(শংকর এক জন জনপ্রিয় লেখক । তাঁর আসল নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়তাঁর ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘জনঅরণ্য’ কাহিনী অবলম্বনে ছবি বানিয়েছেন। তাঁর ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসটিও সিনেমা হয়েছে। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়করেছেন উত্তম কুমার। সেই প্রসঙ্গে শংকর বললেন, ‘সত্যজিৎই আমাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে।’
১৯৩৩ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায়দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে যান কলকাতার ওপারে হাওড়ায়। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড?াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে কখনও ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনও প্রাইভেট টিউশনি, কখনও শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। এক ইংরেজের অনুপ্রেরণায়শুরু করেন লেখালেখি। ‘বোধোদয়’ উপন্যাস প্রকাশের পর শংকরকে উৎসাহবাণী পাঠান শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলেছিলেন ‘ব্রাইট বোল্ড বেপরোয়া’। ভাবনা বা প্রকাশভঙ্গিতে তাঁর এই উপন্যাস নিজের অন্য লেখালেখি থেকে অন্য রকম হওয়ায় তিনি তা পড়তে দিয়েছিলেন মুম্বইনিবাসী শরদিন্দুকে। শরদিন্দু সেই লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এই লেখায়জননী জন্মভূমিকেই আমি সারাক্ষণ উপলব্ধি করলাম।’ পাঠকমহলের ‘নিন্দা ও প্রশংসার ডালি নিয়ে আমি নিজেও এক সময়‘বোধোদয়’কে ভালবাসতে শুরু করেছি’, বলেন মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি আশি পেরিয়েছেন শংকর। এখনও সমান তালে লিখে চলেছেন। ইদানীং তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। স্বামীজির জীবনের অনেক না জানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে শংকরের লেখায় আমি বিবেকানন্দ বলছি, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ। শংকরের লেখা বই আজও বেস্ট সেলার।)
ইন্টারনেটের সৌজন্যে খবরপত্রের পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হলো।- বি.স
(পূর্ব প্রকাশের পর)
না, ঘরেই সার্ভ করুক। আমি একটু সলিটিউড় চাই, একস্ট্রা সার্ভিস চার্জ বিলে ঢুকিয়ে দেবেন।
বোসদা বললেন, একটু অপেক্ষা করুন, মেনু কার্ডটা আনিয়ে দিচ্ছি। মিসেস পাকড়াশী বললেন, কিছু নয়, শুধু একটু হট চিকেন সুপ।
সে কি! সামান্য একটু ফিশ প্রিপারেশন?
পাগল! এতেই যেভাবে ওজন বেড়ে যাচ্ছে। বলে মিসেস পাকড়াশী কাউন্টার থেকে এগিয়ে গেলেন।
বোসদা কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে পূর্ববঙ্গীয় কায়দায় বললেন, হায় রে, স্লিম-হওন-প্রয়াসী! আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বোসদা বললেন, হয়তো তোমার বিশ্বাস হবে না। কিন্তু জানো, মিসেস পাকড়াশী অত্যন্ত গোঁড়া ছিলেন। খুব গরিব ঘরের মেয়ে কিনা উনি।
রবার্টসন নামের ইংরেজ ছোকরা পনেরো মিনিট পরেই আসরে অবতীর্ণ হলেন। খাতায় সই করে দিয়ে রবার্টসন যখন উপরে চলে যাচ্ছিলেন, তখন বোসদা জিজ্ঞাসা করলেন, সাপার পাঠিয়ে দিতে হবে নাকি? মিসেস পাকড়াশী হট চিকেন স্যুপের অর্ডার দিয়েছেন।
রবার্টসন বললেন, আমার সাপার চাই না। কোনো অ্যালকহলিক ড্রিঙ্কের ব্যবস্থা সম্ভব কিনা তাই বলুন। যদি সামান্য একটু বেশি খরচ লাগে তা বলতে যেন দ্বিধা করবেন না।
বোসদা দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, কোনো উপায় নেই। একসাইজের নিয়মভঙ্গ করা শাজাহানের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হোটেলের পক্ষে সম্ভব নয়।
ভদ্রলোক হতাশ মনে লিফটে উপরে উঠে গেলেন। আমি বোসদাকে প্রশ্ন করলাম, ড্রাই-ডেতে মিসেস পাকড়াশী এমন অ্যাপয়েন্টমেন্ট না-করলেই পারতেন।
তুমিও যেমন। উনি তো দেখে দেখে ড্রাই-ডে পছন্দ করেন। ড্রাই-ডেতে হোটেলগুলো ঝিমিয়ে পড়ে। লোকজনের যাতায়াত একরকম থাকে না বললেই চলে। ওইদিনই তো ওঁর পক্ষে নিরাপদ। ড্রাই-ডে এখন সপ্তাহে একদিন। শুনছি ওটা ক্রমশ বাচ্চা পাড়তে আরম্ভ করবে। এক দুই হবে; দুই চার হবে। এমনি করে একদিন সপ্তাহের সাতটা দিনই শুকনো হয়ে যাবে। তখন কী যে হবে!
শুকনো দিনের পরেই ভিজে দিন। সেই ভিজে দিনের ভোরেই অর্থাৎ রাত চারটে থেকে আমার স্পেশাল ডিউটি ছিল। কাউন্টারে চুপচাপ একা দাঁড়িয়ে ছিলাম। কাজের মধ্যে কেবল জাপান থেকে আসা কয়েকজন আকাশযাত্রীকে স্বাগত জানানো। তাদের থাকবার ব্যবস্থা কলকাতার এক খ্যাতনামা ট্রাভেল এজেন্সি আগে থেকেই করে রেখেছিল। ট্রাভেল এজেন্সির এক ছোকরাও সঙ্গে ছিল।
ট্রাভেল এজেন্সি আমাদের বহু অতিথি পাঠান। কিন্তু ম্যানেজার মনে মনে তাদের খুব পছন্দ করেন না। কারণ খুবই সহজ। আমাদের হোটেলে যে তারা খদ্দের পাঠালেন, তার পরিবর্তে বিলের শতকরা দশভাগ তাদের পাওনা। তাছাড়া চেকটা প্রায়ই খদ্দেরদের কাছে পাওয়া যায় না। অতিথিরা খাওয়া-দাওয়া, হই হই হট্টগোল আর স্ফুর্তি করে বিদায় নেন। আমরা হিসেব রেখে ট্রাভেল এজেন্টের কাছে বিল পাঠাই। তারা তখন নিজেদের অংশটি কেটে রেখে চেক দেন।
ট্রাভেল এজেন্সির ছোকরা যখন বিদায় নিল, তখন চারটে বেজে কয়েক মিনিট। তার ঠিক পরেই সিঁড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যিনি নেমে এলেন তিনি মিসেস পাকড়াশী। ঘুম থেকে উঠে মিসেস পাকড়াশী বোধহয় চুলগুলো ঠিক করে নেননি। অথচ কালো চশমাটা পরে ফেলেছেন।
ধীর পদক্ষেপে এগোতে এগোতে মিসেস পাকড়াশী একবার কাউন্টারের দিকে তাকালেন। বোধহয় বোসদার খোঁজ করলেন। আমি বললাম, গুড মর্নিং, ম্যাডাম। মিসেস পাকড়াশী যেন শুনতেই পেলেন না। আপন মনে হাতের ব্যাগটা জড়িয়ে ধরে বাইরে চলে গেলেন। রাত্রের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে শাজাহান হোটেলের দারোয়ানজির হুইসলের আওয়াজ শুনতে পেলাম। এই হুইসলের শব্দেই দারোয়ানজি ট্যাক্সি ডেকে পাঠান।
মিসেস পাকড়াশীর পরই যার সঙ্গে আমার দেখা হল সে নিউ মার্কেটের এক ফুলের দোকানের কর্মচারী। হাতে একগোছা বিভিন্ন রকমের ফুল। তখন বুঝিনি, পরে জেনেছিলাম ওগুলো ফুলের নমুনা। সে দু নম্বর সুইটের মেমসায়েবের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। লোকটাকে করবী দেবীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। তিনি ফুল পছন্দ করে দিয়েছেন।
ও ঘরের ওই প্রাত্যহিক সূচি পরে আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। আমাদের কাছে সুইটের অন্য খাতির। যে ঘরে শুধু বিছানা আছে, তার নাম রুম। আর রুমের সঙ্গে একটা বসবার ঘর থাকলেই সেটা হয়ে গেল সুইট। হাসপাতালে জেনারেল বেডের সঙ্গে কেবিনের মর্যাদার যা তফাত, হোটেলের রুম এবং সুইটেরও সেই পার্থক্য। কেবিনেরও যেমন জাতিভেদ আছে, সুইটেরও তেমনি। দু নম্বর সুইটেরও জাত আলাদা। দু নম্বরের আলাদা ফোন আছে, এবং ঘরের মধ্যে একাধিক ঘর আছে। ঘর সাজাতে প্রতিদিন অনেক ফুল লাগে। করবী দেবী নিজে ফুল পছন্দ করেন। ফুল পছন্দর পরই লিনেন ক্লার্ক নিত্যহরি ভট্টাচার্য পেন্সিল আর কাগজ নিয়ে করবী দেবীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। শাজাহান হোটেলে যত চাদর লাগে, পর্দা লাগে, টেবিলক্লথ লাগে, তার রাজাধিরাজ হলেন নিত্যহরিবাবু। সবাই বলে, নিত্যহরিদা ভাগ্যবান লোক।
নিত্যহরিদা বলেন, তা নয়! বাউনের ছেলে হয়ে ধোপর কাজ করছি, এর থেকে ভাগ্য আর কী হবে! বাবা তখন কতবার বলেছিলেন, নেত্য, মন দিয়ে পড়াশোনা কর। তা নেত্যর সে-কথা কানে গেল না। নেত্য তখন ফুটবল, যাত্রা, গান, পান, বিড়ি নিয়ে পড়ে রইল। এখন নেত্য বুঝছে। দুনিয়ার লোকের পরা কাপড় বয়ে বেড়াচ্ছে। হিসেব করছে। ময়লা কাপড় ফরসা করে আবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে।
নিত্যহরিদা আরও বলেন, গুরুবাক্যি অমান্য করলে এই হয়। একেবারে হাতেহাতে ফল। কে জানে গত জন্মে বোধহয় ধোপার কাপড় চুরি করেছিলাম। নইলে এমন শাস্তি ভগবান কেন দেবেন?
বেয়ারারা ওঁকে দেখতে পারে না। তারা বলে, পরের জন্মে তাহলে তোমার কী যে হবে জানিনে। চুরি করে তো ফাঁক করে দিলে। বাপের দূরদৃষ্টি ছিল। নামটা ঠিকই দিয়েছিলÍনিত্য হরণ করে যে সে নিত্যহরি।
সায়েবরা বলেন, ন্যাটা। স্যাটা এবং ন্যাটা দুজনেই কর্তাদের প্রিয়। মার্কোপোলো মাঝে মাঝে আদর করে বলেন, স্যাটাহারি ও ন্যাটাহারি। গুপ্ত সংবাদ পরিবেশনে ন্যাটাহারির প্রতিপত্তি মাতাহারির থেকেও বেশি। ন্যাটাহারিবাবু কানে পেন্সিলটা গুঁজে করবী দেবীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রথমেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন। করবী দেবী সভয়ে পিছিয়ে যান। কী করেন, কী করেন!
ন্যাটাহারিবাবু দমবার পাত্র নন। বলেন, না মা। তুমি সাক্ষাৎ জগজ্জননী। হাঁপের টানে কতদিন ভুগলাম। তারপর, ভাগ্যে বাবা তারকেশ্বর স্বপ্নে বললেন, তোর হোটেলেই চিকিচ্ছে রয়েছে। আর মা, তোমাকে সেই প্রণাম করার পর থেকেই বেশ ভালো আছি। হাঁপানি নেই বললেই চলে।
করবী গুহ বিষণ্ণ মুখটা হাসিতে ভরিয়ে বলেন, আজ যে ফুল আনতে দিয়েছি, তার সঙ্গে ম্যাচ করবে হালকা বাসন্তী রং। পর্দা, টেবিলক্লথ, বেডশিট, টাওয়েল সব ওই রংয়ের চাই। আপনার স্টকে আছে তো?
কান থেকে পেন্সিলটা বার করতে করতে ন্যাটাহারিবাবু বললেন, কী যে বলেন মা লক্ষ্মী। নিত্যহরি যতক্ষণ আছে ততক্ষণ সব পাবেন। প্রতিমুহূর্তে খিটখিট করি বটে। কিন্তু না করলে এই আড়াইশো ঘর কি সাজিয়ে রাখতে পারতাম? তবে মা, সে রামও নেই, সে অযোধ্যা নেই। তখন সায়েসুবোরা আসত, এ-সবের কদর বুঝত। প্রতিদিন বেড়শিট চেঞ্জ হত। এখন একদিন ছাড়া ছাড়া।
করবী দেবীর এ-সব শুনতে ভালো লাগে না। কিন্তু সকৌতুক প্রশ্রয় দিয়ে ন্যাটাহারিবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর মৃদু হেসে বলেন, জিনিসগুলো তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেবেন।
এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার তো সব মুখস্থ, কোথায় রেখেছি। এখন এরা বুঝবে না। যদি কোনোদিন পালাই, কিংবা কামাই করি তখন এরা আমার কদর বুঝবে।
নিত্যহরিবাবু তার প্রাত্যহিক ইন্টারভিউ সেরে আমার চোখের সামনে দিয়ে উপরে চলে গেলেন। হোটেলের কাজকর্ম ইতিমধ্যে জমে উঠেছে। রোজি নিচেয় নেমে এসে জিমির ব্রেকফাস্টের মেনুকার্ডগুলো টাইপ করতে আরম্ভ করেছে।
এক নম্বর সুইটের রবার্টসন তখনও বোধহয় নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। আমি আন্দাজ করেছিলাম, ভদ্রলোকও মিসেস পাকড়াশীর সঙ্গেই হোটেল থেকে সরে পড়বেন।
ভদ্রলোক যে বহুকাল বাঁচবেন তা পরমুহূর্তেই বুঝলাম। বেয়ারা এসে বলল, এক নম্বর সুইটের সায়েব আপনাকে ডাকছেন।
কাউন্টার ছেড়ে রেখে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু রোজি আজ আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে। আমি যে সত্যিই মিস্টার ব্যানার্জির ব্রাদার-ইন-ল নই তো যেন সে ক্রমশ বিশ্বাস করছে।
রোজি বললে, ম্যান, এখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকো না। এক নম্বর সুইটের গেস্ট কমপ্লেন করলে আর চাকরি করে খেতে পারবে না।
আমি বললাম, আপনার তো তাতে সুবিধেই হবে।
মুখ রাঙা করে রোজি বললে, আমি অনেকদিন বেকার ছিলাম। আমার দুটো বোন বেকার বসে রয়েছে। আমার বাবার চাকরি নেই। চাকরি না থাকা কি জিনিস তা আমি বুঝি, ম্যান। যেহেতু আমি কিন্তলী, যেহেতু আমি একটা হাফ-নো লোকের সঙ্গে পালিয়েছিলাম, সেহেতু আমার অনুভব-শক্তি থাকতে পারে না?
রোজি হাসল। ভোরবেলার সেই হাসির মধ্যে প্রচ্ছন্ন বেদনা ছড়িয়ে ছিল। কেন জানি না, সেই প্রসন্ন প্রভাতে রোজিকে আমার হঠাৎ সুন্দর বলে মনে হল।
রোজি আমাকে সরিয়ে দিয়ে বললে, যাও, ওখানে দেখা করে এসো ততক্ষণ আমি কাউন্টার পাহারা দিতে পারব।
বেয়ারাকে সঙ্গে করে, আমি এক নম্বর সুইটের সামনে এসে যখন দাঁড়ালাম, তখন করিডরে বসে বেয়ারারা জুতো পরিষ্কার করছে। জুতোর তলায় সাদা খড়ি দিয়ে দাগ দিচ্ছে। দাগ দেওয়ার উদ্দেশ্য তখনও জানতাম না। দাগ দিয়ে ঘরের নম্বর না-দিলে জুতো গোলমাল হয়ে যায়, দুশো নম্বর ঘরের জুতো দুশো দশ-এ গিয়ে হাজির হয়। নিজের সু পায়ে গলাতে গিয়ে, হোঁতকা সায়েব দেখেন সেখানে কোনো ক্ষীণকায়া মহিলার হাইহিল জুতো পড়ে রয়েছে। আর সুন্দরী মেমসায়েব ঘুম থেকে উঠে নিঃসঙ্গ বিছানার পাশে রবারসোল ভারী বুট দেখে আঁতকে ওঠেন। আমাদেরই হোটেলে একবার ঘরের মধ্যে বুটজোড়া দেখে এক কুমারী মেম-সায়েব হেলপ হেলপ বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, বুটের মালিকও বোধহয় ঘরের মধ্যে কোথাও লুকিয়ে রয়েছেন। বেয়ারা ছুটে আসে। ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারে। তাড়াতাড়ি গোলমালটা শুধরে নেয়। না-হলে হয়তো গ-গোলটা অনেকদূর গড়াত, এবং গড়াতে গড়াতে মার্কোর কানে পৌঁছলে নিশ্চয়ই চাকরি যেত। এই গ-গোলের পর থেকেই জুতো বার করবার সময় তলায় খড়ি দিয়ে ঘরের নম্বর লিখে রাখার ব্যবস্থা চালু হয়।
বাইরে থেকে এক নম্বর সুইটের দরজায় নক্ করে আমরা দুজন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ভিতর থেকে শব্দ হলÍকাম ইন। ভিতরে ঢুকে যাকে সুপ্রভাত জানালাম তিনি একটা ফর্সা হাতকাটা গেঞ্জি এবং একটা খর্বাকৃতি জাঙিয়া পরে বিছানার উপর বসেছিলেন। আমাদের দুজনকে দেখে তাঁর কোনোরকম চাঞ্চল্য দেখা দিল না। ঠিক সেইভাবেই বসে থেকে বললেন, মিস্টার বোস কোথায়?
বললাম, তিনি এখনও ডিউটিতে আসেননি।
একটু লজ্জা পেয়ে, আস্তে আস্তে বললেন, গতরাত্রে এ-ঘরে সারারাত দুজনে আমরা ছটফট করেছি। বালিশ কম ছিল। ডবল বেডে রুমে মাত্র একটা বালিশ। আমি রাত্রেই কমপ্লেন করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার কমপ্যানিয়ন বারণ করলেন।
বললাম, অত্যন্ত দুঃখিত। আপনি বললে তখনই বালিশের ব্যবস্থা করে দিতাম। আমি এখনই বালিশ আনিয়ে দিচ্ছি।
ভদ্রলোক উঠে পড়ে আলমারি থেকে একটা ট্রাউজার বার করতে করতে বললেন, তার দরকার নেই। আমার কমপ্যানিয়ন অনেকক্ষণ চলে গিয়েছেন। আমিও এখনি বেরিয়ে যাচ্ছি। আমি ডেকেছি অন্য কারণে। এই খামটা উনি আপনাদের মিস্টার বোসের হাতে দিতে বলে দিয়েছেন। ওঁকে মনে করে দিয়ে দেবেন।
জানতে চাইলাম, সুইটটা আজও ওঁদের জন্যে রিজার্ভ থাকবে কিনা। সায়েব বুশশার্টটা পরতে পরতে বললেন, এখনও ঠিক জানি না। পরে মিস্টার বোসকে ফোন করতে বলবেন।
ঘর থেকে বেরিয়ে, কাউন্টারে এসে দেখলাম সত্যসুন্দরদা ইতিমধ্যে শাজাহান হোটেলের হাল ধরেছেন। তাকে বললাম, ভদ্রমহিলা আপনাকে এই খামটা দিয়ে গিয়েছেন। আর ঘরে বালিশের সংখ্যা কম ছিল। ওঁদের বেশ অসুবিধে হয়েছে।
