সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে প্রায় এক যুগ পর জগুনা বিবি(৭০) নামের এক বৃদ্ধাকে ফিরে পেলেন তার পরিবার। মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) দিবাগত রাত ১২টার পরে সুদুর ইন্ডিয়ার কলকাতা থেকে যশোর বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে জাজিরা উপজেলার ডেঙ্গর বেপারী কান্দি নিজ বাড়িতে পৌছান তিনি। জগুনা বিবির পরিবার সুত্রে জানা যায়, ১৯৭৬ সালে বিয়ে হয় জাজিরা ইউনিয়নের ডেঙ্গর বেপারী কান্দির লালমিয়া বেপারী ও জগুনা বিবি দম্পতির।এরপর দুজনের একসাথে কেটে যায় কয়েক যুগ।তাদের ঘর আলোকিত করে আসে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলেমেয়ে বড় হওয়ার পর যগুনা বিবি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। তখন থেকে কাউকে কিছু না বলে মাঝেমধ্যেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতেন। পরিবারের লোকজন বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। এরপর ২০১১ সালে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন। স্বজনরা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর কোনো সন্ধান না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। এর পর কেটে যায় একযুগ। গত রমজানে জাজিরা উপজেলার মাসুদ রানা নামের এক যুবকের ফেসবুক আইডিতে কমেন্ট করেন কলকাতার মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী আজিজুল শেখ। তার কাছে প্রায় একযুগ ধরে জাজিরার একজন বৃদ্ধা আছে সেই খবর দেন মাসুদ রানাকে। এরপর মাসুদ রানা ‘প্রাণের জাজিরা’ একটি নামক ফেসবুক গ্রুপে জগুনা বিবিকে নিয়ে একটি পোস্ট দেন। সেখান থেকেই খোঁজ মিলে জগুনা বিবির পরিবারের। এরপর তারা কলকাতার আজিজুল শেখের সাথে যোগাযোগ করে গত ৩০ এপ্রিল জগুনা বিবিকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। জগুনা বিবিকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া যুবক মাসুদ রানা বলেন, আমার ফেসবুকের একটি পোস্টে আজিজুল শেখ নামের একজন কমেন্ট করেন। তারপর তার সাথে হোয়াটসএ্যাপে কথা হয়। তিনি কলকাতার বাসিন্দা। জানতে পারি তার কাছে জগুনা বিবি নামের একজন বৃদ্ধা আছে। এরপর তার সাথে কথা বলে সমস্ত তথ্য নিয়ে ‘প্রাণের জাজিরা’ নামক ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট দেই। সেখান থেকেই জগুনা বিবির পরিবার আমার সাথে যোগাযোগ করে। এরপর তাদের সাথে কলকাতার আজিজুল শেখের সাথে কথা বলিয়ে দেই। এ ব্যাপারে কথা হয় দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ফেদেরগঞ্জ থানার বিজয়ভাটি গ্রামের সোলাইমান শেখের ছেলে আশ্রয়দাতা আজিজুল শেখের সাথে। তিনি বলেন, ‘ গত ৮ বছর আগে আমার দোকানের সামনে জগুনা বিবিকে ভারসাম্যহীন ও অসুস্থ্য অবস্থায় পাই এবং তাকে বাড়িতে নিয়ে যাই। আজিজুল শেখ আরও বলেন, এই বুড়িমার চেহারার সাথে আমার মৃত দাদীর চেহারার মিল থাকায় আমি ও আমার পরিবার এবং আমার প্রতিবেশি নওশাদ আলী শেখ ও তার পরিবার দেখাশোনা ও সেবা যতœ করি। এরপর গত ৪ মাস আগে তিনি বড় ধরণের একটি স্ট্রোক করেন। ভাবিনি তিনি বেঁচে ফিরবেন। তবে আল্লাহর বিশেষ রহমতে তিনি সুস্থ হোন। কিন্তু তিনি সুস্থ হওয়ার পর আমাদের কাউকেই আর চিনতে পারছিলেন না। তিনি তার ছেলে-মেয়ে ও আগের বাসস্থানের কথা বলতে থাকেন এবং সেখানে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় আমি তার বলা ঠিকানা সহ তথ্য দিয়ে ফেসবুকের মাধ্যমে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার মাসুদ নামে এক তরুণের সাথে যোগাযোগ করে বিস্তারিত জানালে তিনি এই বুড়িমার পরিবারের সাথে আমাকে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। পরে আমরা তার সকল তথ্য উপাত্ত দিয়ে বাংলাদেশ হাই কমিশনের কাছে আবেদন করলে অনুমতি পাওয়ার পর বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে তার পরিবারের কাছে পাঠাতে সক্ষম হই। আজিজুল শেখ বিস্তারিত জানানো শেষে আবেগ আপ্লুত হয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, এই বুড়িমা আমাদের সাথে অনেকদিন থাকার কারনে তার প্রতি অনেক মায়া জন্মেছে। আমার পরিবারের ছোটবড় সকলে তাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু সে তার পরিবারের কথা মনে পড়ার পর থেকে পরিবারের সাথে দেখা করতে চাচ্ছিলেন। তাই আর ধরে রাখতে পারলাম না। তবে অনেক ভালো লাগছে একজন শেষ বয়সী মানুষকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে। আল্লাহ তাকে সবসময় সুস্থ রাখুক। আমরা শিঘ্রই তার সাথে দেখা করতে যাবো। জগুনা বিবির স্বামী লালমিয়া বেপারী বলেন, ‘আমার স্ত্রী হারিয়ে যাওয়ার পর আমরাসহ আমাদের আত্মীয় স্বজন সকলেই বিভিন্ন স্থানে তন্নতন্ন করে খুজেছি। একপর্যায়ে তাকে খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আল্লাহর রহমতে আমরা তাকে আবারো খুঁজে পেয়েছি। আপনারা সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন। এ ব্যাপারে জগুনা বিবির ছেলে জয়নাল বেপারী বলেন, ‘মা নিখোঁজ হওয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। অনেক দিন পর মাকে খুঁজে পেয়ে আমরা ভাইবোন ও আমাদের ছেলেমেয়েরা সবাই খুব খুশি। সবার দোয়া চাই, সেবাযতœ করে যেন মাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে পারি।’ জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া ইসলাম লুনা বলেন, এটি অত্যন্ত খুশির সংবাদ। জগুনা বিবি যদি অসুস্থ্য থাকেন প্রয়োজনে আমরা তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো। তাকে এবং তার পরিবারকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।