সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩২ পূর্বাহ্ন

প্রতিষ্ঠাতাদের স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ আওয়ামী লীগের পতন

॥ হারুন ইবনে শাহাদাত ॥
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০২৪

গতকাল সোমবার ৫ আগস্ট। বাঙালি জাতির স্মরণীয় একটি দিন। টানা ১৫ বছর পর আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনের অপসান হলো। কোটা আন্দোলনের জেরে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন ১৫ পনর বছরের বিনা ভোটের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। এএফপির খবরে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা গণভবন থেকে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। নির্বাচন বিশ্লেষক ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দেশে আজকে যা ঘটল, এটাই হওয়ার কথা ছিল। গণ-অভ্যুত্থান কখনো ঠেকানো যায় না। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন সহজেই সমাধান করা যেত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জেদের কারণে এত মানুষ মারা গেল। গণমাধ্যমে প্রাণহানির যে চিত্র উঠে এসেছে, বাস্তবে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। আরও কত মরদেহ কোথায় পড়ে আছে, কত গণকবর হয়েছে, কতগুলো নিরীহ মানুষের প্রাণ ঝরেছে! তিনি তো চলে গেলেন। এখন এর জবাব দেবে কে? তিনি আরো বলেন, ১৫ বছর মানুষ ভোট দিতে পারেননি। দিনের পর দিন ভোট চুরি করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শেখ হাসিনার বোঝা উচিত ছিল, তিনি ও তাঁর দল কতটা অজনপ্রিয়। এই যে এত প্রাণহানি, এর জবাব দেবে কে? দেশে সুশাসনের মারাত্মক অভাব। তিনি সুশাসন দিতে পারেননি। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের ওপর হাজার হাজার গুলি ছোড়া হয়েছে। হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে। এর আগে আমরা সবাই এইচ এম এরশাদকে স্বৈরাচার বলেছি। তখন মাত্র ছয়জন মানুষ মারা যাওয়ায় তাঁকে স্বৈরশাসক বলছি। কিন্তু গত ১৫ বছরে কত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।
২০০৯ সালে পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা মারা গেছেন। এখন এর জবাব দেবে কে? যাঁকে জাতির পিতা বলা হয়, তাঁর পরিবারের সদস্যদের এত করুণ পরিণতি কেন হবে? তাঁর এমন পরিণতি আমাদের দেখতে হলো। এসব হয়েছে, তাঁর দম্ভ ও অহমিকার কারণে। প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, দেশে সুশাসন নিশ্চিত করেন। বিভিন্ন সভা–সেমিনারে বলেছি। যা হচ্ছে, তা স্বৈরতন্ত্র। এসব বলার কারণে আমাদের ভিন্ন দলের এজেন্ট বলা হতো। এই যে গণভবন লুটপাট হচ্ছে, ভাঙচুর হচ্ছেএ জন্য জনগণকে দোষ দেবেন কীভাবে?
