মহান ভাষা আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক, খ্যাতিমান সাংবাদিক ও দৈনিক ইনকিলাবের ফিচার সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল গফুর ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। গত শুক্রবার দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর আজগর আলী হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। তিনি ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে, নাতি নাতনী এবং অনেক গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। রাত ৮টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে মরহুমের নামাজে জানাজা শেষে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আব্দুল গফুরের মৃত্যুতে দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। ইনকিলাব সম্পাদক বলেন, ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর ছিলেন আমাদের চেতনার বাতিঘর, আমাদের অভিভাবক, দৈনিক ইনকিলাবের রতœ, দেশের রতœ। তাকে হারিয়ে আমরা আমাদের অভিভাবককে হারিয়েছি। অধ্যাপক আবদুল গফুর আমাদের রোল মডেল ছিলেন। তিনি সৎ- আদর্শ এবং প্রকৃত অর্থে একটি ডিসিপ্লিন লাইফের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তার সংস্পর্শে, সহচার্য্যে আমরা অনেক ঋদ্ধ হয়েছি। তার চলে যাওয়া আমাদের জন্য এক অপূরনীয় ক্ষতি। তার মৃত্যুতে ইনকিলাব পরিবার গভীর শোকাহত। অল্লাহ তাকে জান্নাত নসীব করুন এবং তার পরিবারকে এই শোক সহ্য করার ধৈর্য দিন।
অধ্যাপক আব্দুল গফুরের মৃত্যুতে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, দৈনিক ইনকিলাব ইউনিটের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনও শোক প্রকাশ করেছে।
ভাষা আন্দোলনের কিংবদন্তি অধ্যাপক আবদুল গফুর ১৯২৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার রাজবাড়ির দাদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। তিনি দৈনিক ইনকিলাবে সর্বশেষ ফিচার এডিটর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ম্যাট্রিকুলেশন এবং ইন্টারমিডিয়েটে স্ট্যান্ড করা ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনের ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অত্যন্ত সাদা মনের গুণী মানুষ অধ্যাপক আবদুল গফুর দীর্ঘ দিন অসুস্থ ছিলেন। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন।
১৯৪৫ সালে সমগ্র বাংলা ও আসামের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ফরিদপুর ময়েজ উদ্দীন হাই মাদরাসা থেকে (প্রবেশিকার সমমানের) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। ১৯৪৭ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে সরকারি নজরুল কলেজ) থেকে ঢাকা বোর্ডের ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় নবম স্থান অধিকার করেন। ছাত্রজীবনেই তিনি পাকিস্তান আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ফাইনাল অনার্স পরীক্ষার মাত্র দুই মাস আগে ভাষা আন্দোলনসহ তমদ্দুন মজলিসের কাজে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে আত্মনিয়োগ করায় আবদুল গফুর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন । ফলে দীর্ঘ ১১ বছর পর ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সমাজকল্যাণে এমএ ডিগ্রি নিতে হয়। ১৯৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি পাক্ষিক জিন্দেগী পত্রিকায় সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তমদ্দুন মজলিস প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’-এর সহকারী সম্পাদক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এতে তিনি সুধীজনের প্রশংসা অর্জন করলেও সরকারের কোপানলে পড়েন। তিনি ১৯৫২ সালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ফলে সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফফতারি পরোয়ানা জারি করে। তিনি ১৯৫৭ সালে দৈনিক মিল্লাত ও ১৯৫৮ সালে দৈনিক নাজাত-এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার সূচনা থেকে আমৃত্যু তিনি এই পত্রিকার ফিচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি ২০০৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। অধ্যাপক আবদুল গফুর একজন সুসাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও লেখক। বহু গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। বিবিধ বিষয়ের উপর তিনি লিখে গিয়েছেন নিরলস। তাঁর গদ্যশৈলী ও ভাষার প্রাঞ্জলতা তাঁকে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বিপ্লবী উমর, সমাজকল্যাণ পরিক্রমা, কোরআনী সমাজের রূপরেখা, খোদার রাজ্য, ইসলাম কী এ যুগে অচল, ইসলামের জীবনদৃষ্টি, ইসলামের রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য, শাশ্বত নবী, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাংলাদেশ আমার স্বাধীনতা, স্বাধীনতার গল্প শোনো, আমার কালের কথা প্রভৃতি। বিশিষ্ট ভাষাসৈনিক, প্রবীণ সাংবাদিক ও দৈনিক ইনকিলাবের ফিচার সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল গফুরের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ। যেসব নেতৃবৃন্দ শোক জানিয়েছেন, তারা হচ্ছেন, তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক ও সাধারণ সম্পাদক মেজর (অব.) জামিল আহমেদ, ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, খেলাফত মজলিসে আমীর মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকে মহসীন রশিদ মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব শাইখুল হাদিস ড. গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট মাওলানা আব্দুর রকীব ও মহাসচিব অধ্যাপক আব্দুল করীম, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী ও যুগ্ম মহাসচিব হাজী জালাল উদ্দিন বকুল, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (একাংশ) আমির মাওলানা আবু জাফর কাসেমী ও মহাসচিব মাওলানা হোসাইন আকন্দ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মুফতি মুজিবুর রহমান, নির্বাহী সভখাপতি মাওলানা এ কে এম আশরাফুল হক ও মুফতি মুমিন।