খামটা খুলে ভিতরে উঁকি মেরে বোসদা বললেন, ভদ্রমহিলা আমাকে সত্যিই লজ্জায় ফেলছেন। যার যা খুশি দুনিয়াতে করছে। মিসেস পাকড়াশীও বাদ যাবেন কেন? আমি এত ইতর নই যে, এই কুড়ি টাকা না পেলে রেজিস্টারে ভদ্রমহিলার নাম বসিয়ে দেব।
এবার আমাকে বললেন, গেস্টদের অভিযোগগুলো এনকোয়ারি করাটা খুব প্রয়োজনীয় কাজ। মার্কোপোলোকে বললে, এখনি নিত্যহরিবাবুকে তাঁর ফোর্টিনথ জেনারেশনের নাম ভুলিয়ে ছাড়বেন। তুমি ওঁকে একটু বলে এসো। আফটার অল্ মিসেস পাকড়াশীর স্বামীর এই হোটেলটার উপর নজর আছে। যে-কোনোদিন বোর্ডে ঢুকতে পারেন।
ন্যাটাহারিবাবু যে কোথায় থাকেন, কোথায় তার স্টোর রুম আমার জানা ছিল না। সামনে পরবাসীয়া ঘোরাঘুরি করছিল। তাকে সঙ্গে করেই আবার উপরে উঠতে আরম্ভ করলাম। যাবার পথে মিসেস পাকড়াশীর সঙ্গীকে খালি হাতে নেমে আসতে দেখলাম। ভদ্রলোক গতকাল রাত্রে কিছু না নিয়েই হোটেলে এসে উঠেছিলেন।
এই বাড়িটা যেন একটা শহর। এখানে এত ঘর আছে, এত বারান্দা আছে। এবং এত গলিখুঁজি আছে যে, চিনে নিতে বহু সময় লাগে। চেনার যেন শেষ হয় না। তিন তলায় উঠে লম্বা করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দুদিকে কেবল বন্ধ ঘরের দরজা ও পিতলের নম্বর দেখে মনে হচ্ছিল, ঘরগুলোতে যেন কেউ নেই। থাকলেও তারা সবাই অঘোরে ঘুমিয়ে রয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় কার্পেটের পথ শেষ হয়ে গেল। ডানদিকে একটা বন্ধ দরজা রয়েছে। ভেবেছিলাম, ওটাও হয়তো ঘর। কিন্তু পরবাসীয়া হাতলটা ঘুরোতে বুঝলাম আর একটা পথ শুরু হল। দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে আমরা হেঁটে চলেছি। দুধারে আবার ঘরের সারি। এই ঘরগুলো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নয়। পথটাও যেন হঠাৎ একটু নিচু হয়ে গিয়েছে।
পরবাসীয়ার কাছে শুনলাম, এইটাই হোটলের সবচেয়ে পুরানো অংশ। সিম্পসন সায়েব নিজে এই দিকটা তৈরি করেছিলেন। আজও তিনি এই দিকটায় বেশি ঘোরাঘুরি করেন।
দুএকটা ঘরে দরজা সামান্য খোলা রয়েছে। তার ফাঁক দিয়ে হাঁটবার পথে বিশেষ কিছুই দেখা যায় না। শুধু মাথার উপর যে পাখা ঘুরছে তা দোদুল্যমান ছায়া থেকে বোঝা যাচ্ছে। রেডিওর চাপা শব্দও দু একটা ঘর থেকে কানে আসছে। একটা ঘরে দুজন জাপানি ভদ্রলোক দুমগ বিয়ার নিয়ে বসে আছেন। তার পাশের ঘরেই এক আমেরিকান পরিবার। তার পরের ঘরে পাঞ্জাবের সর্দারজী পাগড়ি এবং দড়ির জাল খুলে মাথায় হাওয়া লাগাচ্ছেন। তার পাশের ঘরে নিশ্চয় বার্মার লোকÍপরনে লুঙি। বিভিন্ন ভাষায় বাক্যালাপের কয়েকটা ভাঙা টুকরো আমার কানের কাছে ঠিকরে এল। যেন একটা অল ওয়েভ রেডিও নিয়ে আমি ছেলেমানুষের মতো চাবিটা ঘুরিয়ে যাচ্ছি এবং মুহূর্তের জন্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাষার ভগ্নাংশ কানে পৌঁছতে না পৌছতেই অন্য ভাষার স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে।
(সংকলিত)
——চলবে