মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০৫ পূর্বাহ্ন

‘প্রেমিকের প্ররোচনাতেই’ রুম্পার আত্মহত্যা

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

প্রেমিক আব্দুর রহমান সৈকতের প্ররোচনাতেই স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পা আত্মহত্যা করেছিলেন। সৈকতকে অভিযুক্ত করেই সম্প্রতি আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. সালাহ উদ্দিন কাদের। চার্জশিটে বলা হয়েছে, রুবাইয়াত শারমিন রুম্পাকে কেউ হত্যা করেছেনÍ এমন কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তার সম্ভ্রমহানি হয়েছেÍ এমন সুস্পষ্ট কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণও পাওয়া যায়নি। তবে প্রেমঘটিত কারণে ‘অমানবিক আচরণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে’, ‘প্ররোচনা পেয়ে’ রুম্পা নিজেই ভবন থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্ত সূত্র বলছে, রুম্পা ও সৈকতের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। একসময় তাদের ওই সম্পর্কে ফাটল ধরে। সম্পর্কের টানাপোড়েনে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। সৈকত রুম্পার কথার কোনও গুরুত্ব দিতো না, মানসিকভাবে নির্যাতন করতো। সৈকতের এসব আচরণের কারণেই মেয়েটি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
রাজধানীর শান্তিবাগে একটি ফ্ল্যাটে মায়ের সঙ্গে থেকে লেখাপড়া করতেন রুবাইয়াত শারমিন রুম্পা। পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনিও করতেন তিনি। ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর ঘটনার দিন সন্ধ্যার আগে বাসা থেকে টিউশনিতে যান ওই শিক্ষার্থী। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শান্তিবাগের বাসার নিচে এসে ফোন করে পুরোনো এক জোড়া স্যান্ডেল পাঠিয়ে দিতে বলেন। কথামতো ক্লাস টু-তে পড়ুয়া তার চাচাতো ভাই স্যান্ডেল নিয়ে বাসার নিচে যায়। এরপর রুম্পা পুরোনো স্যান্ডেল পরেন। এরপর কানের দুল, আংটি, মোবাইল ফোন আর পরনের জুতা চাচাতো ভাইয়ের কাছে দিয়ে আবার বেরিয়ে যান।
এর কয়েক ঘণ্টা পর সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডে ‘৬৪/৪’ নম্বর বাসার নিচে তার মরদেহ পায় পুলিশ। তখনও টের পায়নি তার পরিবার সদস্যরা। ওদিন রাতে বাসায় না ফেরায় এবং কাছে ফোন না থাকায় পরিবারের সদস্যদের রাত কাটে উদ্বেগের মধ্যে। পরদিন সন্ধ্যায় তারা রমনা থানায় গিয়ে ছবি দেখে রুম্পার মরদেহ শনাক্ত করেন। এ ঘটনার পুলিশ কর্মকর্তা বাবা রুকন উদ্দিন ও মা নাহিদা আক্তার মেয়ের মৃত্যুকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড দাবি করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করে সুষ্ঠু বিচার চেয়েছিলেন। একই দাবি করেছিলেন রুম্পার প্রতিবেশী ও সহপাঠীরা। এইসময় রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূম্পা হত্যার বিচার চেয়ে মানববন্ধন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা।
ঘটনাটি রহস্যজনক হওয়ায় ডিএমপির রমনা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল খায়ের সেই রাতেই অজ্ঞাতপরিচয়ের আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এছাড়া ঘটনার পরের দিন সকালে রুম্পার বাবা পুলিশ পরিদর্শক রুকন উদ্দিন মর্গে বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে রমনা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই সময় রুম্পার স্বজনরা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা অভিযোগ করে বলেছিলেন, রুম্পা হত্যার সঙ্গে তার বয়ফ্রেন্ড সৈকত জড়িত থাকতে পারে।
তারা জানান, কিছুদিন ধরে সৈকতের সঙ্গে রুম্পার সম্পর্কের অবনতি হয়। বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ায় রুম্পাকে এড়িয়ে চলছিল সৈকত। রুম্পার বয়ফ্রেন্ড সৈকত জড়িত থাকার অভিযোগেসহ সহপাঠী-বন্ধু বা পারিবারিক কোনও শত্রুতা কাজ করেছিল কিনা হত্যাকাণ্ডে সে বিষয়গুলো মাথায় রেখেই তদন্ত করছিল পুলিশ। তদন্ত সূত্র ধরেই ঘটনার চার দিন পর ৮ ডিসেম্বর আব্দুর রহমান সৈকত নামে তার ওই বন্ধুকে গ্রেফতার দেখায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদনের জন্য তাকে আদালতে পাঠালে আদালত তখন সৈকতের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
ডিবি সূত্রে জানা গেছে, সৈকতের সঙ্গে রুম্পার বন্ধুত্ব ছিল। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায়। এরপর রুম্পা বহুবার সৈকতের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। ঘটনার দিনও সৈকতের সঙ্গে রুম্পার দেখা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সৈকতের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

রুম্পার হত্যার ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির রমনার জোনাল টিমের পরিদর্শক শাহ মো. আকতারুজ্জামান ইলিয়াস ঘটনার প্রাথমিক তদন্তের বিষয়ে আদালতকে জানিয়েছিলেন, রুম্পা ও সৈকতের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু দিন দিন তাদের সম্পর্কে অবনতি ঘটে। ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর বিকালে তারা স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে দেখা করেন। তখন কোনও যৌক্তিক কারণ ছাড়াই সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলেন সৈকত। রুম্পা বারবার অনুরোধ করলেও সৈকত সম্পর্ক রাখতে রাজি হচ্ছিলেন না। এ নিয়ে দুজনের মনোমালিন্য ও বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এর জের ধরে ওই দিন রাত পৌনে ১১টায় সৈকত তার কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে রুম্পাকে সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িটির ছাদে নিয়ে যান। এক পর্যায়ে রুম্পাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেন। এটাই প্রাথমিকভাবে জোর সন্দেহ করা হচ্ছিল। এ কারণে তাকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়।
পরবর্তী সময়ে এই হত্যার ঘটনার তদন্তে ডিবির আরেকজন এসআই মো. সালাহ উদ্দিন কাদের দায়িত্ব পান। দীর্ঘদিন তদন্ত শেষে প্রেমিকের প্ররোচনায় আত্মহত্যা করেছে এমন অভিযোগ এনে এই তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলাটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা মো. সালাহ উদ্দিন কাদের বলেন, ‘ঘটনার দিন যখন বাসার নিচে এসে ছোট ভাইয়ের কাছে কানের দুল, আংটি ও মোবাইল ফোন রেখে পুরানো একজোড়া স্যান্ডেল নিয়ে যান রূম্পা। এসময় রুম্পার মা নামাজ পড়ছিলেন। নিচতলা তাদের আরেকজন প্রতিবেশী নারী তখন তাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুমে এসে একটু বসে যেতে বলেছিলেন। তবে রুম্পা রুমের ভেতরে যাননি। তিনি দেরি করেননি। দ্রুত স্থান ত্যাগ করে চলে যান।’
তিনি আরও বলেন, ‘রুম্পা ও সৈকতের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। একসময় ওই সম্পর্কের ফাটল ধরে। বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। সৈকত রুম্পার কথার কোন গুরুত্ব দিতো না। মানসিকভাবে টর্চার করতো। সৈকতের এসব প্ররোচনার কারণেই মেয়েটি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।’
গ্রেফতারের পর সৈকত কারাগারে ছিল। পরে জামিন নিয়ে বের হয়ে এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন চূড়ান্ত রায় হলে তার শাস্তি কী হবে, এটি রায়ের পর জানা যাবে।’ এদিকে একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে এখনও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছেন মৃত রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার বাবা পুলিশ কর্মকর্তা রুকন উদ্দিন। মামলার চূড়ান্ত রায় প্রকাশ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি। রুকন উদ্দিন বলেন, ‘যেহেতু চার্জশিট জমা দিয়েছে, এটি না দেখে আমি এখনই কিছু বলতে পারবো না। তবে চার্জশিট তদন্তে যদি অসন্তুষ্ট হওয়ার মতো কিছু থাকে তাহলে আমি নারাজি আবেদন করবো।’ মৃত রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার গ্রামের ময়মনসিংহে দুই ভাইবোনের মধ্যে রুম্পা ছিলেন বড়। বাবা রুকন উদ্দিন বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা এসবিতে (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) দায়িত্ব পালন করছেন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com