মুমিনের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে নামাজ। আল্লাহর খাঁটি বান্দা হওয়া এবং তাঁর নৈকট্য অর্জন করার জন্য নামাজের কোনো বিকল্প নেই। নামাজের মাধ্যমেই আল্লাহর সাথে বান্দার গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- ‘উসজুদ ওয়াকতারিব’ অর্থাৎ সিজদা কর এবং নিকটবর্তী হও। এখানে সিজদা দ্বারা উদ্দেশ্য নামাজ। নামাজ আল্লাহ তায়ালার অত্যন্ত পছন্দনীয় আমল। নামাজের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি মর্যাদার নামাজ হলো তাহাজ্জুদ। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ফরজ নামাজের পর নফল নামাজের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদা হলো তাহাজ্জুদের নামাজ। এই নামাজের অনেক ফজিলত। যারা বিনা হিসেবে জান্নাতে যেতে পারবেন, তাদের মধ্যে একশ্রেণীর লোক হলেন তারা, যারা যতেœর সাথে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেন। ফরজের পাশাপাশি তাহাজ্জুদ নামাজে যতœবান ব্যক্তিরা আল্লাহর ওলি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে এই নামাজ পড়ার অনেক সাওয়াব রয়েছে। অবশ্য ইশার নামাজের পর থেকে সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত তাহাজ্জুদের সময় গণ্য। তবে শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া উত্তম। তাহাজ্জুদের নামাজ কমপক্ষে চার রাকাত এবং অনধিক ১২ রাকাত পড়া উত্তম। সম্ভব না হলে অন্তত দুই রাকাত হলেও পড়া দরকার। তবুও একদম ছেড়ে দেয়া উচিত নয়। বুঝা গেল, তাহাজ্জুদের নামাজ দুই রাকাত থেকে ১২ রাকাত। রাসূলুল্লাহ সা: সাধারণত আট রাকাত তাহাজ্জুদ পড়তেন বিধায় এটিকেই উত্তম বলা হয়েছে। পারলে আট রাকাত নতুবা চার রাকায়াত আর তাও হিম্মত না হলে দুই রাকাত হলেও পড়া উচিত। আবার গভীর রাতে উঠা সম্ভব না হলে ইশার নামাজের পর এই নামাজ আদায় করা যাবে। তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই সাওয়াব কম হবে। তাহাজ্জুদ নামাজের কোনো কাজা নেই। তাহাজ্জুদের নামাজ যেকোনো সূরা দিয়ে পড়া যায়। কোনো সূরা কিরাত নির্দিষ্ট নেই, তবে সূরা-কিরাত লম্বা হওয়া উত্তম। এভাবে নিয়ত করা যায়, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে দুই রাকাত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করছি। তাহাজ্জুদের মাধ্যমে বান্দার সাথে আল্লাহর সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়। রাতের শেষ প্রহরে যখন লোকেরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বান্দাদের প্রতি তাদের কৃতকাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানান। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেছেন, ‘প্রতি রাতের শেষ এক-তৃতীয়াংশে মহান আল্লাহ জমিনের কাছাকাছি আসমানে নেমে এসে তাঁর বান্দাদের আহ্বান জানিয়ে বলেন- কে আছো যে আমায় ডাকবে? আর আমি তার ডাকে সাড়া দেবো। কে আছো যে আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাকে তা দান করব। কে আছো যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আর আমি তাকে ক্ষমা করব।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস-১১৪৫) কুরআনের বিভিন্ন সূরায় এই সালাতের জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। প্রিয় নবীজি সা:-এর পর সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ি, তাবে-তাবেয়িসহ সব যুগের ওলি ও বুজুর্গরা তাহাজ্জুদ নামাজে রাত কাটিয়ে দিয়েছেন। তাহাজ্জুদ গোনাহ মিটিয়ে দেয় এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে মুক্ত রাখে। এ ছাড়া শত্রুর ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব রয়েছে। হজরত আবু উমামা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদের প্রতি যতœবান হও। কেননা, তা তোমাদের পূর্ববর্তী সালেহিনের অভ্যাস এবং রবের নৈকট্য লাভের বিশেষ মাধ্যম। আর তা পাপরাশি মোচনকারী এবং গোনাহ থেকে বাধা প্রদানকারী।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস-৩৫৪৯) তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার দ্বারা সুন্নতের অনুসরণ তো হয়ই, এতে উন্নয়ন হয়। আল্লাহ তায়ালা তাহাজ্জুদ পড়া ব্যক্তির ডাকে সাড়া দেন এবং তার দোয়া ও মনের আশা কবুল করেন। কিয়ামুল লাইল তথা রাত জেগে নামাজ মুমিনের মর্যাদার সিঁড়ি। জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম উপায়। সফলতার চাবিকাঠি। আল্লাহর একান্ত ও প্রিয় হওয়ার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। নবীজি সা: কখনো তাহাজ্জুদ ছাড়েননি। তিনি নিজে আদায় করতেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উৎসাহিত করতেন। আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা:-কে সম্বোধন করে বলেছেন- ‘রাতের কিছু অংশ জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়–ন, যা আপনার জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের অতিরিক্ত একটি নামাজ, আশা করা যায় যে, এই তাহাজ্জুদ পড়ার কারণে আপনার রব আপনাকে মাকামে মাহমুদে স্থান দেবেন।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-৭৯) প্রসঙ্গিত কিয়ামতের দিন যখন সব মানুষ পেরেশান হবে তখন রাসূলের সুপারিশে সেই পেরেশানি থেকে নাজাত পাবে এবং হিসাব আরম্ভ হবে। এই সুপারিশের অধিকারকে মাকামে মাহমুদ বলা হয়। হজরত আবু মালেক আশআরি রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই জান্নাতে রয়েছে এমন কিছু কক্ষ বা প্রাসাদ, যার বাইরে থেকে ভেতরাংশ দেখা যাবে, ভেতর থেকে বাহিরাংশ দেখা যাবে। এগুলো আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন, যারা মানুষকে খাওয়ায়, কোমল ভাষায় কথা বলে, ধারাবাহিকভাবে রোজা রাখে, সালামের প্রসার ঘটায় এবং রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তারা নামাজে দ-ায়মান থাকে।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস-২৫২৭)। লেখক : শিক্ষক দারুল উলুম একশিং মাদরাসা, সিংড়া, নাটোর।