রমজানের আর দুই মাস বাকি। বিশ্বাসীরা প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছেন সর্বোত্তম উপায়ে এই মাসের সময়কে ব্যবহার করার। মহান সৃষ্টিকর্তার অতুলনীয় নিয়ামত রমজানের আগমনীতে বিশ্বাসীরা ব্যস্ত কল্যাণ কামনায়। অপর দিকে, আরেক শ্রেণীর মানুষ খাতা-কলম নিয়ে বসে গেছেন এই রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে কিভাবে লাভের অংশ কতটুকু বাড়াবে তার হিসাব-নিকাশ করতে। বস্তুত এই শ্রেণীর মানুষ বরাবরই সুযোগ পেলেই কোনো নির্দিষ্ট সময়ে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম অভাব তৈরি করে সাধারণ মানুষের রক্ত শুষে নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাজারে ইতোমধ্যেই রমজানে ব্যবহৃত ভোজ্যপণ্যগুলোর দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে যেন রমজানের সময় বলা যায় দাম খুব একটা বাড়েনি।
বাজারে সবজির মৌসুমে সবজির গায়ে হাত দেয়া ভার। বেড়েছে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম। ক্রেতারা বাজারে গিয়ে হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। টিসিবির হিসাব মতে, ইতোমধ্যেই খোলা ও প্যাকেটজাত আটার দাম বেড়েছে কেজিতে পাঁচ টাকা। একইভাবে খোলা ও প্যাকেটজাত ময়দার দাম বাড়ানো হয়েছে কেজিতে পাঁচ টাকা। ছোলা ও মসুর ডাল ১০ টাকা কেজিতে বেড়েছে। ছোলা এখন ১০০ টাকা থেকে ১৪৫ টাকা কেজি প্রকারভেদে। দেশী পেঁয়াজ ১০-১৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৯০-১০০ টাকা কেজি, যা গত বছর এই সময় ছিল ৫০-৬০ টাকা কেজি। আদা বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা। সবচেয়ে দাম বেড়েছে মুগডালের; কেজিতে ২০-২৫ টাকা। বেড়েছে গরুর গোশতের দাম। ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের ক্যামেরা তৎপরতা এখন আর দেখা যায় না। চালের মৌসুমে বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম; যার কোনো যৌক্তিকতা নেই। বেড়েছে মুরগির দাম। আশঙ্কা করা হচ্ছে রমজানের শুরুতে আরো একদফা দাম বাড়ার।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে ডলার সঙ্কট, ঘনঘন মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার পরিবর্তন, উচ্চ আমদানি ব্যয় সব মিলিয়ে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সব কিছু বিবেচনায় রেখে রমজানে যেন দ্রব্যমূল্য স্থির থাকে এবং সরবরাহে কোনো ব্যত্যয় না ঘটে বাংলাদেশ ব্যাংক রমজানে নিত্য ব্যবহার্য ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর বাকিতে আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এরপর বাজারের অস্থিরতা কাম্য নয়। ব্যবসায়ীরা আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে যে যুক্তিগুলো দেখাচ্ছেন পৃথিবীজুড়ে এখন একই সমস্যার মোকাবেলা করছে প্রতিটি দেশ। এর পরও বেশির ভাগ দেশেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যের তত উল্লম্ফন ঘটেনি। আমাদের প্রতিবেশী দেশেও দ্রব্যমূল্য সাধারণের নাগালের ভেতর। বাংলাদেশে মূল্যবৃদ্ধির অন্তর্নিহিত একটি বড় কারণ সিন্ডিকেট। কয়েকটি কোম্পানির কাছে দেশের সব ব্যবসায় জিম্মি হয়ে রয়েছে। নিকট অতীতে তেল কেলেঙ্কারি, ডিম কেলেঙ্কারি, আলু কেলেঙ্কারি এবং সাম্প্রতিককালে পেঁয়াজ কেলেঙ্কারিতে এর প্রমাণ মেলে। এ ব্যাপারে ক্যাবের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, প্রতি বছরই রমজানের কয়েক মাস আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়ানো শুরু করেন কোনো যৌক্তিকতা ছাড়াই। শুধু নিজেদের লাভের অংশটিকে স্ফীত করার জন্য। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানবিক অনুভূতিও তারা হারিয়ে ফেলেন।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যাপারটি সম্যক অবগত আছেন। নির্দেশ দিয়েছেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার। মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, অতীতে যাই হোক না কেন, তার মন্ত্রণালয় ভোক্তা স্বার্থ দেখবে। কোনো রকম সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব তিনি দেখতে চান না। এসবই নিঃসন্দেহে ভোক্তাদের মনে আশা জাগাবে, সাহস জোগাবে। দেখে শুনে মনে হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরার জোরালো প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও বলা হয়েছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কথা। ভোক্তারা এর বাস্তবায়ন দেখতে চায়। অতীতের মতো শুধু আশ্বাসে আশ্বস্ত হতে চায় না।
এদিকে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও সরকারের বাজেট ব্যয় কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য। এর আগে যত বারই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে বা বাজার থেকে নিত্যপণ্য উধাও হয়েছে বিপদে পড়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। সিন্ডিকেটের রাঘববোয়ালদের লোমও স্পর্শ করা যায়নি; বরং তাদের প্রকারান্তরে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। বাজারে ঝটিকা অভিযানের নামে খুচরা ব্যবসায়ীদের ধরা হয়েছে, জরিমানা করা হয়েছে। আমদানির অনুমতি দিয়ে একদিকে অস্থায়ীভাবে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে, অপর দিকে সিন্ডিকেটের কাছেই আমদানির অনুমতি দিয়ে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করা হয়েছে। আমদানি নিশ্চয়ই কোনো সমস্যার একক সমাধান নয়। প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ানো এবং সার্বক্ষণিক তদারকি। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা। খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ী সংগঠনের সমন্বয়ে শক্তিশালী টাস্কফোর্স তৈরি করা দরকার। টাস্কফোর্স বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সঠিক চাহিদা ও স্থিতি নিরূপণ করবে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি বন্ধ করার জন্য কাজ করবে। দেশে বিদ্যমান সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও তার সুরক্ষায় কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের চেষ্টা করবে এবং বিদ্যমান আইনের সঠিক ও সর্বাত্মক ব্যবহার নিশ্চিত করবে। কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও আইনের যথার্থ প্রয়োগেই সম্ভব দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। সাথে প্রয়োজন ব্যবসায়ীদের মানবিক চেতনার বিকাশ। লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ Email-shah.b.islam@gmail.com