শ্রীলঙ্কা থেকে হাসিনার সরকার শিক্ষা নেয়নি। তিউনিসিয়া থেকে শিক্ষা নেয়নি। মিসরে কীভাবে হোসনে মোবারক জনরোষে উড়ে গেছে, সেখান থেকে সরকার শিক্ষা নেয়নি। জনগণের সরকার না হলে এমন পরিণতি হয়।
এরশাদের চেয়ে শেখ হাসিনা ১০০ গুণ বেশি খারাপ হয়ে বিদায় নিয়েছেন। এরশাদ পালিয়ে যাননি। তিনি পালিয়ে গেছেন। তিনি পালিয়ে গেছেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ দলটাকে ধ্বংস করে দিয়ে গেলেন। তাঁর হিংসা, দম্ভ, অহংকার দলটাকে ধ্বংস করল।
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের স্বপ্ন ছিল ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা: শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য , বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের স্বপ্ন ছিল এই ভূ-খন্ডে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ ইসলামী আদর্শের আলোকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েম করা। দলটির বর্তমান অবস্থা এবং বাঁক বদল দেখলে মনে হয়, অসীম আকাশে ছুটতে ছুটতে অনেক তারা যেমন হঠাৎ জ্বলে ওঠে হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া ঐ তারকাগুলোর নামও বদলে যায়। তখন আর তাদের তারা বলা হয় না, বলা হয় উল্কা। শুধু আকাশে নয়, এই মাঠির পৃথিবীতেও এমন ঘটনা ঘটে। যেমন দেশের বর্তমান শাসক দল আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে ঘটেছে। এই দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। তিনি এবং তাঁর সাথে যাঁরা এই রাজনৈতিক দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাদের স্বপ্ন ছিলো ইসলামের সুমহান রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে এই ভূ-খন্ডে একটি কল্যাণরাষ্ট্র বা ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। তাঁদের সেই চিন্তার আলোকেই প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকালে ‘মূল দাবী’ নামে ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুনে অনুষ্ঠিত পূর্ব পকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সম্মেলনে একটি ম্যানিফেস্টো (ঘোষণাপত্র) উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি অখ- পাকিস্তান ( বর্তমান বাংলাদেশ ও পাকিস্তান)-এর মুসলিম,হিন্দু, খ্রিস্টান,বৌদ্ধসহ সব ধর্মবর্ণের মানুষের জন্য যে কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নে শরীক হয়েছিলেন অন্যান্য নেতারাও। তাঁদের সেই স্বপ্নের রাষ্ট্রের যে বৈশিষ্ট্য দলটির প্রথম ম্যানিফেস্টোতে উল্লেখ্য করা হয়েছিল, তা হলো:
১. পকিস্তান খেলাফত অথবা ইউনিয়ন অব পাকিস্তান রিপাবলিক ব্রিটিশ কমনওয়েলথের বাইরে একটি সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র হইবে।
২. পাকিস্তানের ইউনিটগুলিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার দিতে হইবে।
৩. রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আল্লাহর প্রতিভূ হিসেবে জনগণের ওপর ন্যস্ত থাকিবে।
৪.গঠনতন্ত্র হইবে নীতিতে ইসলামী গণতান্ত্রিক ও আকারে রিপাবলিকান। (সূত্র: স্বাধিকার আন্দোলন ও শামসুল হক পৃষ্ঠা-৫৮, লেখক: মোহাম্মদ হুমায়ুন করীর)
শামসুল হকদের গড়া সেই রাজনৈতিক দলের নাম বদল এখন হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বর্তমান রাজনৈতিক দর্শনের সাথেও প্রতিষ্ঠাকালীন দর্শনের কোন মিল নেই। বলা যায় পুরোটাই বদলে গেছে। যদিও দলটির বর্তমান নেতারা মদিনা সনদের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা মুখে বললেন। কিন্তু তারা খেলাফত কিংবা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা শুনতেই নারাজ। কারণ তাদের বর্তমান সব প্রচেষ্টা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে রাজনীতি থেকে ইসলামকে দূরে রাখা। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠাতাদের সেই দর্শন থেকে যোজন যোজন দূরে চলে গেছেন। তাঁদের অবদানের স্বীকৃতিও তাদের পক্ষ থেকে খুব একটা দেয়া হচ্ছে এমনটাও মনে হয় না। অথচ উপমহাদেশের অন্যতম মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর জাতীয় দৈনিক বণিকবার্তার সাথে এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন রাজনীতিতে শামসুল হকের অবদান প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘দেশভাগের আগে ও পরের কয়েক বছর পূর্ববঙ্গে যে আন্দোলন হচ্ছিল তাতে শামসুল হক একদম প্রথম সারির শুধু নয়, প্রথম ব্যক্তি ছিলেন বলা যায়। মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতা ও বুদ্ধিজীবী আবুল হাশিমের (বদরুদ্দীন উমরের বাবা) বড় প্রভাব ছিল তার ওপর। ১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন শামসুল হক। সে বছরই আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, দলের প্রথম ম্যানিফেস্টো তার হাতেই রচিত। ভাষা আন্দোলনের সব পর্বেই শামসুল হক ছিলেন প্রথম সারিতে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু আমতলায় ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিল। তখন শামসুল হক বললেন, যেহেতু সর্বসম্মতিক্রমে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সুতরাং আমিও এর সঙ্গে একমত।’
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ও শামসুল হক প্রণীত ‘মূল দাবী’ পরবর্তীতে ম্যানিফেস্টোতে স্থান দেয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে একটি নিবন্ধে লিখেছেন,‘মুসলিম লীগের বিশ্বাসঘাতকতা, অঙ্গীকার ভঙ্গ, দুঃশাসন এবং ভিন্নমতের কণ্ঠরোধের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের জন্ম। জন্মলগ্নে, ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন আওয়ামী লীগের প্রথম সম্মেলনে গৃহীত খসড়া ঘোষণাপত্রে ‘মূল দাবি’তে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানের দুই ইউনিটের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেছিল। সম্মেলনে গৃহীত ১২ দফা: “১. পাকিস্তান একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হবে। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হবে জনসাধারণ। ২. রাষ্ট্রে দুটি আঞ্চলিক ইউনিট থাকবে পূর্ব ও পশ্চিম। ৩. অঞ্চলগুলো লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। প্রতিরক্ষা-বৈদেশিক সম্পর্ক ও মুদ্রা ব্যবস্থা কেন্দ্রের হাতে থাকবে এবং অন্য সকল বিষয় ইউনিটগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে।
৪. সরকারী পদাধিকারী ব্যক্তিরা কোন বিশেষ সুবিধা বা অধিকারভোগী হবেন না কিংবা প্রয়োজনাতিরিক্ত বেতন বা ভাতার অধিকারী হবেন না। ৫. সরকারী কর্মচারীরা সমালোচনার অধীন হবেন, কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থতার জন্য তাদের পদচ্যুত করা যাবে এবং অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে তাদের ছোটখাটো বা বড় রকমের সাজা দেয়া যাবে। আদালতে তারা কোন বিশেষ সুবিধার অধিকারী হবেন না। কিংবা আইনের চোখে তাদের প্রতি কোনরূপ পক্ষপাত প্রদর্শন করা হবে না। ৬. জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবেনÑ যথা বাকস্বাধীনতা, দল গঠনের স্বাধীনতা, অবাধ গতিবিধি ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের অধিকার। ৭. সকল নাগরিকের যোগ্যতানুসারে বৃত্তি অবলম্বনের অধিকার থাকবে এবং তাদের যথাযোগ্য পারিশ্রমিক দেয়া হবে। ৮. সকল পুরুষ ও নারীর জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে। ৯. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোতে সকল নাগরিকের যোগদানের অধিকার থাকবে। একটি বিশেষ বয়সসীমা পর্যন্ত সকলের জন্য সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নিজস্ব স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর ইউনিট গঠন করা হবে। ১০. মৌলিক মানবিক অধিকারসমূহ দেয়া হবে এবং কোন অবস্থাতেই কাউকে বিনা বিচারে আটক রাখা হবে না। বিনা বিচারে কাউকে দন্ডদান বা নিধন করা হবে না। ১১. বিনা খেসারতে জমিদারী ও অন্য সকল মধ্যস্বত্ব বিলোপ করা হবে। সকল আবাদযোগ্য জমি পুনর্বণ্টন করা হবে। ১২. সকল জমি জাতীয়করণ করা হবে।
সামাজিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে খসড়া ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, ভূমি সংস্কার বিনা খেসারতে জমিদারি উচ্ছেদ এবং প্রকৃত কৃষকদের মধ্যে জমি বণ্টন, যৌথ খামার ও সমবায় ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সকল শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ, শিল্প-কারখানা পরিচালনায় শ্রমিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ, শ্রমিকদের সন্তানদের বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা এবং তাদের ধর্মঘটের অধিকার প্রভৃতি।
এছাড়া দেশের শিল্পায়ন, শিক্ষার বিস্তার ও নারীর অধিকারের কথাও প্রথম ঘোষণাপত্রে লিপিবদ্ধ ছিল। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, প্রথম ঘোষণাপত্রের ২২ দফা আশু কর্মসূচির ১৮নং দফায় আওয়ামী লীগ ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ এবং ১৯নং দফায় “আগামী তিন মাসের ভিতরে জাতিসংঘ গণভোট দ্বারা কাশ্মীর সমস্যার সমাধান না করিলে পাকিস্তান কর্তৃক জাতিসংঘ ত্যাগ।”-এর ঘোষণা দিয়েছিল।’ তিনিও তাঁর নিবন্ধে স্বীকার করেছেন,‘এই সম্মেলনে শামসুল হকের ১২-দফা মূল দাবি গৃহীত হয়। পরবর্তীতে খসড়া ম্যানিফেস্টো রচিত হয়।’ অবশ্য ম্যানিফেস্টোতে তখনকার বাস্তবতায় ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করার তিনি নিজের মতো করে একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন,‘ ম্যানিফেস্টোতে তখনকার বাস্তবতায় ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অপপ্রচারের মুখ বন্ধ করার কৌশল হিসেবে। আওয়ামী লীগকে যাতে ইসলাম-বিরোধী, পাকিস্তান-বিরোধী এবং ভারতের দালাল হিসেবে প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে না পারে সে জন্য এই রক্ষণশীল এবং প্রগতিবিরোধী লক্ষ্য কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।’ তাঁর এই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে, খন্দকার আবদুল হামিদ ¯পষ্টভাষীর সেই বিখ্যাত উক্তি‘ … তোমারই নাম আওয়ামী লীগ।’ অর্থাৎ জনগণকে ভোলাতে তারা,‘ মুখে শেখ ফরিদ ও বদলে ইট’ এই নীতি অনুসারে নজিরবিহীন ।
সত্যি কী ইউটোপিয়া
নূহ-উল-আলম লেনিন তাঁর মতের পক্ষে যুক্তি দিয়ে লিখেছেন,‘ কিন্তু এই একই ম্যানিফেস্টোতেই আবার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষিত হয়। সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকারের ঘোষণাও দেওয়া হয়।
নবগঠিত আওয়ামী লীগের নেতাদের ধারণা ছিল ব্রিটিশ কমনওয়েলথ-এর সদস্য থাকা মানে দেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জিত না হওয়া। সে জন্যই কমনওয়েলথের প্রশ্নে সম্পর্কোচ্ছেদের ঘোষণা দেওয়া হয়। অন্যদিকে কাশ্মীর ইস্যুটি তখন পাকিস্তানের উভয় অংশের মানুষের কাছে খুবই আবেগ ও স্পর্শকাতর বিষয় ছিল। আওয়ামী লীগ তাই আগ বাড়িয়ে তিন মাসের আলটিমেটাম দিয়ে জাতিসংঘ ত্যাগের হুমকি দেয়। এসব দাবিই ছিল তখনকার বাস্তবতায় জনগণের মনোস্তত্ত্বকে তুষ্ট করার কৌশল। তবে ম্যানিফেস্টোতে ভূমি সংস্কার ও বিনা খেসারতে জমিদারি উৎখাতের দাবিটি যথার্থ ছিল। কিন্তু যৌথ খামার ও জমির সমবণ্টন এবং সকল শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ ও শ্রমিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কারখানা পরিচালনার দাবিগুলো ছিল কিছুটা স্বপ্ন-কল্পনা বা ইউটোপিয়া। আমার মতে, আওয়ামী লীগের জন্মলগ্নের প্রথম সম্মেলনের ১২-দফা মূল দাবিই ছিল এই দলটির গড়ে ওঠা ও বিকাশধারার মূল ভিত্তি।’ এই ভিত্তি যে মূলত; ক্ষমতা কুক্ষিত করার কৌশল বৈ অন্য কিছু ছিল না, তা হয় তো বা শামসুল হকের মতো নেতারা বুঝতে পারেননি। তারা চেয়েছিলেন, এর বাস্তবায়ন। জনগণের সামনে কোন স্বপ্ন-কল্পনা বা ইউটোপিয়া হিসেবে তা উপস্থাপন তাঁর লক্ষ্য ছিল না। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের বক্তব্য হলো,‘ আওয়ামী লীগের প্রথম ঘোষণাপত্রের তাৎপর্য বুঝতে হলে প্রতিষ্ঠালগ্নের পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশ, জনগণের মনস্তত্ত্ব এবং চেতনার স্তর এবং প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যেও ভাবাদর্শগত টানাপোড়েন সম্পর্কে ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রথম ঘোষণাপত্রে ঘোষিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা, ধর্মাশ্রিত রাজনৈতিক সেøাগানের আড়ালে বাঙালির অধিকার এবং এমন কী ‘পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসংঘ’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বোঝা যাবে না। আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, মুসলিম লীগের গর্ভেই ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’র জন্ম। ১৯৪৯ সালে যারা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠন করেন, তারা প্রায় সবাই ছিলেন ১৯৪৭-এর আগের নিখিল ভারত তথা অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সদস্য। দেশভাগের আগেই, পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখনই বেঙ্গল মুসলিম লীগে রক্ষণশীল ও উদারনীতির অনুসারী দুটি অংশের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল।’
অর্থাৎ এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আদর্শকে বাদ দিয়ে ভারতকে খুশী করতে ধর্মনিরক্ষেতার নামে ধর্মহীনতা তথা ইসলামী দর্শনকে রাজনীতি থেকে উৎখাত করাকেই কি এখানে উদারনীতি বলা হচ্ছে? আসলে কি এর নাম উদারতা? প্রতিবেশী ভারত সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু সেই দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি ( বিজেপি) কট্টরপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী দর্শনকে তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে। অথচ সকল জাতি-ধর্ম বর্ণের মানুষের অধিকার রক্ষার গ্যারান্টি দেয় ইসলাম। এখানে কট্টরপন্থার কোন স্থান নেই। উদারতার বিচারে ঐতিহাসিকভাবে পরীক্ষিত আদর্শ ইসলাম, তারপরও কেন উদারনীতির নামে এই বিচ্যুতি? এই বিচ্যুতি মেনে নিতে পারেনি বলেই কি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক আজও নিখোঁজ,তাঁর কবরেরও কোন সন্ধান কারো কাছে নেই?
অথচ তিনি ছিলেন দেশ ও জনগণের জন্য সব কিছু উজাড় করে দেয়া এক মহান নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শুরুর দিকে প্রায়ই উল্লিখিত হয়েছে এ মহৎ রাজনীতিপ্রাণ মানুষটির নাম। অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে শেখ মুজিব বারবার স্মরণ করেছেন তাঁকে। বায়ান্নর উত্তাল ভাষা আন্দোলনের সময়ে রাজবন্দি হিসেবে দীর্ঘ সময় তাকে কাটাতে হয়েছে জেলের অভ্যন্তরে। সেই সময় শামসুল হকের অনুপস্থিতি অনুভব করেছেন শেখ মুজিব। তিনি তার লেখায় শামসুল হককে নিয়ে প্রতি মুহূর্তের উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেছেন। শেখ মুজিব লিখেছেন- ‘পাকিস্তান আন্দোলনে হক সাহেবের অবদানে যারা এখন ক্ষমতায় আছেন, তাদের চেয়েও অনেক বেশি ছিল তার অবদান। বাংলাদেশের যে কয়েকজন কর্মী সর্বস্ব দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন তাদের মধ্যে শামসুুল হক সাহেবকে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মী বললে বোধহয় অন্যায় হবে না। ১৯৪৩ সাল থেকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানকে জমিদার, নবাবদের দালানের কোঠা থেকে বের করে জনগণের কুঠিরে যারা নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে হক সাহেব ছিলেন অন্যতম। অথচ স্বাধীনতার সাত দিনের মাথায়ই তিনি মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেন। একেই বলে মন্দ কপাল’। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পৃষ্ঠা : ২৩৬)
তিনি আরো লিখেছেন,‘১৯৪৯ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে অথবা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে টাঙ্গাইলে উপনির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিলো। আমরা ঠিক করলাম, শামসুল হক সাহেবকে অনুরোধ করবো মুসলিম লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়তে। শামসুল হক সাহেব শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন, কিন্তু টাকা পাওয়া যাবে কোথায়? হক সাহেবেরও টাকা নেই, আর আমাদেরও টাকা নেই। তবু যেই কথা সেই কাজ। শামসুল হক সাহেব টাঙ্গাইলে চলে গেলেন, আমরা যে যা পারি জোগাড় করতে চেষ্টা করলাম। কয়েক শত টাকার বেশি জোগাড় করা সম্ভব হয়ে উঠল না। ছাত্র ও কর্মীরা ঘড়ি, কলম বিক্রি করেও কিছু টাকা দিয়েছিলো।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পৃষ্ঠা-১১৫)।
দেশ ও জনগণের জন্য রাজনীতির সেই মিশন ও ভিশন কোথায় হারিয়ে গেছে? গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও মানবতার মুক্তির জন্য ঘড়ি, কলম বিক্রি করেও কিছু টাকা দেয়া সেই তরুণ দেশপ্রেমিক ছাত্র নেতারা কেন আর এগিয়ে আসছেন না? শামসুল হকদের হারিয়ে যাওয়ার ইতিবৃত্ত খুঁজতে গেলে এমন অনেক প্রশ্ন বার বার সামনে আসে এবং আসবেই। শামসুল হকের রাজনৈতিক দর্শন বুঝতে হলে তাঁর রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণের এবং তাঁর লেখা বইগুলোও পড়তে হবে। বিশেষ করে, তাঁর লেখা সাড়া জাগানো গ্রন্থ,‘ বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম’ গ্রন্থটি গবষকের মন নিয়ে পড়তে হবে।
নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ইসলামী আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলেই হয় তো প্রথম সভাপতি করা হয়েছিল একজন মাওলানাকে। প্রথম সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর পর যিনি সভাপতি হয়েছিলেন তিনিও ছিলেন একজন মাওলানা। তাঁর নাম মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ।
১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার টিকাটুলির রোজ গার্ডেন প্রাঙ্গণে মুসলিম লীগের গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণ দেন মওলানা ভাসানী। এই সম্মেলন থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল। দলের উদ্বোধনী অধিবেশনে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকও উপস্থিত ছিলেন। কথা ছিল তিনিও আওয়ামী লীগে যোগদান করবেন। কিন্তু পরে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। সম্মেলনে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। মওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন এটি ছিলো মূলতঃ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ কেন্দ্রীক একটি রাজনৈতিক দল। অনেকের কাছেই আজ অজানা, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নামক সংগঠন দু’টির সম্পর্ক ছিল কখনও পৃথক, কখনও এক। কৌশলগত কারণে গঠিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আলাদা সত্তা নিয়ে যাত্রা করে। ১৯৭১ সালে তা বিলুপ্ত হয়ে যায় ঐতিহাসিক কারণেই। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার আগে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে (বর্তমান খাইবার পাখতুন প্রদেশ) গঠিত হয়েছিল মানকি শরীফের পীর সাহেবের সংগঠন। এ ধরনের নামকরণের ক্ষেত্রে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুপ্রেরণাই ছিল মুখ্য। তাঁর প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে পীর সাহেব এই দল গঠন করেছিলেন। ঢাকা হাইকোর্টে এক মামলা পরিচালনার জন্য সোর্হাওয়ার্দী যখন ঢাকায় আসেন, তখন পীর সাহেবের অনুকরণে সংগঠনের নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার আগে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে সোহরাওয়ার্দী পশ্চিমবঙ্গে বাস্তুহারা হয়ে পাকিস্তান আসেন। কিন্তু পূর্ববঙ্গে শাসক গোষ্ঠীতে ঠাঁই না হওয়ায় লাহোরে যান এবং পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। সোহরাওয়ার্দী লাহোরে নবাব ইফতিখার হোসেনের সহায়তায় গঠন করেন ‘জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ।’ সিন্ধু প্রদেশেও গঠিত হয় জিন্নাহ আওয়ামী লীগ। এর ক’দিন পর ২৩ জুন ভাসানীকে সামনে রেখে ঢাকায় গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। অবশ্য ততদিনে সোহরাওয়ার্দী হয়ে উঠেছেন পাকিস্তানের উভয় অংশের প্রধান সংযোগ সেতু। জিন্নাহর মৃত্যুর পর মুসলিম লীগের নেতৃত্বের কোন্দল তীব্র হতে থাকলে দলত্যাগ শুরু করে নেতাকর্মীদের একটা অংশ আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৪৯ সালের নবেম্বরে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি চৌধুরী খালেকুজ্জামানকে লেখা এক পত্রে সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগকে একটি ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে পুনর্গঠিত করার আশা প্রকাশ করেছিলেন। অন্যথায় তাঁরা তাঁদের নিজস্ব দল গড়ে তুলবেন বলে জানান। মুসলিম লীগের সংস্কার সাধনে ব্যর্থ হওয়ায় সোহরাওয়ার্দীর একটি জাতীয় বিরোধী দল গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেন। তাঁর উৎসাহ ও নেপথ্য সহযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলেও, গোড়ার দিকে তিনি দলটির সদস্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন তখনও পাকিস্তান গণপরিষদে মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য। বিরোধিতার কারণেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে ১৯৪৮ সালের শেষদিকে সোহরাওয়ার্দীর গণপরিষদের সদস্যপদ বাতিল করেন। তিনি যখন জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন তখন জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহ তাঁকে সমর্থন করেন। এই সংগঠনটি পৃথকভাবে কাজ চালায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য না গড়েই। একপর্যায়ে সোহরাওয়ার্দী জিন্নাহ লীগ বিলুপ্ত করেন। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক কর্মীদের এক সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দীকে সভাপতি ও একমাত্র সংগঠক করে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কোন অংশ হিসেবে গঠিত হয়নি। কিংবা ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে বিলুপ্ত নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী লীগেরও অংশে পরিণত হয়নি। তবে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীর অফিসকে গণ্য করা হতো কেন্দ্রীয় অফিস। অপরদিকে প্রাদেশিক শাখা হিসেবে গণ্য করা হতো পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগকে। আওয়ামী লীগ পূর্ববঙ্গে ২ বছর ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল। কৌশলগতভাবে ১৯৫১ পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের ভিন্নমতাবলম্বী মুসলিম লীগারদের দ্বারা গঠিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক শাখার পরিচয় বহন শুরু করে। পূর্ব বাংলার রাজনীতি থেকে সোহরাওয়ার্দী কে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও যখন পূর্ব বাংলায় অসন্তোষ ঘনীভূত হচ্ছিল, তখন ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের সিদ্ধান্তে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগকে অধিভুক্ত করা হয়। তবে এই অধিভুক্তি ছিল শর্তসাপেক্ষে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এর নামকরণ, ম্যানিফেস্টো ও কর্মসূচী থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। সম্মেলনে ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান লীগের একটি প্রতিনিধিদল যোগ দিয়েছিল। নীতিগত মতভেদের কারণে জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগের সংগঠক নওয়াব ইফতিখার হুসাইন খানকে সম্মেলনে বহিষ্কার করা হয়। ভাসানী বলেন, জিন্নাহ লীগের সঙ্গে কোনরূপ বিরোধ দেখা দিলে পূর্ব পাকিস্তান লীগ দলের কর্মসূচী ও ম্যানিফেস্টোর প্রতি অবিচল থাকবে। যদি কেউ আমাদের কর্মসূচীতে নাক গলাতে আসে তাহলে কেন্দ্রীয় পার্টির সঙ্গে আমাদের অধিভুক্তির প্রশ্নটি পুনর্বিবেচনা করতে আমরা বাধ্য হব। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কমিটি। প্রথম সাংগঠনিক কমিটির আহ্বায়ক হন সোহরাওয়ার্দী। পরে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সেক্রেটারি জেনারেল হন মাহমুদুল হক ওসমানী।’ ( সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ, ২২ জুন ২০১৫)
আওয়ামী লীগের আদি ও আসল উৎস খুঁজতে গিয়ে যে সত্য বের হয়ে আসলো, তাহলো সংগঠনটির সূচনা একজন পীর সাহেবের হাতে। পকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের (বর্তমান খাইবার পাখতুন প্রদেশ) মানকি পীর সাহেবের দরবার শরীফ থেকে। উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে মানকি পীর সাহেবের ভূমিকা আজও ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তিনি দেশ বিভাগের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন খেলাফতের আদর্শে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়েই। তবে কেন আওয়ামী লীগের এই বাঁক বদল।
কেন এই বাঁক বদল
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন মনে করেন, ‘ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে প্রথমে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগের নামের সাথে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া তথা আওয়ামী লীগকে ধর্মনিরপেক্ষ দলে রূপান্তরিত করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। ৫৭ সদস্যের ওয়ার্কিং কমিটির ২৭ জন সদস্য খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। অবশ্য ১৯৫৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ সেক্যুলার দলে পরিণত হয়। এই সময়ে আরও দুটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা সংঘটিত হয়। ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে আওয়ামী লীগের বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উপস্থিত ছিলেন। মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। কাগমারী সম্মেলনে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে উত্থাপিত হয়। কিন্তু এই সম্মেলনেই মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে তথা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রধানত পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে চূড়ান্ত মতপার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কাগমারী সম্মেলনের এক মাসের মধ্যেই মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। ১৯৫৭ সালের ১৩ ও ১৪ জুন ঢাকায় আরমানিটোলা নিউ পিকচার হাউসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ভাসানী দল ত্যাগ করলেও আওয়ামী লীগ তাকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সভাপতির পদে বহাল রেখেছিল। কিন্তু ভাসানী সাহেব তখন নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার উদ্যোগ নেন। ১৯৫৭ সালের ২৫ ও ২৬ জুলাই এক নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক সম্মেলনের মাধ্যমে মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠন করেন।’ বিভাজন ও বাঁক বদলের পথপরিক্রমা শুরু সেই থেকেই যেদিন ওয়ার্কিং কমিটির ২৭ জন সদস্যের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। নাম থেকে শুধু মুসলিম শব্দ বাদ নয় দলটি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এবং প্রতিষ্ঠাতাদের আদর্শ বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতা গ্রহণ করার কারণেই আওয়ামী লীগের এ পতন বলে মনে করেন অনেক রাজনীতি বিশ্লেষক। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আদর্শের আলোকে দেশ গড়া এবং মানবজীবনের সমস্যার সমাধান মানে সাম্প্রদায়িকতা কিংবা ধর্মান্ধতা নয়। আধুনিক জীবন সমস্যার সমাধান এবং সকল ধর্মের মানুষের অধিকার রক্ষা করেও এ আদর্শ ও মূল্যবোধ বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যার উত্তম উদাহরণ বাংলাদেশ জাতীয়তবাদী দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো।
ইমেইল: যধৎঁহরনহংযধযধফধঃ@মসধরষ.পড়স লেখক: সিনিয়ির সাংবাদিক, কথাসাহ্যিতিক।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com