বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন চিন্তাবিদ। সেই সাথে, সত্যিকার অর্থেই একজন ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা, গবেষণা ও ব্যাখ্যা করেছেন; তিনিই ইসলামী চিন্তাবিদ। তিনি ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি বা ভুল দূর করে থাকেন। কাজেই এসব অর্থে বেগম রোকেয়াকে ‘ইসলামী চিন্তাবিদ’ বলতে হয়। অবরোধ, নারীস্বাধীনতা, পর্দা, অশ্লীলতা, যৌতুক প্রথা, বিধবা বিবাহ, বাল্যবিবাহ, তালাক নিয়ে ভ্রান্তি ও বড়াবাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি ইসলামের সঠিক অবস্থান তুলে ধরেছেন।
রোকেয়াকে নিয়ে যারা বিতর্ক সৃষ্টি করতে চান, তারা তার সামগ্রিক রচনাকর্ম ও জীবনের শিক্ষা বাদ দিয়ে খ-িত কিছু উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন। এসব বিতর্ক ইতোমধ্যে নানাভাবে অত্যন্ত সার্থকতার সাথেই খ-ন করা হয়েছে। বেগম রোকেয়ার একটি উদ্ধৃতি দেয়া হয়, যাতে তিনি বলেছেন- ‘আমরা প্রথমত যাহা মানি নাই, পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়ে শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগুলোকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন।’ এখানে কিছু ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। কিন্তু যদি রোকেয়ার সামগ্রিক সাহিত্যের আলোকে এ মন্তব্য ব্যাখ্যা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, এসব হচ্ছে মূলত তার ক্ষোভের কথা।
এখানে ধর্মগ্রন্থ নামে কিছু অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তির বই প্রচলিত ছিল, যাতে নারী অধিকারের বিপক্ষে বলা হতো। কুরআনে সামগ্রিকভাবে নারী-পুরুষের সাম্যের কথাই বলা হয়েছে। বেগম রোকেয়া আরো বলেছেন, ‘যদি ঈশ্বর কোনো দূত রমণী শাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত বোধহয় কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না। দূতগণ ইউরোপে যান নাই কেন? আমেরিকা এবং সুমেরু হইতে কুমেরু পর্যন্ত যাইয়া ‘রমণী জাতিকে নরের অধীনে থাকিতে হইবে’- ঈশ্বরের এই আদেশ শুনান নাই কেন? ঈশ্বর কি কেবল এশিয়ারই ঈশ্বর?’
তার এ কথায় ‘দূত’ বলতে রাসূল সা:-কে মনে করা সঙ্গত হবে না। বরং যেসব পুরুষ অন্যায়ভাবে এ অঞ্চলে নারীকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে, তাদেরকেই বোঝানো হয়েছে। কেননা, রোকেয়া তার বিভিন্ন লেখায় হজরত মুহাম্মদ সা:-কে বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্রাণভরে স্মরণ করেছেন। তার চেয়েও বড় কথা, ‘মতিচূর’ প্রথম খ-ের দ্বিতীয় প্রবন্ধ : নারী জাতির অবনতি’ ১৩১১ সালে ভাদ্রের ‘নবনূর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘আমাদের অবনতি’ শিরোনামে। এতে মূল প্রবন্ধের ২৩ থেকে ২৭ পর্যন্ত পাঁচটি পরিচ্ছেদ পরিবর্জিত হয়ে নতুন সাতটি অনুচ্ছেদ সংশোধিত হয়েছিল, যাতে আর কোনো ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ ছিল না। অথচ আজো রোকেয়ার এ দু-একটি উদ্ধৃতির অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে (দ্রষ্টব্য : এ এ রহমান, বেগম রোকেয়া ও ইসলাম, দি উইটনেস প্রকাশিত ‘রোকেয়া সন্ধানে’)।
১৩৩৮ সালের মাসিক মোহাম্মদীতে বেগম রোকেয়া মুসলমানদের নামের বিকৃতির বিষয়ে কঠোরভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। মুসলমানদের নাম আরবি ভাষায় হবে, এটি ছিল ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য। এটি তাকে সঠিক পরিচয় দেয়। রোকেয়া এর ওপর দৃঢ় থাকতে বলেছিলেন। অথচ আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে এ থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা চলছে। নামের এ রকম বিকৃতি থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। রোকেয়া ১৩৩৮ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা মাসিক মোহাম্মদীতে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘ছেলেবেলায় আমি মার মুখে শুনতাম, কুরআন শরিফ ঢাল হয়ে আমাদের রক্ষা করবে।’ এসব কথা সম্পূর্ণ সত্য। কুরআন শরিফের সার্বজনীন শিক্ষা আমাদের নানা কুসংস্কারের বিপদ থেকে রক্ষা করবে। কুরআন শরিফের বিধান অনুযায়ী ধর্ম-কর্ম নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতন থেকে আমাদের রক্ষা করবে। এত স্পষ্ট বক্তব্যের পরও কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীর মতে, রোকেয়া কোনো বিশেষ ধর্মকে বাতিল করেননি, বাতিল করে দিয়েছেন সর্বধর্মকেই। বস্তুত এ ধরনের মন্তব্য চরম মিথ্যাচার এবং অ্যাকাডেমিক ডিজ-অনেস্টি। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, তারাই বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের ‘নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে পরিচিত। বেগম রোকেয়া একজন উঁচুমানের সমাজ সংস্কারক ছিলেন। উপমহাদেশের গত হাজার বছরের ইতিহাসে তার মতো এত বড় সমাজ সংস্কারক ছিলেন খুব কমই। শুধু উপমহাদেশে নয়, সমগ্র বিশ্বের কয়েকজন সেরা সমাজ সংস্কারকের নাম বললে রোকেয়ার নাম বলতে হয়। সরকার ও আমাদের দায়িত্ব হলো, এত বড় প্রতিভাকে সমগ্র বিশ্বে পরিচিত করা। যারা প্রকৃতই রোকেয়ার চিন্তাচেতনাকে তুলে ধরতে চান, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে বেগম রোকেয়ার অপব্যবহার রোধ করা।
তাকে যারা ইসলামবিরোধীদের দলভুক্ত বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন, তাদের শৃঙ্খল থেকে রোকেয়াকে মুক্ত করে সঠিকভাবে তুলে ধরার দায়িত্ব আমাদেরই। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘সব মানুষের রূহ একই সাথে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আরাফ : আয়াত ১৭২)। অতঃপর আল্লাহ বলেন, ‘তিনি মানব ও মানবী উভয়কে সর্বোত্তম কাঠামোতে সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা ত্বিন)।
এরপরও যারা বলেন, নারী-পুরুষের চেয়ে দুর্বল বা নারীর হৃৎপি- ছোট কিংবা মগজ ছোট, তারা কুরআনের বিপরীতেই কথা বলেন।
সূরা নিসার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, সব মানব-মানবী হজরত আদম আ: থেকে সৃষ্ট। অতএব, আমাদের মধ্যে অকারণ বিভাজন কেন? নারীর স্বাধীনতা রাসূল সা:-এর সময় থেকে শুরু হয়েছে। বর্তমান শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ আল্লামা আবদুল হালিম আবু শুক্কাহর গবেষণার ফসল, ছয় খ-ের বিশাল গ্রন্থ ‘রাসূলের যুগে নারীর স্বাধীনতা’ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে দুঃখের বিষয়, রাসূল সা: যে দৃষ্টিতে মেয়েদের দেখতেন, সে দৃষ্টিতে আমরা দেখি না। প্রাথমিক ইসলামী পৃথিবী ছিল তেমনই এক পৃথিবী, যেখানে পুরুষ ও নারী ছিলেন একে অন্যের বন্ধু ও অভিভাবক। তারা একসাথে নামাজ পড়তেন, সামাজিক কাজ করতেন; সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করতেন। এমনকি যুদ্ধেও অংশ নিতেন। বেগম রোকেয়া, সেই রকম পরিপূর্ণ ইসলামী সমাজে বিশ্বাস করতেন। তারপরও তাকে ‘ইসলামবিরোধী’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। তার ব্যাপারে সমাজে বিভ্রান্তি লক্ষ করা যায়। বলা হয়, তিনি ধর্ম ও পর্দার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। এটি একেবারেই ভুল ধারণা। লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার