বিশ্ব ব্যাপি বন্ধু হারাচ্ছে ভারত। দীর্ঘদিন থেকে কানাডা ও ইউরোপিয় ইউনিয়নভুক্ত ও মধ্যপ্রচ্যের কয়েকটি দেশের সাথে চলছে টানাপোড়েন। সম্প্রতি ভারতকে ‘অসহযোগী’ দেশ ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের, সুইজারল্যান্ড প্রত্যাহার করলো বিশেষ সুবিধা। ভারতকে ‘অসহযোগী’ দেশগুলোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ও শুল্ক প্রয়োগ সংস্থা (আইসিই)। এটি এমন একটি তালিকা, যেখানে উল্লেখিত দেশগুলো প্রত্যার্পণ প্রক্রিয়ায় যথাযথ সহযোগিতা করে না বলে মনে করে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। এই তালিকায় ভারত ছাড়াও রয়েছে ভুটান, কিউবা, ইরান, পাকিস্তান, রাশিয়া এবং ভেনেজুয়েলা। আইসিই জানিয়েছে, এই দেশগুলো সাক্ষাৎকার গ্রহণ, সময়মতো ভ্রমণ নথি ইস্যু এবং নির্ধারিত ফ্লাইটে তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে।
আইসিই’র তালিকা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৪ লাখ ৫০ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ হাজার অভিবাসীই ভারতীয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় ৯০ হাজার ভারতীয়কে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টাকালে আটক করা হয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, এদের অধিকাংশই পাঞ্জাব, গুজরাট এবং অন্ধ্র প্রদেশের বাসিন্দা।
বৈধতার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা
অনেক ভারতীয় অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে তাদের অবস্থান বৈধ করার চেষ্টা করলেও এই প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। বৈধতার আবেদনে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগতে পারে। অবশ্য, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যায় ভারত সবার ওপরে নয়। ২ লাখ ৬১ হাজার অবৈধ অভিবাসী নিয়ে শীর্ষে রয়েছে হন্ডুরাস, এরপর গুয়াতেমালার রয়েছে ২ লাখ ৫৩ হাজার অবৈধ অভিবাসী। এশিয়ার মধ্যে চীন ৩৭ হাজার ৯০৮ জন অভিবাসী নিয়ে শীর্ষে রয়েছে, আর ভারত রয়েছে ১৩তম স্থানে।
কার্যকর হবে কঠোর অভিবাসন নীতি
যুক্তরাষ্ট্রের নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী এক মাসের মধ্যে দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় অভিবাসন নীতি কঠোর করার অঙ্গীকার করেছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বৃহত্তম প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া পরিচালনার পরিকল্পনা করেছেন। এর ফলে, চূড়ান্ত আদেশপ্রাপ্ত হাজার হাজার ভারতীয় অভিবাসীকেও ফেরত পাঠানো হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ ভারত-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্কেও চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এনডিটিভি সূত্রে প্রকাশ,ভারতের ‘সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ’ মর্যাদা প্রত্যাহার করলো সুইজারল্যান্ড। এত বলা হয়েছে, দ্বৈত কর পরিহার চুক্তির (ডিটিএএ) আওতায় ভারতের ‘সবচেয়ে অনুকূল’ বা ‘সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের’ (এমএফএন) মর্যাদা প্রত্যাহার করেছে সুইজারল্যান্ড। সুইস অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ভারতের সুপ্রিম কোর্টে নেসলে মামলার রায়ের প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলায় রায় দেন, কোনো দেশ ওইসিডি-তে (অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা) যোগ দিলে এমএফএন ধারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয় না। বরং পূর্ববর্তী কর চুক্তি প্রাধান্য পায় এবং এটি কার্যকর করতে ‘প্রজ্ঞাপন’ প্রয়োজন।
নেসলে মামলা কী
ভারত লিথুয়ানিয়া এবং কলম্বিয়ার সঙ্গে এমন একটি কর চুক্তি করেছিল, যেখানে নির্দিষ্ট ধরনের আয়ের ওপর করহার ছিল ওইসিডি-ভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় কম। পরে এই দেশগুলো ওইসিডি-তে যোগ দেয়। তখন সুইজারল্যান্ড দাবি করেছিল, ভারতের সঙ্গে তাদের চুক্তিতে এমএফএন ধারা অনুযায়ী করের হার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ হতে হবে।
কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্ট
রায় দেন, কোনো দেশ ওইসিডি-তে যোগ দিলেই এমএফএন ধারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয় না। বরং পূর্ববর্তী কর চুক্তি অগ্রাধিকার পায়, যদি না এমএফএন ধারা ‘আয়কর আইনের ধারা ৯০’ অনুযায়ী প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা থাকে।
নেসলে মামলায় ২০২১ সালে দিল্লি হাইকোর্ট এমএফএন ধারা কার্যকর করার পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। তবে, ২০২৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায় উল্টে দিয়ে জানান, প্রজ্ঞাপন ছাড়া এমএফএন ধারা কার্যকর হতে পারে না। সুইজারল্যান্ডের মতে, এই রায় তাদের প্রত্যাশার বিরুদ্ধে গেছে এবং এতে নেসলেসহ অন্যান্য কর সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের অবস্থান দুর্বল হয়েছে।
পরিণতি
গত ১১ ডিসেম্বর সুইস অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ভারতীয় করদাতাদের জন্য সুইজারল্যান্ডে ডিভিডেন্ডের ওপর করহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদক্ষেপ ভারতীয় কোম্পানি এবং সুইস বিনিয়োগের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। এটি বিশেষত সুইজারল্যান্ডে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর সাবসিডিয়ারির জন্য করের বোঝা বাড়াবে।
ট্যাক্স বিশেষজ্ঞ সন্দীপ ঝুনঝুনওয়ালা একে একতরফা পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, এটি আন্তর্জাতিক করনীতির স্থিতিশীলতা এবং স্বচ্ছতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অন্যদিকে, অমিত মহেশ্বরী এই পদক্ষেপকে প্রতিশোধমূলক নয়, বরং সমতা রক্ষার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, উচ্চ করের কারণে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য পরিস্থিতি আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। সূত্র: এনডিটিভি