বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:১৬ পূর্বাহ্ন

অস্তিত্বের সঙ্কটে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম নদী আত্রাই ‘অবৈধ বালু ব্যবসার হাতবদল’

সোহেল রানা (মহাদেবপুর) নওগাঁ
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

মাটি-বালুখেকোদের তা-ব ও দখল-দূষণে অস্তিত্বের লড়ায়ে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম নদী ‘আত্রাই’। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানেও মুক্ত হয়নি এ নদী। হয়েছে অবৈধ বালু ব্যবসার হাতবদল। বেড়েছে নদীখেকোদের দৌরাত্ম্য। বালুমহাল দখল নিয়ে সংঘর্ষে ঝড়েছে রক্ত। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অবৈধ খননযন্ত্র (ড্রেজার) বসিয়ে অবাধে চলছে বেআইনি বালু উত্তোলন। কোথাও সমুদ্র ড্রেজিং এর কাজে ব্যবহৃত খননযন্ত্র দিয়েও চলছে বালু লোপাট। আবার কোথাও কোথাও চলছে নদী পাড়ের মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রির প্রতিযোগিতা। এতে নদীর গতিপথ পরিবর্তনসহ ভাঙন বাড়ছে। বিরূপ প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপরও। এভাবেই নদীর সর্বনাশ ডেকে আনছে তারা। আর প্রশাসনের ভূমিকা রহস্যজনক। তবে মাঝেমধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন তারা। দফারফা শেষে আবারও চলে অবৈধ বালু উত্তোলন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার আত্রাই নদীর উজান অংশের বালুমহালের দখল নিয়ে স্থানীয় বিএনপির দুইপক্ষের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এ দ্বন্দ্বের জেরে একাধিকবার মারামারি, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সরকারি রাস্তার কালভার্ট ভাংচুর ও একাধিক স্থানে খনন করে রাস্তা নষ্ট করে দুর্বৃত্তরা। এতে ভোগান্তিতে পড়ে পঁচটি গ্রামের অন্তত ১০ হাজার কৃষক। অভিযোগ রয়েছে- বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে আত্রাই নদীর উজান ও ভাটি অংশের বালুমহাল দখলে নিয়ে মহিষবাথান, জেলেপাড়া, সুলতানপুর, নূরপুর, দোহালী ও শিবগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার অন্তত ৪০-৪৫টি পয়েন্টে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অবৈধ খননযন্ত্র দিয়ে চলছে বালু উত্তোলন। মহাদেবপুরে বিএনপির রাজনীতি তিনটি গ্রুপে বিভক্ত। এক গ্রুপ অপর গ্রুপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বালু বিক্রি করে টাকা কামানোর প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। রাজনৈতিক খরচের অজুহাতে প্রতিদিন কয়েক হাজার গাড়ি মাটি ও বালু বিক্রি করে অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। এতে নদীর সর্বনাশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হলেও পকেট ভারী হচ্ছে চক্রের সদস্যদের। এদিকে, গত এক ডিসেম্বর সকালে জেলার ধামইরহাট উপজেলার শিমুলতলী সেতুর নিচে বিএনপি নেতা-কর্মীদের অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযান চালায় প্রশাসন। মোবাইল কোর্টে চার লাখ টাকা জরিমানা করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান। গত ২২ অক্টোবর দুপুরে সেনাবাহিনীর সহায়তায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) রিফাত আরা আত্রাই নদীর দোহালী মৌজায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করে খননযন্ত্রের ব্যাটারি জব্দ করেন এবং বালু উত্তোলনের পাইপ ভেঙ্গে ফেলা হয়। এরআগেও সেখানে বালু উত্তোলনের দায়ে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। তবে তিনি রহস্যজনক কারণে অবৈধভাবে তোলা কয়েক লাখ টাকার বালু জব্দ করেননি। অপরদিকে, নওগাঁর মান্দা উপজেলার লক্ষ্মীরামপুর, আয়াপুর ও মদনচক এলাকায় আত্রাই নদী থেকে নিয়মবহির্ভূত বালু উত্তোলন বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন স্থানীয়রা। গত সাত নভেম্বর দুপুরে মান্দা উপজেলার বানডুবি হাজি ইসমাইল হোসেন উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এ কর্মসূচি পালন করেন তারা। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, জেলার মহাদেবপুর, ধামইরহাট, পত্নীতলা, আত্রাই ও মান্দা উপজেলায় আত্রাই নদীতে অবৈধ ড্রেজারের সমারোহ। বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন উপেক্ষা করে দিন-রাত অবাধে চলছে বেআইনি বালু উত্তোলন। নদীর প্রায় ৩০০টি স্থানে ড্রামের সাহায্যে অসংখ্য খননযন্ত্র ভাসিয়ে রাখা হয়েছে। এসব যন্ত্রের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সরবরাহ করে প্রতিদিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একদল দুর্বৃত্ত। মহাদেবপুর উপজেলার হাতুড় ইউনিয়নের সুলতানপুর এলাকায় নদীতে ইঞ্জিন চালিত বিশেষ বোটে (নৌকা) সমুদ্র ড্রেজিং এর কাজে ব্যবহৃত খননযন্ত্র বসিয়ে চলছে বালু লুটপাট। এর পাশেই রয়েছে আরও ১০-১২টি অবৈধ ড্রেজার। শুধু তাই নয়, সেখানে নদীর তীরের ৫০-৬০ বিঘা ফসলি জমি ক্ষতবিক্ষত করে চলছে মাটি ও বালু বিক্রি। মহিষবাথান জেলেপাড়া ও মহিষবাথান এলাকার আত্রাই নদীর পূর্ব তীরের দুটি পয়েন্টে ১০-১২টি ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু তুলে বিক্রির প্রতিযোগিতা। এতে নদীগর্ভে ভেঙে পড়ছে জমি। মহাদেবপুর সদরের মডেল স্কুল সংলগ্ন ঝুঁকিপূর্ণ দোহালী এলাকায় খননযন্ত্র দিয়ে বালু উত্তোলন করায় নদীর গতিপথ পরির্তনসহ নদীর মধ্যে চর জেগে ওঠেছে। বর্ষা মৌসুম এলেই ভেঙে যায় বেড়িবাঁধ। নদী পাড়ের বাসিন্দারা জানান, সমুদ্র ড্রেজিং এর কাজে ব্যবহৃত খননযন্ত্র দিয়ে বালু লুটপাট তারা আগে কখনোই দেখেননি। অভিযোগ দিয়েও মিলছে না প্রতিকার। বালু বহনকারী বেপরোয়া ১০ চাকার ডাম্পার, ট্রাক ও অবৈধ ট্রাক্টর চলাচলে ধুলো-বালি উড়ে রাস্তার দু’পাশের ঘরবাড়ি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। হুমকির মুখে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাট। এসব বালুবাহী যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন বলে দাবি তাদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ড্রেজার শ্রমিক জানান, মোবাইল কোর্টের অভিযান চালানোর আগেই ব্যবসায়ীদের কাছে খবর চলে আসে। সম্প্রতি তাদের পয়েন্টে অভিযান চালিয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) রিফাত আরা বালু উত্তোলন বন্ধ করে খননযন্ত্রের ব্যাটারি জব্দ করেন এবং বালু উত্তোলনের পাইপ ভেঙ্গে ফেলা হয়। এরপর দফারফা শেষে সেই ব্যাটারি তাদের ফিরিয়ে দেন সহকারী কমিশনার। তারপর আবারও শুরু হয় বালু উত্তোলন। নওগাঁ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু বক্কর সিদ্দিক নান্নু জানান, দলীয় পরচিয়ে নদী দখলের সুযোগ নেই। দুষ্কৃতকারীরা দলের কেউ নয়। কারও বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকলে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেয়া করা হবে। জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল জানান, জেলা প্রশাসনের অভিযান চলমান রয়েছে। আত্রাই নদীর কয়েকটি পয়েন্টে মোবাইল কোর্টের অভিযানে জরিমানা করা হয়েছে। খবর পেলেই তৎক্ষনাৎ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছেন তারা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com