইংরেজরা তাকে আস্থাভাজন মনে করে। তিনি একই সঙ্গে মীর জাফরেরও আস্থা অর্জনে সক্ষম হন। পলাশির সাফল্যের আগেই উমিচাঁদ নিজে কীভাবে লাভবান হবেন তা নিয়ে কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন।
তীর্থংকর রায় লিখেছেন: সিরাজের শত্রুদের সংগঠিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমিরচাঁদ (উমিচাঁদ) ক্লাইভের কাছে চাইলেন সিরাজের তোষাখানার পাঁচ পার্সেন্ট বখরা আর সেই ষড়যন্ত্রে রাজি না হলে ভয় দেখালেন যে সব ফন্দি নবাবকে জানিয়ে দেওয়া হবে। ক্লাইভ আরও অনেকের মতোই বিশ্বাস করতেন যে আমিরচাঁদ হাড় স্বার্থপর এবং সুযোগ পেলেই নবাবের আশ্রয় নিয়ে কোম্পানির গলা কাটবেন। অতএব হেসে পাঁচ পার্সেন্ট তোলা দিতে রাজি হয়ে নিয়মমাফিক একটি হলফনামায় সই করলেন। ইংরেজদের আইনকানুনে অনভিজ্ঞ আমিরচাঁদ টের পেলেন না যে চুক্তিতে ওয়াটসনের সইটা জাল। পলাশির যুদ্ধের পর আমিরচাঁদ যখন জানতে পারলেন যে চুক্তিটা নকল, তখন পাঁচ পার্সেন্টের শোকে তার মাথা খারাপ হয়ে যায়।
কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা ষড়যন্ত্রের যুদ্ধে সিরাজের পতন নিশ্চিত হবার পর তোষাখানায় ঢুকে এবং কুড়ি লক্ষ পাউন্ড সেখান থেকে সরিয়ে নেয়। নবাবের খাসমহলের একটি কুঠরির সংবাদ কোম্পানির জানা ছিল না, জানতেন মীর জাফর ও চক্রান্তকারীরা। অনুমান করা হয় তারা সেখান থেকে ৮০ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের রতœ, স্বর্ণমুদ্রা ও মুক্তা আহরণ করেন।
দুর্ভাগ্য উমিচাঁদের, তিনি কিছুই পেলেন না, অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় ১৭৫৮ সালে মারা গেলেন। সেকালের কলিকাতায় দুটি বিখ্যাত বাগান ছিল উমিচাঁদের বাগান আর হালসী বাগান। হালসীর মালিক ছিলেন গোবিন্দরাম মিত্র। উমিচাঁদের বাগানসহ বহু বাড়িঘর তার মৃত্যুর পর দখল হয়ে গেল।
যে জাল চুক্তিনামা উমিচাঁদের জীবন বরবাদ করে দিল তাতে স্বাক্ষর করতে ক্লাইভের সেকেন্ড ইন কমান্ড ওয়াটসন রাজি ছিলেন না। তিনি জানতেন এটি প্রতারণার মুসাবিদা মাত্র। ক্লাইভের নির্দেশে ল্যাসিংটন সাহেব তাতে ওয়াটসনের ভুয়া স্বাক্ষর করেন। ক্লাইভ বলেছেন, ওয়াটসন তার নামে এই জালিয়াতিতে সম্মতি দিয়েছিলেন। তবে এটাও বলেছেন, ওয়াটসন অসম্মত হলেও সমস্যা হতো না, আমি নিজেই জাল সই করার অনুমতি দিতাম। উৎস: বণিকবার্তা, সিল্করোড। লেখক: এম এ মোমেন: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা