শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ১০:৪৯ অপরাহ্ন

জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া)

॥ ড. আাহসান হাবীব ইমরোজ॥
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪
জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া)

॥ ড. আাহসান হাবীব ইমরোজ ॥
১৮৭১ সালে ১লা রমজান চাঁদের কান্তি নিয়ে জন্মেছিলেন বলেই দাদি তার নাম দিয়েছিলেন চাঁদ মিয়া। পূর্নাঙ্গ নাম ওয়াজেদ আলী খান পন্নী । পিতা ছিলেন সুপন্ডিত (অন্ধ অথচ কুরআনের হাফেয) মাহমুদ আলী খান পন্নী। তিনি গৃহশিকদের কাছে আরবি, ফার্সি, উর্দু, বাংলা ও ইংরেজি এ পাঁচটি ভাষায় বিশেষ দক্ষতা লাভ করেন। তিনি ছিলেন বঙ্গভঙ্গের জন্য গঠিত মোহামেডান প্রভিন্সিয়াল ইউনিয়নের সহসভাপতি, লর্ড কার্জনের বিদায়সম্ভাষণ সভার সভাপতি, প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি। করটিয়া হাইস্কুল, সা’দত কলেজ প্রতিষ্ঠা তার অবিস্মরণীয় কীর্তি। তিনি যে ওয়াক্ফ দলিল করেন তাতে শিক্ষা ও সংস্কারের জন্য তার বার্ষিক দানের পরিমাণ বর্তমানের প্রায় এক কোটি টাকা।
কবি গোলাম মোস্তফা তাকে বলেছেন, ‘বাংলার দ্বিতীয় মুহসীন।
প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ চাঁদ মিয়াকে জেলখানায় দেখতে গিয়ে বলেছেন, ‘এই লোহার কপাটটি সামনে না থাকলে আজ পায়ের তার ধুলা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরতাম।’
সাবেক মূখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান বলেছিলেন, ‘তার মতো লোক বিরল। তিনি সর্বভারতীয় পর্যায়ের নেতা ছিলেন।’
সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘তিনি নিজেকে রিক্ত করিয়া তাহার সর্বস্ব জনহিতকর কাজে ব্যয় করিয়াছেন।’
ড. আবদুল্লাহ বলেন, ‘তিনিই সম্ভবত একমাত্র জমিদার যার ভাগ্যে জুটেছিল দীর্ঘ দিনের কারাবরণ।’
লন্ডন মিউজিয়ামে চাঁদ মিয়ার তৈলচিত্রের নিচে লেখা আছে, “”One who defied the British.” মওলানা ভাসানী বলেন, ‘জমিদাররা যদি সবাই চাঁদ মিয়ার মতো হতো তবে কখনোই জমিদারবিরোধী আন্দোলন করতাম না।’
বাংলা-বিহার-আসাম-উড়িষ্যার শাসনকর্তা দাউদ খান,সোলয়ামান খান কররানীদের সুযোগ্য বংশধর হচ্ছে করটিয়ার পন্নী পরিবার । ৪০০ বছর আগের আতিয়া মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা সাঈদ খান পন্নীর সুযোগ্য উত্তরসূরী হলেন সা’দত আলী খান পন্নী। তার সন্তান হাফিয মাহমুদ আলী খান পন্নী ।
তারই সুযোগ্য নেতৃত্বে ১৪০ বছর আগে ১৮৮৪ সালে এই করটিয়ায় বৃহত্তর মোমেনশাহীর প্রথম মাসিক পত্রিকা ‘আখবারে ইসলামিয়া’ প্রকাশ হতো নিজস্ব প্রেস করটিয়ার মাহমুদিয়া প্রেস হতে। এবং ভারতবর্ষের তৎকালীন রাজধানী কলকাতার সাথে পাল্লা দিয়ে সেটি চলতো।
কুরআন শরীফের প্রথম বাংলা অনুবাদক মৌলভী নঈমুদ্দীন যাকে সে যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম বলা হতো । তার কুরআনের অনুবাদসহ প্রায় ৩৭টি বইয়ের শুভ সূচনা হয় করটিয়ার মাহমুদিয়া প্রেস হতে সা’দত আলী খান এবং হাফেজ মাহমুদের তদারকীতে । ১৯১৩ সালে চাঁদ মিয়ার আয়োজনে এবং স্যার সলিমুল্লাহর সভাপতিত্বে এই করটিয়াতে অনুষ্ঠিত হয় সমগ্র ভারতের মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স। এই করটিয়ার নামদার কুমুল্লি খানপাড়া গ্রামের ফজিলাতুন্নেসা ১৯২৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ে থেকে গণিতে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯২৮ সালে গণিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য লন্ডনে গমন করেন। নিখিল বঙ্গে তিনিই প্রথম মুসলিম মহিলা গ্রাজুয়েট। আটিয়ার চাঁদ ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর সার্বিক সহযোগিতা ও প্রেরণায় প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খা তার যৌবনের ২৮টি বছর এবং সমগ্র জীবনের (৮৪) একতৃতীয়াংশ সময় কাটিয়েছেন করটিয়ার এই কাদামাটির ভিতর বাড়ি বাড়ি গিয়ে চা-মুড়ি খেয়ে সত্যিকার মানুষ গড়তে ।
এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা,বিহার,আসাম, উড়িষ্যার প্রথম মুসলিম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলেজ সা’দত কলেজ আর এতে প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল হিসেবে প্রায় ২২ বছর দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খা ।
যিনি তার কর্মদক্ষতায় পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাবোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে অভিষিক্ত হন (১৯৪৮-৫২)।
চাঁদ মিয়ার প্রতিষ্ঠিত এবং প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খা পরিচালিত এই সা’দত কলেজ হতে বাংলাদেশের সাবেক উপরাষ্ট্রপতি ড. এম এন হুদা,আওয়ামী মুসলিমলীগের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী জেনারেল শামসুল হক ,বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ,সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান,শাহজাহান সিরাজ.আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীসহ ১০জনের মতো মন্ত্রী এবং ৪০ এর অধিক এমপি বের হয়েছে।
পাশাপাশি শিক্ষা-সাহিত্য ক্ষেত্রে ড. আশরাফ সিদ্দিকী,ড. আবদল্লাহ, ড. আব্দুস সাত্তার,কবি তালিম হোসেন প্রমূখ। চাঁদ মিয়া এতটা জনপ্রিয় ছিলেন যে, বৃটিশ সরকার তাকে গ্রেফতারের সময় ১৭ ডিসেম্বর ১৯২১ সালে টাঙ্গাইলে প্রায় ১০ হাজার বিক্ষুব্ধ লোক এবং মোমেনশাহী স্টেশনে প্রায় ৩০ হাজার লোক একত্র হয়েছিল। তাকে গ্রেফতারকারী দু’জন পুলিশ চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিল।
১৯৩৬ সালের ২৫ এপ্রিল ৮৮ বৎসর আগে আজকের এই দিনে তার মৃত্যুর পর করটিয়ার মতো এক নিভৃত গ্রামে প্রায় ১০-১২ হাজার লোক নামাজে জানাজায় শামিল হয়েছিল। এনে পড়ে জাগৃতির কবি ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর সেই আক্ষেপ;
‘‘দেখ একবার ইতিহাস খুলি
কত উচ্চে তোরা অধিষ্ঠিত ছিলি,
তথা হতে হায়! কেন রে পড়িলি?
নয়ন মেলিয়া দেখ একবার।’’
আমরা সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে আজ ভুলতে বসেছি। কিন্তু সেই স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস এবং মহান পুরুষদের শিক্ষা ও সংগ্রামই আমাদের এলাকা এমনকি দেশ ও জাতীর নবজাগরণ আনতে পারে। লেখক: গবেষক।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com