রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ০২:২৯ পূর্বাহ্ন

মানুষের সাথে বাজপাখির প্রেম প্রকৃতির বিস্ময়কর বন্ধন

জাজিরা (শরীয়তপুর) প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৪

বিভিন্ন সময়ে প্রাণী ও মানুষের মধ্যে গভীর বন্ধনের গল্প শোনা যায়, তবে এক বাজপাখির সাথে মানুষের প্রেমের সম্পর্ক এটি একটি অস্বাভাবিক ও বিস্ময়কর ঘটনা। বিশ্বব্যাপী প্রাণীদের সাথে মানুষের বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের গল্প সাধারণ হলেও, বাজপাখির মতো বন্য ও শিকারি পাখির সাথে এমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের উদাহরণ খুবই বিরল। এই হৃদয়গ্রাহী গল্পের শুরু হয় শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলায় । বড়মূলনা গ্রামের এক তরুণের নাম রোমান ছৈয়াল, যিনি একজন প্রাণীপ্রেমী হিসেবে পরিচিত। রোমান সবসময়ই বন্যপ্রাণীদের প্রতি গভীর মমতা ও আকর্ষণ অনুভব করতেন, বিশেষত শিকারি পাখির প্রতি। ছোটবেলা থেকেই তার আগ্রহ ছিল প্রাকৃতিক জীবনের অদ্ভুত এবং চ্যালেঞ্জপূর্ণ দিকগুলোর প্রতি। তবে তার জীবন বদলে যায় যখন তিনি একদিন ফসলি জমিতে আহত অবস্থায় একটি বাজপাখি খুঁজে পান। রোমান তাকে বাঁচানোর জন্য বাড়ি নিয়ে যান এবং সেই পাখিটিকে জাজিরা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে নিয়ে টানা ১৫ দিন চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলেন। ধীরে ধীরে, বাজপাখিটি সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো, পাখিটি তার মুক্তি পাবার পরও রোমানের কাছ থেকে দূরে যায়নি। দিন দিন তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হতে থাকে। ভালোবেসে বাজপাখিটির নাম দেওয়া হয়েছে বাহাদুর। আর এই বাহাদুরের সাথেই গত দুই বছর ধরে সখ্যতা গড়ে উঠেছে রোমান ছৈয়ালের। ভালোবাসায় শিকারি পাখিকেও যে বসে আনা যায়, তার এক দৃষ্টান্ত উদাহরণ রোমান আর বাহাদুরের বন্ধুত্ব। পাখিটি রোমানের ভালবাসা পেয়ে আর অন্যত্র যেতে চাইছে না। তাদের পরিবারের এক সদস্যের মতোই বেড়ে উঠছে পরম যতœ আর ভালোবাসায়। রোমানের অনুপস্থিতিতে বাহাদুরের দেখাশোনা করেন মা হোসনে আরা বেগম ও ছোট ভাই সাইম ছৈয়াল। পাখিটির খাবারের জন্য প্রত্যেকদিন কিনে রাখা হয় নানা রকম মাছ। আর পাখিটির যাতে কেউ কোনো ক্ষতি করতে না পারে সেদিকেও নজর রাখেন তারা। দিনে খোলা জায়গায় পাখিটি উন্মুক্ত রাখা হয়। কখনো আশপাশে উড়ে গেলে আবার ফিরে আসে। রাতে পাখিটি ঘরের কাছে আবার কখনো রোমানের ঘরেই থাকে। রোমান বলেন, আমি যখন পাখিটিকে কুড়িয়ে পাই তখন প্রায় মৃত অবস্থায় ছিল। আমি পাখিটিকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই। অনেকেই বলেছিলো পাখিটি মারা যাবে। তবে আমি হাল ছাড়িনি। ১৫ দিন টানা চিকিৎসা শেষে পরে ও সুস্থ হয়ে গেলে উন্মুক্ত করে দেই। কিন্তু এরপর ও আর যায়নি। আমি ভালোবেসে ওর নাম দিয়েছি বাহাদুর। আর এই নামে ডাকলেই ও সাড়া দেয় আর চলে আসে। একটা মানুষকে ভালোবাসলেও মনে হয় না এভাবে থেকে যায়। কিন্তু বাহাদুর আমার চাইতেও আমাকে বেশি ভালোবাসে। তাই কখনোই আমাকে ছেড়ে যায় না। আমি কখনও ভাবিনি যে একটি পাখির সাথে আমার এমন সম্পর্ক হবে। এটি আমার জীবনের অন্যতম সুন্দর অভিজ্ঞতা।” প্রথম প্রথম পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরক্তির কারণ হলেও এখন তারা পাখিটিকে মায়ার চোখে দেখেন। রোমানের পাশাপাশি তারাও সেবাযতœ করেন পরম মমতায়। রোমানের মা হোসনে আরা বেগম বলেন, প্রথম প্রথম ওযখন পাখিটিকে নিয়ে সারাক্ষণ থাকতো আমরা এক প্রকার বিরক্তই হতাম। একটা সময় আমরাও ওর মায়ায় পড়ে যাই। এখন বাহাদুর কি খাবে কখন খাবে এই নিয়ে আমাদের সময় চলে যায়। এক কথায় ও এখন আমার সন্তানের মতো। রোমান বাড়িতে না থাকলে আমরাই বাহাদুরের খেয়াল রাখি। বাজপাখির সাথে মানুষের এমন সম্পর্ক বিরল বলে অনেকেই করেছেন প্রশংসা। আর পাখিটি প্রতিবেশীদের ক্ষতি নয় উল্টো তাদের হাস মুরগীর বাচ্চা পাহারা দেয় পাহারাদার হয়ে। আর তারাও খুশি হয়ে খাবার খেতে দেন পাখিটিকে। রোমানের পরিবার নিজেদের জন্য খাওয়ার মাছ না রাখলেও বাহাদুরের জন্য নিয়ম করে মাছ রাখেন প্রতিদিন। আর মাছওয়ালাও বাহাদুরের জন্য প্রতিদিন মাছ নিয়ে আসেন। রোমানের বোন নুসরাত বলেন, ভাইয়া যখন পাখিটি বাসায় নিয়ে আসে তখন অনেকেই তাকে অসুস্থ্য পাখিটিকে ছেড়ে দিতে বলে। ভাইয়া কারো কথা না শুনে নিজের কাছে রেখেই তাকে সুস্থ্য করে তোলে। এখন বাহাদুরকে ছেড়ে দিলেও কোথায় যায় না। সারাদিন ঘুরেফিরে বাড়িতেই চলে আসে। ওর জন্য অন্য কোনো শিকারিপাখি আমাদের আশেরপাশের কারো বাড়ির হাস-মুরগীর বাচ্চা শিকার করতে পারে না। সবাই বাহাদুরকে ভালোবেসে মাছ খেতে দেয়। বনের পাখির প্রতি এতো ভালবাসা, তা ভাইয়াকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। মাছ বিক্রেতা নাহিদ বলেন, সেই দুই বছর ধরে আমি বাহাদুরের জন্য মাছ দিয়ে যাই। রোমান ভাইয়ের বাসায় তাদের জন্য খাওয়ার মাছ রাখুক বা না রাখুক, বাহাদুরের জন্য প্রতিদিন তারা মাছ কিনে রাখেন। আমিও সকাল সকাল বাহাদুরের জন্য মাছ নিয়ে আসি। যদি আমি ভুল করে নাও আসতে পারি, আমি আমার ছোট ভাইকে দিয়ে মাছ পাঠিয়ে দেই। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মোঃ সোহাগ বলেন, প্রায় দুইবছর আগে রোমান ছৈয়াল আমাদের এখানে অসুস্থ্য বাজপাখিটি নিয়ে আসেন। পাখিটির পায়ে ও ডানায় আঘাত ছিলো। আমরা প্রায় দুইসপ্তাহ পাখিটিকে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করি এবং পাখিটিকে কোন সময় কি খাবার দেওয়া লাগবে সে ব্যাপারে পরামর্শ প্রদান করি। তিনি আরও বলেন, রোমান ও তার বাজপাখির এই সম্পর্ক শুধু একটি ব্যক্তিগত গল্প নয়; এটি প্রকৃতির সাথে মানুষের গভীর সংযোগের প্রতীক। এটি প্রমাণ করে যে, প্রাণীদেরও আবেগ, অনুভূতি এবং ভালোবাসার ক্ষমতা আছে, যা সঠিকভাবে অনুভব করতে পারলে তারা মানুষের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। তবে সকলের প্রতি আমাদের অনুরোধ কোনোভাবেই বনের পাখিকে খাঁচায় বন্দি করা যাবেনা। চাইলে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে তাদের উন্মুক্ত রেখে দেখভাল করতে হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com