শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৩ পূর্বাহ্ন

রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা ঈমানি দায়িত্ব

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০২৪

রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করা প্রতিটি নাগরিকের ঈমানি দায়িত্ব। যেহেতু এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ, তাই এটি দেশের আপামর জনগণের হক। এই সম্পদ দেশের মানুষের কাছে আমানত। কোনোভাবেই তা নষ্ট ও অপচয় করার সুযোগ নেই। যে বা যারা এটি নষ্ট ও অপচয় করবে, এর সাথে কোনোভাবে জড়িত থাকবে তারা প্রত্যেকেই পাপের ভাগীদার হবে। পবিত্র কুরআনে বারবার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে আমানত রক্ষার জন্য। সরকারি সম্পদ জনগণ ও দায়িত্বশীলদের কাছে আমানত। প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার অন্যতম আলামত হলো আমানত রক্ষা করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর (তারাই প্রকৃত মুমিন) যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।’ (সূরা আল মুমিনুন-৮)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতকে তার মালিকের কাছে প্রত্যর্পণ করো বা ফেরত দাও।’ (সূরা আন-নিসা-৫৮)
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত এক হাদিসে উল্লেখ আছে, কিয়ামত দিবসে তিন ধরনের মামলা উঠবে : ১. ক্ষমার অযোগ্য মামলা। সেটি হলো শিরক করে তওবা ছাড়া মারা যাওয়া; ২. আল্লাহর হক-সংশ্লিষ্ট বিধান না মানা। সেগুলো আল্লাহ চাইলে মাফ করতে পারেন, চাইলে সাজাও দিতে পারেন; ৩. বান্দার হক নষ্ট করা। কারো হক নষ্ট করা, কাউকে গালি দেয়া, কারো জমি আত্মসাৎ করা। এসব মামলার বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলবেন- ‘এই মামলা আমার কাছে না। ওই বান্দা যদি তোমাকে ছাড় দেয় তো দিলো, আর না দিলে আমি আল্লাহর কিছু করার নেই।’
এ বিষয়ে একটি হাদিস উল্লেখ করা যেতে পারে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা কি জানো (প্রকৃত) গরিব কে?’ সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা তো মনে করি, আমাদের মধ্যে যার টাকা-পয়সা, ধনদৌলত নেই, সেই গরিব। তিনি সা: বললেন, ‘কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের মধ্যে সেই সবচেয়ে বেশি গরিব হবে, যে ব্যক্তি দুনিয়া থেকে নামাজ, রোজা ও জাকাত আদায় করে আসবে; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেসব লোকেদেরও নিয়ে আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কারো অপবাদ রটিয়েছে, কারো সম্পদ খেয়েছে, কাউকে হত্যা করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে; এমন ব্যক্তিদের তার নেকিগুলো দিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর যখন তার নেকি শেষ হয়ে যাবে অথচ পাওনাদারের পাওনা তখনো বাকি, তখন পাওনাদারদের গোনাহ তার ওপর ঢেলে দেয়া হবে, আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’
পেয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘লা ঈমানা, লিমান লা আমানাতা লা’। অর্থাৎ- ‘যার আমানতদারী নেই, তার ঈমান নেই’। (মুসনাদে আহমদ) রাষ্ট্রের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য, রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে প্রিয়নবী সা: বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি) রাষ্ট্রীয় গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, পাহাড়, মাটি, বন, বালি, আরো যেকোনো সম্পদ যথাযথ ব্যবহার না করলে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয় হবে। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন- ‘নিশ্চয় অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই’। (সূরা বনি ইসরাইল-২৭)
রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করা কবিরা গোনাহ। এর ফলে কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। মহান রাব্বুল আলামিন বলেন- ‘ যারা আত্মসাৎ করে, তারা কিয়ামতের দিন আত্মসাৎকৃত সম্পদসহ উপস্থিত হবে। আর প্রত্যেকে তার উপার্জিনের ফল ভোগ করবে।’ (আল কুরআন) সুনানে আবু দাউদ ও ইবনে মাজায় এসেছে, হজরত জায়েদ ইবনে খালিদ জুহানি রা: থেকে বর্ণিত- ‘খায়বার যুদ্ধে জনৈক ব্যক্তি কোনো দ্রব্য আত্মসাৎ করে। পরে সে মারা গেলে, রাসূলে কারিম সা: তার জানাজা পড়াননি; বরং বললেন, সে সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা তার জিনিসপত্র তল্লাশি করে তাতে একটি রেশমি বস্ত্র পেয়েছিলাম। সহিহ মুসলিম ও বুখারি শরিফে বর্ণিত- একবার রাসূল সা: ইবনুল লুতবিয়াকে বায়তুল মালের অর্থ আদায়ের জন্য নিয়োগ করেন। তিনি ফিরে এসে আদায়কৃত অর্থগুলো দু’ভাগে ভাগ করে বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, এগুলো রাষ্ট্রের সম্পদ, আর এগুলো আমার সম্পদ। যা মানুষ আমাকে হাদিয়া দিয়েছে। তার কথা শুনে রাসূল সা: খুব রেগে গেলেন। তিনি সাহাবাদের বললেন, ‘তোমাদের কাউকে আমি সদকা আদায়ের জন্য পাঠালে, সে ফিরে এসে বলে, এগুলো রাষ্ট্রের আর এগুলো আমার সম্পদ, যা মানুষ আমাকে হাদিয়া দিয়েছে। তার চিন্তা করা উচিত, যদি সে বাড়িতে বসে থাকত, তাহলে মানুষ তাকে হাদিয়া দিতো না।’
রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহর কসম! যারা রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষা করবে না, আমানতের খিয়ানত করবে, কিয়ামতের দিন তারা উট কাঁধে নিয়ে উঠবে। সে চিৎকার করে আমার কাছে সাহায্য চাইবে, কিন্তু সেদিন আমি তার কোনো সাহায্য করব না।’ কুরআনের আয়াত ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করা মুমিনের ঈমানি দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটি একটি বিশাল আমানত।
দেশের প্রতি মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য : ১. দেশকে ভালোবাসা : মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা মুমিনের বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর সব নবী-রাসূল মাতৃভূমিকে ভালোবাসতেন। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন প্রিয়নবী সা:। এ জন্য মহান আল্লাহ তাঁকে মাতৃভূমি মক্কায় ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দেন।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘নিশ্চয়ই যিনি আপনার জন্য কুরআনকে বিধান করেছেন তিনি আপনাকে অবশ্যই জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন।’ (সূরা কাসাস-৮৫)
২. দেশের কল্যাণ কামনা করা : মুমিন সবসময় দেশের কল্যাণ চায়। সে কখনো দেশের অকল্যাণ চায় না। কুরআনে মুমিনদের দোয়া শেখানো হয়েছে- ‘স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম বলেছিলেন, হে আমার প্রতিপালক! এটাকে নিরাপদ শহর করুন। আর এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে তাদের ফলমূল দ্বারা জীবিকা প্রদান করুন।’ (সূরা বাকারা-১২৬)
৩. শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা : মুমিনের দায়িত্ব সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। শান্তি-শৃঙ্খলা পরিপন্থী কোনো কাজ না করা। মহান আল্লাহ বলেন- ‘শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তোমরা জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না।’ (সূরা আরাফ-৫৬)
৪. নিরাপত্তা নিশ্চিত করা : দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রধানত রাষ্ট্রের।
তবে যেহেতু মানুষই অপরাধ কর্মের অনুঘটক, তাই ইসলাম মানুষকে অন্যের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নষ্ট হয় এমন সব কিছু থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।’ (সূরা বাকারা-১৮৮)
রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম পরস্পরের জন্য নিষিদ্ধ।’ (বুখারি-১০৫)
৫. মানবিক সমাজ গঠন করা : ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কে যদিও এক মুমিন অপর মুমিনকে প্রাধান্য দেবে; কিন্তু মুসলমান ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সবার জন্য মানবিক মর্যাদা ও সাম্য নিশ্চিত করবে। কেননা সব মানুষই আদম আ:-এর সন্তান এবং আল্লাহ সবাইকে সম্মানিত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি; তাদের উত্তম জীবিকা দান করেছি এবং যাদের সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৭০)
৬. দেশের উন্নয়নে কাজ করা : দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো দেশ ও জাতির উন্নয়নে সচেষ্ট হওয়া। কেননা, জাতির উন্নয়নের চাবিকাঠি আল্লাহ তার হাতেই দিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন- ‘আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।’ (সূরা রাদ-১১)
৭. পরিবেশ রক্ষা করা : আধুনিক পৃথিবীতে পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিজ্ঞানীদের মতে, এর ওপর নির্ভর করছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। ইসলাম প্রতিটি নাগরিককে পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হতে বলে। এ জন্য ইসলাম অনর্থক বৃক্ষ নিধন, পশু-পাখি হত্যা, জলাধার নষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে বলেছে। বিপরীতে পরিবেশের উন্নয়ন হয় এমন কাজে উৎসাহিত করেছে। যেমন- বৃক্ষ রোপণ। নবী সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষ রোপণ করে, আল্লাহ এর বিনিময়ে তাকে ওই বৃক্ষের ফলের সমান প্রতিদান দেবেন।’ (মুসনাদে আহমদ-২৩৫৬৭)
৮. জাতীয় সম্পদ রক্ষা করা : জাতীয় সম্পদ রক্ষায় প্রতিটি মুমিনকে সচেষ্ট হতে হবে। যেমন ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ: রাষ্ট্রীয় কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অর্থে জ্বালানো প্রদীপ নিভিয়ে দিতেন। বলতেন, ‘আমি মুসলমানের সেবায় নিয়োজিত ছিলাম, তাই তাদের সম্পদ দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়েছিলাম। এখন তুমি আমার অবস্থা জানতে চেয়েছ, তাই আমি আমার ব্যক্তিগত অর্থে প্রদীপ জ্বালালাম।’ (আল ইকতিসাদুল ইসলামী-২৫৬)
৯. ঐক্যবদ্ধ থাকা : সুনাগরিক হিসেবে মুসলমানের দায়িত্ব হলো আল্লাহর নিদের্শনার ভিত্তিতে জাতীয় স্বার্থরক্ষায় ঐক্যবদ্ধ থাকা। কেননা, অনৈক্য জাতিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হইও না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো, তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেছেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা তো অগ্নিকু-ের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন।’ (সূরা আলে ইমরান-১০৩)

১০. স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা : মুমিন দেশকে ভালোবাসে। তাই দেশের স্বাধীনতা-সাবভৌমত্ব রক্ষায় সে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকে। মহানবী সা: বলেন, ‘জাহান্নামের আগুন দুটি চোখকে স্পর্শ করবে না। আল্লাহর ভয়ে যে চোখ কান্না করে এবং আল্লাহর রাস্তায় যে চোখ (নিরাপত্তার জন্য) পাহারা দিয়ে নিদ্রাহীন রাত পার করে।’ (সুনানে তিরমিজি-১৬৩৯)। লেখক : সংগঠক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com