অসহায় ও আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা মহৎকাজ। বিশেষ সময়ে বিশেষ আমলের রয়েছে বিশেষ প্রতিদান। ঠিক তেমনি এই শীত মৌসুমে হতদরিদ্র ও অসহায় মানুষের সেবা করা সামর্থ্যবানদের জন্য আবশ্যক। শীতে কাঁপছে গোটা দেশ। কনকনে ঠাণ্ডায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন। ফুটপাথ ও গ্রামের অসহায় অনেকের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই শীত। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের অভাবী ও গরিব মানুষ। শিশু ও বয়স্কদের দুর্ভোগও বর্ণনাতীত। শীতে অভাবী মানুষের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে শীতবস্ত্রের। জীবনযাত্রা কষ্টকর হয়ে পড়ছে দিনমজুর, ভ্যানচালক, ইজিবাইকচালক, শ্রমিকসহ সাধারণ কর্মজীবী ও ছিন্নমূল মানুষ। প্রত্যহ হিমভোরে কাজে যোগ দিতে দুর্ভোগে পড়ছেন খেটেখাওয়া মানুষজন। কাজে যেতে না পারায় পরিবার-পরিজন নিয়ে সমস্যায় রয়েছেন তারা। প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রের অভাবে সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়েছে শিশু, নারী, প্রতিবন্ধী ও বয়স্করা। বাড়ছে ঠাণ্ডাজনিত রোগব্যাধি। বাড়ছে সর্দি-কাশি, হাঁপানিসহ ফুসফুসজনিত বিভিন্ন রোগ।
সমাজের বিত্তবান ও মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের দুর্দশাগ্রস্ত এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজন। নইলে সাধারণের দুর্ভোগ আরো বাড়বে। এ ক্ষেত্রে সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তিপর্যায়ের উদ্যোগের মাধ্যমেও এমন পরিস্থিতি থেকে শীতার্তদের রক্ষা করা যায়। অন্তত পুরনো পোশাক দিয়ে হলেও শীতার্তদের পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘যে মুসলমান অন্য কোনো মুসলমানকে বস্ত্রহীন অবস্থায় বস্ত্র দান করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে সবুজ রঙের পোশাক পরাবেন। খাদ্য দান করলে তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। পানি পান করালে জান্নাতের শরবত পান করাবেন।’ (সুনানে আবু দাউদ-১৬৮২)
হতদরিদ্র মানুষের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানবসেবা। এটি সওয়াবের কাজও বটে। বদর যুদ্ধের বন্দী হজরত আব্বাস রা:-কে রাসূলুল্লাহ সা: পোশাকের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাঁর কাছে মুদার গোত্র থেকে গলায় চামড়ার আবা পরিহিত বস্ত্রহীন কিছু লোক আগমন করল। তাদের করুণ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ সা:-এর চেহারা বিষণ্ন হয়ে গেল। তিনি সালাত শেষে সাহাবায়ে কেরাম রা:-কে লক্ষ করে দান-সদকার জন্য উৎসাহমূলক বক্তব্য দিলেন। ফলে সাহাবায়ে কেরাম রা: এত অধিক পরিমাণ দান করলেন যে, খাদ্য ও পোশাকের দু’টি স্তূপ হয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ সা: অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অভাবীকে বস্ত্র দানের গুরুত্ব প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করলেন, ‘কোনো মুসলমান অপর মুসলমানকে কাপড় দান করলে যতক্ষণ ওই কাপড়ের টুকরো তার কাছে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত দানকারী আল্লাহর হেফাজতে থাকবে।’ (জামে-তিরমিজি-২৪৮৪) চলতি শীতে করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তা ছাড়া এ সময়ে শীতজনিত প্রাদুর্ভাব (যেমন সর্দি-কাশি, হাঁপানিসহ) নানা রোগে আক্রান্ত থাকে বেশির ভাগ মানুষ। তাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি অসহায় মানুষের চিকিৎসাসেবা প্রদানে বিত্তশালীদের এগিয়ে আসা উচিত। প্রভাবশালী হাসপাতাল মালিকরা অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্পের মাধ্যমে ফ্রি চিকিৎসা সহায়তা দিতে পারেন। কারণ মানুষের অসুস্থতার আপদ দূর করলে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া-আখিরাতে তার বিপদাপদ দূর করে দেন। এই হাড় কাঁপানো শীতে যে বিপুল জনগোষ্ঠী বর্ণনাতীত দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দ্বীনি দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মু’মিনের দুনিয়াবি সমস্যাগুলোর একটি সমাধান করে দেয়, আল্লাহ তায়ালা তার আখিরাতের সঙ্কটগুলোর একটি মোচন করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনে সাহায্য করবে, আল্লাহ তায়ালাও তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে স্বাচ্ছন্দ্য দান করবেন।’ (মুসলিম-২৬৯৯)
শীতের তীব্রতা খুব বেশি বেড়ে গেলে কিংবা টানা শৈত্যপ্রবাহ থাকলে আমরা শীতবস্ত্র বিতরণের প্রয়োজন অনুভব করি। অথচ দান করার ইচ্ছে থাকলে শীতের শুরুতেই অসহায়দের শীতের উপকরণ পৌঁছে দেয়া উচিত। এতে শীতার্তদের কষ্ট লাঘব হয়। তা ছাড়া হাদিসে যথাসময়ে দ্রুত দান করার আদেশ দেয়া হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, এক সাহাবি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:! কোন দানে সওয়াব বেশি পাওয়া যায়? রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘সুস্থ ও কৃপণ অবস্থায় তোমার দান করা, যখন তুমি দারিদ্র্যের আশঙ্কা করবে ও ধনী হওয়ার আশা রাখবে। দান করতে এ পর্যন্ত বিলম্ব করবে না, যখন প্রাণবায়ু কণ্ঠাগত হবে, আর তুমি বলতে থাকবে, অমুকের জন্য এতটুকু অমুকের জন্য এতটুকু। অথচ তা অমুকের জন্য হয়ে গেছে।’ (বুখারি-১৪১৯) তাই এখনই সময়, শীতার্ত মানুষের প্রতি সাহায্য ও সহানুভূতির হাত সম্প্রসারিত করা। পর্যাপ্ত পরিমাণে শীতবস্ত্র সরবরাহ করে সাধ্যমতো শীতার্তদের পাশে এসে দাঁড়ানো; নিঃস্বার্থভাবে বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্য ও সেবা করাই মানবধর্ম। এ মহৎ ও পুণ্যময় কাজই সর্বোত্তম ইবাদত।
অসহায় মানুষের দুর্দিনে সাহায্য, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মানসিকতা যাদের নেই, তাদের ইবাদত-বন্দেগি আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। সুতরাং সালাত-সিয়ামের সাথে কল্যাণের তথা মানবিকতা ও নৈতিকতার গুণাবলি অর্জন করাও জরুরি। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই। তবে পুণ্য আছে কেউ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, সব কিতাব ও নবীদের প্রতি ঈমান আনলে। আর আল্লাহপ্রেমে আত্মীয়স্বজন, এতিম-মিসকিন, মুসাফির, সাহায্য প্রার্থীদের ও দাসমুক্তির জন্য অর্থ দান করলে, সালাত প্রতিষ্ঠা করলে ও জাকাত প্রদান করলে। সর্বোপরি প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করলে, অর্থসঙ্কটে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম-সঙ্কটে ধৈর্য ধারণ করলে। এরাই তারা, যারা সত্যপরায়ণ এবং তারাই মুত্তাকি।’ (সূরা বাকারাহ-১৭৭)
এবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রমে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ব্যক্তি ও সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে দরিদ্র, অভাবী ও বস্ত্রহীন শীতার্ত মানুষকে সাধ্যানুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। এটিই মানব-মানবতা ও ইসলামের দাবি। লেখক : প্রভাষক, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা