সদ্য প্রয়াত ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে নিজের বহুমাত্রিক অবদান রেখেছেন। নিজেকে তিনি ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওর্য়াদীর ভাবশিষ্য বলতেন। পারিবারিক জীবনে তিনি পিতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মাধ্যমে সোহারাওয়ার্দীর নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। জীবনভর কাজ করেছেন গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে।
নির্ভীক সাংবাদিক, পিতা মানিক মিয়ার আকস্মিক মৃত্যুর পর দৈনিক ইত্তেফাক-এর হাল ধরেন পুত্র মইনুল হোসেন। ষাট দশকের শেষপ্রান্তে মানিক মিয়ার জীবনাবসানের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে ইত্তেফাকের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। প্রয়োজন হয় সংকট মোকাবিলার। দেশের মুখপত্র হিসেবে ইত্তেফাক সেই সময় জাতির স্বাধিকার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছিল। মইনুল হোসেন ইত্তেফাকের সংগ্রামী ঐতিহ্য ও গণমুখী উত্তরাধিকার অব্যাহত রাখেন। সত্তরের দশকের প্রারম্ভে পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন চলছিল, এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের সংকটগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন ও ইত্তেফাককে রক্ষা করেন জাতীয় দৈনিক রূপে। তিনি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালের প্রথম সংসদের তিনি একজন নির্বাচিত সদস্য ছিলেন।
কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি বাকশাল ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। রাজনীতিতেও তাঁর অবস্থান ছিল বহুদলীয় গণতন্ত্রের পক্ষে। তিনি সামরিক স্বৈরাচারেরও তীব্র সমালোচক ছিলেন। তাঁর বলিষ্ঠ প্রতিবাদী অবস্থানের কারণে তিনি ছিলেন জাতির বিবেক ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর স্বরূপ। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালে সংবিধানের মৌলিক চরিত্র পরিবর্তন করে বাকশাল শাসন প্রবর্তন হলে প্রতিবাদ স্বরূপ সংসদ সদস্য পদ থেকে তিনি ইস্তফা দেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর তিনি দেশে গণতন্ত্র ও বেসামরিক সাংবিধানিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় উদ্যোগ নেন। গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতাদের একটি ঐক্যমঞ্চে শামিল করতে তৎপর হন। দেশে একটি ভারসাম্যমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। এই লক্ষ্য অর্জনে তিনি ব্যক্তিগতভাবেও উদ্যোগ নেন। এই প্রক্রিয়াকে ফলপ্রসূ করার কাজে তিনি যখন ব্যস্ত ছিলেন, তখন সরকার তাকে ১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসে গ্রেপ্তার করে। তিন মাস ডিটেনশনে আটক রাখার পর ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যাপারে উদার ও স্বাধীন মতামত রাখার জন্য তিনি ‘নিউ নেশন’ নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেন, যা পরবর্তীকালে দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। তৎকালীন ‘ইত্তেফাক ভবন’ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক রোববার, সাপ্তাহিক পূর্বাণী, পাক্ষিক ক্রীড়ালোক প্রকাশের পেছনে ছিল তাঁর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি ও প্রেস কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশে প্রথম গঠিত প্রেস কমিশনেও তাঁকে সদস্য করা হয়। প্রেস কমিশনের রিপোর্ট প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নিজেকে সরাসরি সাংবাদিক না বলে সংবাদপত্রসেবী মনে করতেন তিনি। শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী গণমাধ্যমের বিকাশের লক্ষ্যে তিনি সরব ও সোচ্চার থেকেছেন সব সময়।
তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন (২০০০-২০০১) এবং আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষায় মূল্যবান অবদান রাখেন। আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য তিনি লড়াই করেছেন আজীবন। ওয়ান-ইলেভেনের পর তিনি এক বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন, যা ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।
১৯৯০ সালে বহুল আলোচিত ‘৩১ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি’র তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা এবং স্বাক্ষরদাতা। এই বিবৃতিতে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে নির্দলীয় জাতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানানো হয়েছিল। দেশ ও জাতির বিপদকালে বিবেকবানদের নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকা উচিত নয়, এই উপলব্ধি থেকেই তিনি এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরেও তিনি এমন উদ্যোগ বহুবার নিয়েছেন। জাতির ক্রান্তিকালে, বিশেষত গণতন্ত্রের অধঃপতন হলে তিনি চুপ থাকেন নি। অগণতান্ত্রিকতার তীব্র সমালোচনা করে তিনি সাহসের সাথে এগিয়ে এসেছেন তাঁর লেখনী, বক্তব্য ও তৎপরতার মাধ্যমে। এবং গণতন্ত্রমনা বু্দ্িধজীবী ও নাগরিক সমাজকে প্রণোদিত করেছেন। ২০১৮ সালের ১৬ই অক্টোবর একটি বেসরকারি টেলিভিশন টকশোতে আলোচনার জেরে তোপের মুখে পড়েন তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে মানহানির মামলায় ২০১৮ সালের ২২শে অক্টোবর তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিন মাসের বেশি সময় কারাগারে থাকার পর ২০১৯ সালের ২৭শে জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পান তিনি। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ‘বাংলাদেশ: বাস্তবতা ও প্রত্যাশা’, ‘গণতন্ত্রের সাফল্য চাহিয়াছি’, ‘ঘুরে দাঁড়াতে হবে’, ‘আমার জীবন আমাদের স্বাধীনতা’, ‘বাংলাদেশ: কি চেয়েছি, কি পেয়েছি’, ‘অবিস্মরণীয় মানিক মিয়া’। তিনি উদ্যোগী হয়ে পিতা, নির্ভীক সম্পাদক মানিক মিয়ার ‘নির্বাচিত কলাম’ প্রকাশ করেন।
তিনি ছিলেন মতাদর্শিক বিবেচনায় গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সাধক। পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধ্যান-ধারণা তিনি লালন করতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ও ব্রিটিশ ব্যবস্থায় আইনশাস্ত্র অধ্যয়নের ফলে এবং হোসেন শহীদ সোহারাওয়ার্দীর সাহচর্যের কারণে তিনি গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি নিজের দায়বদ্ধতা পালনে ছিলেন আপসহীন। ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার হাত ধরে গণতান্ত্রিক সমাজ ও স্বাধীন সংবাদপত্র বিকাশের যে আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমান্তরালে প্রবহমান ছিল, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন সে ধারাবাহিকতাকে অগ্রগ্রামী করতে সচেষ্ট ছিলেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি তাঁর নীতি, আদর্শ ও বিশ্বাস থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হন নি এবং শত বিরূপতাতেও গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই অব্যাহত রেখেছেন। লেখক: ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।