রাহমানুর রাহিম আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর মহিমান্বিত সত্তার এক ও অদ্বিতীয় মাহাত্ম্যে কুরআনুল কারিমে অনিন্দ্য সুন্দর সরল পথ ও মহাসত্যের সুমহান বাণী দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ করেছেন শপথ করার মাধ্যমে।
আল্লাহ জাল্লা শানুহু কুরআন মাজিদে বলেন- ‘(ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ) বাতাসের শপথ, যা ধুলাবালি উড়িয়ে নিয়ে যায়, অতঃপর (মেঘমালার) শপথ, যা পানির বোঝা বয়ে চলে, (জলযানসমূহের) শপথ, যা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে, অতঃপর তাদের (ফেরেশতাদের) শপথ, যারা (আল্লাহর) আদেশ মোতাবেক প্রত্যেক বস্তু বণ্টন করে, (কিয়ামতের) যে দিনের ওয়াদা তোমাদের সাথে করা হচ্ছে তা (অবশ্যম্ভাবী) সত্য, বিচার-আচারের একটা দিন অবশ্যই আসবে, বহু কক্ষবিশিষ্ট আকাশের শপথ, তোমরাও (কিয়ামতের ব্যাপারে) নানা কথাবার্তার মধ্যে (নিমজ্জিত) রয়েছ; (মূলত) যে ব্যক্তি সত্যভ্রষ্ট সে ব্যক্তিই (কুরআনকে) পরিত্যাগ করেছে’ (সূরা আজ-জারিয়াত : ১-৯)।
আমাদের সমাজে আল্লাহ তায়ালার জিকিরের ব্যাপারে শতধা বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব প্রকট। যে যার মতো যা কিছু করার তথাকথিত স্বাধীনচেতা আল্লাহর বান্দা যখন যেমন ইচ্ছে ইবাদতের মধ্যে নিজের খেয়ালখুশির প্রতিফলন ঘটান, যা কেবল বর্জনীয় নয়; বরং তা কুরআন-হাদিসের আলোকে অবশ্যই পরিত্যাজ্য। এখানে জিকির নিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা উল্লেখ করছি।
জিকির ও জিকিরের মজলিসের ফজিলতজ্ঞাপক সাধারণ হাদিসগুলোকে দলিল করে কেউ যদি জিকিরের এমন শব্দ সংখ্যা নিয়মনীতি ও পদ্ধতি চালু করেন যা রাসূলুল্লাহ সা: ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের যুগে ছিল না তা হলে নিঃসন্দেহে তা বিদয়াত হবে এবং তাতে রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নতকে অপছন্দ করা হবে, যার শাস্তি ভয়ঙ্কর।
সর্বদা জিকির করা : সর্বদা আল্লাহ তায়ালার জিকিরে জিহ্বাকে আর্দ্র রাখতে হাদিসে তাগিদ দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: ও তাঁর সাহাবিরা সর্বাবস্থায় এমনকি নাপাক অবস্থায় গোসল ফরজ থাকা অবস্থায়ও আল্লাহর জিকির করতেন। শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকিরে জিহ্বাকে আর্দ্র রাখতে হবে। এ ব্যাপারে বারবার হাদিসে তাগিদ দেয়া হয়েছে। জিকির প্রথমত দুই প্রকার- কর্মের মাধ্যমে ও মুখে আল্লাহর জিকির। কর্মের মাধ্যমে জিকির হলো সর্বদা আল্লাহকে মনের মধ্যে রেখে তারই নির্দেশ মতো জীবনের সব কর্ম পরিচালনা করার মাধ্যমে আল্লাহর জিকির করা।
মুখের জিকির তিন প্রকারের। সর্বোত্তম পর্যায় জিহ্বা ও অন্তরে একত্রে জিকির করা, দ্বিতীয় পর্যায়ে শুধু অন্তরে জিকির করা আর তৃতীয় পর্যায়ে অমনোযোগী অন্তর নিয়ে শুধু মুখে জিকির করা। রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাহাবিদের সুন্নাত অনুযায়ী সর্বপ্রকারের জিকির করা প্রয়োজন। তারা কর্মের মাধ্যমে জিকিরের কারণে মুখের জিকির কখনো বাদ দেননি আবার মুখে জিকির করে কর্মে আল্লাহর নির্দেশাবলি অমান্য করেননি। সর্বদা মুখে জিকিররত থাকা ও কর্মে তাঁর অনুগত থাকাই জিকিরের সুন্নাহ।
আল্লাহর প্রশংসামূলক বাক্য বারবার উচ্চারণ করা ও তার বিধিবিধান আলোচনা করাও জিকির। জিকির অর্থ স্মরণ করা। আল্লাহর গুণ বা প্রশংসাবাচক কোনো বাক্য স্মরণ করা যেমন- জিকির, তেমনি আল্লাহর বিধিবিধান পুরস্কার শাস্তি তাঁর নবী-রাসূল কিতাব ইত্যাদি সব কিছুর স্মরণ জিকির। এক কথায় আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্কিত যেকোনো বিষয়ের স্মরণই আল্লাহর জিকির বলে গণ্য।
জিকির দুইভাবে করা যায়- একাকী ও সমবেত হয়ে। রাসূলুল্লাহ সা: ও তাঁর সাহাবিদের জীবনের আলোকে আমরা জানতে পারি, যে জিকির একাকী পালন করা হয় তা তারা সাধারণত একাকী ও নীরবে পালন করতেন। তা হলো আল্লাহর নাম ও গুণাবলি বারবার উচ্চারণের মাধ্যমে জিকির এবং দরুদ সালাম ও কুরআন তিলাওয়াতও জিকির। আর যে জিকির একাকী পালন করা যায় না; বরং একাধিক মানুষের প্রয়োজন হয় সে জিকিরে তারা সমবেত হতেন। তা হলো কুরআন আলোচনা, আল্লাহর বিধিবিধান, পুরস্কার শাস্তি জান্নাত-জাহান্নাম আল্লাহর নিয়ামতের কথা ইত্যাদি জিকির করতে তারা সমবেত হতেন। এ জন্য ইসলামের প্রথম যুগগুলোতে জিকিরের মজলিস বলতে ওয়াজ নসিহত আলোচনার মজলিস বুঝানো হতো। ষষ্ঠ হিজরি শতাব্দীতেও এ অবস্থা ছিল।
মনে রাখতে হবে, সমবেতভাবে বা সমস্বরে জিকির করা খেলাফে সুন্নাত। যে জিকির রাসূলুল্লাহ সা: জোরে করেছেন তা জোরে করা সুন্নত। বাকি সব জিকির আস্তে করা সুন্নত; জোরে করা খেলাফে সুন্নত। কোনো কর্ম সুন্নত না বিদয়াত তা নিশ্চিত হতে না পারলে তা পরিত্যাগ করতে হবে। এ জন্য যেখানে রাসূলুল্লাহ সা: জোরে জিকির করেছেন কি করেননি বলে দ্বিধা দেখা দেবে সেখানে জোরে জিকির পরিত্যাগ করতে হবে এবং আস্তে আস্তে জিকির করতে হবে। কারণ জিকিরের মূল সুন্নত হলো আস্তে আস্তে জিকির করা। (এহইয়াউস সুনান, ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহ:) উল্লিখিত তথ্য ও তত্ত্ব অনুযায়ী আমল করার ব্যাপারে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে জিকির করতে অনীহা প্রকাশ করা মারাত্মক বোকামি ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?
কুরআন মাজিদে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন- ‘অতএব (হে নবী), যে ব্যক্তি আমার (সুস্পষ্ট) স্মরণ থেকে সরে গেছে, তার ব্যাপারে তুমি কোনো পরোয়া করো না, (কারণ) সে তো পার্থিব জীবন ছাড়া আর কিছুই কামনা করে না; তাদের (মতো হতভাগ্য ব্যক্তিদের) জ্ঞানের সীমারেখা তো ওটুকুই; (এ কথা) একমাত্র তোমার মালিকই ভালো জানেন কে তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে এবং তিনিই ভালো করে বলতে পারেন কে সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছে’ (সূরা আন-নাজম : ২৯-৩০)।
কালেমা তৈয়বা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ জিকিরের মর্যাদা ও ফজিলতের ব্যাপারে
হাদিসে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, “যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে একদিন না একদিন এই কালেমা অবশ্যই তার উপকারে আসবে। যদিও ইতঃপূর্বে তাকে কিছুটা শাস্তি ভোগ করতে হবে” (বাজজার-৮২৯২)।
প্রিয়নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:-এর পথ ও পন্থায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জিকিরের বিকল্প নেই। তিনি কিভাবে জিকির করতেন হাদিসে তা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। হজরত আবু উমামা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ফজরের পরে বসে বসে সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর জিকির তাকবির-আল্লাহু আকবার, তাহমিদ-আলহামদুলিল্লাহ ও তাসবিহ-সুবহানাল্লাহ বলা আমার কাছে ইসমাইল বংশের দুই বা ততোধিক ব্যক্তিকে মুক্ত করার চেয়েও বেশি প্রিয়। অনুরূপভাবে আসরের পরে এভাবে জিকির করতে করতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বসে থাকা চার ব্যক্তিকে মুক্ত করার চেয়ে আমার কাছে বেশি প্রিয়’ (মুসনাদে আহমাদ-২১৬৯০)।
এ ছাড়া একাকী নির্জনে বসে জিকিরের ফজিলতের ব্যাপারে চমৎকার একটি হাদিস রয়েছে। আবু হুরায়রা রা: নবী কারিম সা: থেকে বর্ণনা করেছেন- তিনি বলেছেন, ‘সাত প্রকারের লোককে আল্লাহ তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। তাদের মধ্যে একজন হলো এমন ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে চোখের পানি প্রবাহিত করে’ (বুখারি-৬৬০)।
আরেক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহর (আজাবের) ভয়ে যে মুমিন বান্দার দু-চোখ থেকে অশ্রু বের হয়, যদিও তা মাছির মাথা পরিমাণ হয়; এরপর তার চেহারায় কিছু গড়িয়ে পড়ে, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেন’ (ইবনে মাজা-৪১৯৭)। লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক