বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৯ অপরাহ্ন

সর্বক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুন

জাফর আহমাদ
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

প্রতিশ্রুতি দুই প্রকার : যথা-১. আল্লাহর সাথে প্রতিশ্রুতি; ২, মানুষের সাথে প্রতিশ্রুতি।
আরবি ‘আহাদুন’ অর্থ অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি, ওয়াদা, চুক্তি ইত্যাদি। কোনো মানুষ অপর মানুষকে দেয়া কথা বা প্রতিশ্রুতি দেয়াকে ওয়াদা বলে। ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা কুরআন ও হাদিসে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। তা ছাড়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা একটি মর্যাদাসম্পন্ন কাজ। এ জন্য কুরআন ও হাদিসে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার কথা বিবৃত হয়েছে। একটি সুস্থ সমাজের জন্য প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটি সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিকে সব প্রকার বিকৃতি, অশান্তি ও অকল্যাণের হাত থেকে রক্ষা করে। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিজীবনে অকল্যাণ ও বিপর্যয় নেমে আসে। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমরা আমার নিয়ামতকে স্মরণ করো, যে নিয়ামত আমি তোমাদের প্রদান করেছি এবং তোমরা আমার অঙ্গীকার পূর্ণ করো, তাহলে আমি তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করব। আর কেবল আমাকেই ভয় করো।’ (সূরা বাকারা-৪০)
যেকোনো প্রতিশ্রুতিই হোক সেটি রক্ষা করা প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। আর প্রতিশ্রুতি ভেঙে ফেলা কবিরাহ গোনাহের কাজ। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরে তা থেকে সরে যাওয়া আরো মারাত্মক গোনাহের কাজ। এ ধরনের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে হাদিসের ভাষায় মুনাফিক বলে। কারণ রাসূলুল্লাহ সা: এদের মুনাফিক বলেছেন। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মুনাফিকের আলামত তিনটি- কথা বলতেই মিথ্যা বলে, আমানত রাখলে খিয়ানত করে, আর ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে।’ (বুখারি-২৬৮২, কিতাবুশ শাহাদাহ, বাবু মান আমারা বিল ইনজারিল ওয়াদে, আ: প্র: ২৪৮৭, ইফা-২৫০৩) কথা দিয়ে কথা না রাখা বিবেকবহির্ভূত ও অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। এ ধরনের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি আল্লাহর ক্রোধ উদ্রেক হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা কেন এমন কথা বলো, যা কাজে পরিণত করো না। আল্লাহর কাছে এটি অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ যে, তোমরা কথা বলো যা করো না।’ (সূরা সফ : ২-৩)
‘প্রতিশ্রুতি পালন করো, অবশ্যই প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৩৪) ‘হে ঈমানদারগণ! বন্ধনগুলো পুরোপুরি মেনে চলো।’ (সূরা মায়িদা-১) অর্থাৎ তোমরা অঙ্গীকারগুলো পূর্ণ করো। সূরা মায়িদা আল্লাহর শরিতের বিধি-বিধানে পরিপূর্ণ একটি সূরা। সূরার প্রথম আয়াতেই মহান আল্লাহ বিধি-বিধানগুলো মেনে চলার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন। ‘আর তাদের কর্মপদ্ধতি এমন যে, তারা আল্লাহকে প্রদত্ত নিজেদের অঙ্গীকার পালন করে এবং তাকে মজবুত করে বাঁধার পর ভেঙে ফেলে না।’ (সূরা রাদ-২০) এর অর্থ হচ্ছে সেই অনন্তকালীন অঙ্গীকার যা সৃষ্টির শুরুতেই আল্লাহ মানুষের কাছ থেকে নিয়েছিলেন। তিনি অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, মানুষ একমাত্র তাঁর বন্দেগি করবে। প্রত্যেকটি মানুষের কাছ থেকে এ অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিল। প্রত্যেকের প্রকৃতির মধ্যে এটি নিহিত রয়েছে। যখনই আল্লাহর সৃজনী কর্মের মাধ্যমে মানুষ অস্তিত্ব লাভ করে এবং তার প্রতিপালন কর্মকা-ের আওতাধীনে সে প্রতিপালিত হতে থাকে তখনই এটি পাকাপোক্ত হয়ে যায়। আল্লাহর রিজিকের সাহায্যে জীবন যাপন করা, তাঁর সৃষ্ট প্রত্যেকটি বস্তুকে কাজে লাগানো এবং তার দেয়া শক্তিগুলো ব্যবহার করা- এগুলো মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি বন্দেগির অঙ্গীকারে বেঁধে ফেলে। কোনো সচেতন ও বিশ^স্ত মানুষ এ অঙ্গীকার ভেঙে ফেলার সাহস করতে পারে না। ‘আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ করো যখনই তোমরা তাঁর সাথে কোনো অঙ্গীকার করো এবং নিজেদের কসম দৃঢ় করার পর আবার তা ভেঙে ফেলো না যখন তোমরা আল্লাহকে নিজের ওপর সাক্ষী বানিয়ে নিয়েছ। আল্লাহ তোমাদের সমস্ত কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত।’ (সূরা নাহল-৯১)
যারা দুনিয়াকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মানুষের সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করে মহান আল্লাহ তাদের নিন্দা ও ধিক্কার জানিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আচ্ছা, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না কেন? যে ব্যক্তিই তার অঙ্গীকার পূর্ণ করবে এবং অসৎকাজ থেকে দূরে থাকবে সে আল্লাহর প্রিয়ভাজন হবে। কারণ আল্লাহ মুত্তাকিদের ভালোবাসেন। আর যারা আল্লাহর সাথে করা অঙ্গীকার ও নিজেদের শপথ সামান্য দামে বিকিয়ে দেয়, তাদের জন্য আখিরাতে কোনো অংশ নেই। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদেরকে পাক-পবিত্রও করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে কঠোর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সূরা আলে ইমরান : ৭৬-৭৭) যারা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যারা তা ভেঙে ফেলে এবং এ ধরনের কঠিন অপরাধ করার পরও মনে করে তারা কিয়ামতের দিন আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে এবং তাদের প্রতি বর্ষিত হবে আল্লাহর অনুগ্রহ। আর দুনিয়াতে তাদের গায়ে যে দাগ লেগে আছে, তাদের মুরুব্বিদের বদৌলতে তাও মুছে যাবে। সত্যিকারার্থে সেখানে তাদের সাথে উল্টো আচরণ করা হবে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারীদের প্রতি রাগান্বিত থাকবেন। তাদের দিকে তাকাবেন না এবং আখিরাতে তাদের কোনো অংশ থাকবে না। তার মানে তারা রিক্ত হস্তে উত্থিত হবে।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: সূত্রে নবী সা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেছেন, ‘কোনো মুসলিমের মাল আত্মসাৎ করার জন্য অথবা বলেছেন : তার ভাইয়ের মাল আত্মসাৎ করার জন্য যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম করবে, আল্লাহর সাথে তার সাক্ষাত ঘটবে এমন অবস্থায় যে আল্লাহ তার উপর রাগান্বিত থাকবেন। এ কথারই সত্যতায় আল্লাহ তায়ালা অবতীর্ণ করেন : ‘নিশ্চয় যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছমূল্যে বিক্রয় করে এরা আখিরাতের নিয়ামতের কোনো অংশই পাবে না।’ (আল জামে আল বুখারি-৬৬৫৯, কিতাবুল ঈমান ওয়ান নাজুর, বাবু আহদিল্লাহি আজ্জা ও ঝাল্লা) এ হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, অঙ্গীকার ও পরস্পরের সাথে কৃত চুক্তির শর্তাবলি পালন করা অবশ্য কর্তব্য আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হারাম। যেমন-আবু সাঈদ রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘প্রত্যেক ধোঁকাবাজের জন্য কিয়ামত দিবসে একটি পতাকা থাকবে আর তা তার বিশ^াসঘাতকতার পরিমাণ অনুযায়ী উঁচু করা হবে। সাবধান! জনগণের শাসক হয়ে যে বিশ^াসঘাতকতা করে, তার চেয়ে বড় বিশ^াসঘাতক আর নেই।’ (মুসলিম-৪৪৩০, আন্তর্জাতিক নাম্বার-১৭৩৮, কিতাবুল জিহাদ ওয়াস সাইর বাবু তাহরিমিল গাদরি, ইফা-৪৩৮৮, ই. সে. ৪৩৮৮) আবু সাঈদ রা: থেকে বর্ণিত- ‘নবী সা: বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিবস প্রত্যেক অঙ্গীকার ভঙ্গকারীর নিতম্বের (পাছা) পার্শে¦ একটি পতাকা থাকবে।’ (মুসলিম-৪৪২৯, আন্তর্জাতিক নাম্বার-১৭৩৮ কিতাবুল জিহাদ ওয়াস সাইর বাবু তাহরিমিল গাদরি, ইফা-৪৩৮৭, ই. সে. ৪৩৮৭)
জীবনে চলার পথে প্রতিনিয়ত আমরা প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ। সেটি হচ্ছে- আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা। তা ছাড়া আমরা প্রাত্যহিক জীবনে অন্য মানুষের সাথে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকি বা পেয়ে থাকি। ইসলাম এসব প্রতিশ্রুতি পালন করার জন্য জোরালো তাকিদ দিয়েছে। আল্লাহ ওয়াদা ভঙ্গকারীর প্রতি যেমন রাগান্বিত হন তেমনি ওয়াদা রক্ষাকারীকে তিনি ভালোবাসেন। প্রতিশ্রুতি পালন করা আল্লাহর একটি অন্যতম গুণ। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘শুনে রাখো, আল্লাহর অঙ্গীকার সত্য, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না’ (সূরা ইউনুস-৫৫) প্রতিশ্রুতি পালন ও আমানতদারিতা যেকোনো প্রতিষ্ঠান ও দেশের জন্য কল্যাণকর। তা সত্যবাদিতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সফলতার জন্য ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা পূর্বশর্ত। আল্লাহ তায়ালা সফলকাম মুমিনদের কয়েকটি গুণের কথা সুরা মুমিনুনে উল্লেখ করেছেন। সেই গুণগুলোর অন্যতম হলো-‘নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা।’ (সূরা মুমিনুন-৮) এ দু’টি গুণসম্পন্ন ব্যক্তি দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করবে।
সুতরাং দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা লাভ করার জন্য প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুন। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হলে সামাজিক বিকৃতি ও অকল্যাণ দূরীভূত হবে এবং উন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হবে। ইনশাআল্লাহ।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com